আজ চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের জন্মদিন। নিজের ছবি তোলার ব্যাপারে ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। মোহাম্মদ আসাদের স্মৃতি ও ছবিতে ধরা পড়েছে মুর্তজা বশীরের জীবনের এক অন্যরকম প্রতিচ্ছবি।
মোহাম্মদ আসাদ
মুর্তজা বশীরের সঙ্গে যাঁরা মিশেছেন তাঁরা জানেন তিনি একটি আদর্শ। সবসময় আলাপচারিতায় সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় ছিলনা তাঁর জানা নেই। সব বিষয়ে বলতে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেটাই গোগ্রাসে গিলেছি আট বছর। তাঁর ছবি, লেখা ও সংগ্রহের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। তাঁর জীবনের শেষ আট বছর ছায়ার মতো থাকলেও এই পরিচয়ের শুরুটা প্রায় দুই যুগ আগে।
পড়াশোনা শেষ করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি। ছবি তুলি আর লেখালেখি করার চেষ্টা করি। সেটা ১৯৯৭ সালের কথা। চিত্রশিল্পীদের নিয়ে আমার আগ্রহটা বেশি। শিল্পী কাজী আবদুল বাসেত আমার এলাকার লোক। চিন্তা করলাম সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটা তাঁকে দিয়ে শুরু করি। ফোন করে গিয়ে হাজির হলাম স্যারের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার বাসয়। সাক্ষাৎকার শেষ করে স্যারকে আমার তোলা কিছু ফুলের ছবি দেখালাম। সেগুলো ছিল ফুলের ভিতরের অংশের ছবি। স্যার দেখে বললেন-‘এগুলোত বিমূর্ত চিত্রকলা। তোমার ভেতর শিল্পীমন আছে। শিল্পী হলে ভালো করতে। যাক ভালো ছবি তোল এটাও কম নয়। এখন অনেক বড় বড় শিল্পী বেঁচে আছে তাঁদের ছবি তুলে রাখ। সেটাও হবে ভিন্ন এক শিল্পকলা।’
ভাবলাম ঠিকই তো, এ কাজও মন্দ নয়। শুরু করলাম শিল্পীদের ছবি তোলার কাজ। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী তখন চারুকলার নিয়মিত শিক্ষক। তিন জনই জননন্দিত শিল্পী। অবাক হওয়ার বিষয় হলো কাইয়ুম চৌধুরীকে চিনতাম পত্রিকার সাহিত্যপাতা ও বিশেষ সংখ্যা সচিত্র করণের কারণে। হাশেম খানকে চিনতাম পাঠ্যবইয়ের ছবি দেখে। আর রফিকুন নবীকে কার্টুনের জন্য।
চিত্রশিল্পী বলতে বুঝলাম আমিনুল ইসলামকে। চলন-বলন কথায়, ঢংয়ে একজন আদর্শ শিল্পী। তিনি ঢাকার চারুকলার (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) প্রথম ছাত্র। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার পতিকৃৎ। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য মালিবাগে পুরানো ধাঁচের সুন্দর একটি বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। বেল বাজাতেই শার্টের ওপরের বোতামগুলো খোলা, মাথায় ঝাঁকড়া চুলওয়ালা এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। বললেন, আমিই আমিনুল ইসলাম।
খোলা বুকের গলার নিচ থেকে যতটুকু দেখা যায় কাটা, সেলাইয়ের চিহ্ন চোখে পড়ছিল। আমি কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইলাম ঐ কাটাচিহ্নের দিকে। আমাকে স্বাভাবিক করতে বললেন, চল ওপরে যাই। দোতলায় গিয়ে দেখি ছবি আর ছবি। অনেকক্ষণ ছবি দেখিয়ে গল্প করলেন। বললাম, অনেক শিল্পীর ছবি তুলেছি, বাইরে গিয়ে ডে-লাইটে আপনার ছবি তুলব। জানতে চাইলেন কার কার ছবি তুলেছি। ১০/১২ জনের নাম বললাম। বললেন, বশীরের ছবি তোলনি, তাইলে আর কি তুলেছ? বললাম, তিনি আবার কে? আমার তালিকায় এই নামের শিল্পী তো নাই।
তিনি বুঝতে পারলেন, এই বিষয়ে আমার জ্ঞান কম। বললেন, আরে সে তো থাকে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম চারুকলায় শিক্ষকতা করে। শিল্পী কাকে বলে, গিয়ে দেখ। দিলেন তাঁর ফোন নাম্বারও। শিল্পী আমিনুল ইসলামের ছবি তুলে ফিরে এসে সন্ধ্যায় ফোন দিলাম মুর্তজা বশীরকে। তিনিই ফোন ধরলেন। অনেক গল্প হলো। ঢাকার গল্প, চারুকলার গল্প এবং ঢাকার শিল্পীদের গল্প। কী ক্ষুরধার কথা, অসাধারণ শব্দ চয়ন! মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছিলাম। তিনিই বললেন চট্টগ্রামে আসো, অনেক গল্প হবে। বললাম আগামী সপ্তাহে আসছি। দিনক্ষণ ঠিক করে নিলাম তাঁর ঠিকানা।
নির্দিষ্ট দিনে সকালবেলায় চট্টগ্রামে মুর্তজা বশীরের নাসিরাবাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। ঘর ভর্তি হাজারো ছবি আর সংগৃহীত উপাদান। একটা একটা করে তাঁর আঁকা ছবি দেখালেন। ছবিগুলোর বিষয়-সময় সম্পর্কে ধারণা দিলেন। তাঁর সংগৃহীত কয়েন-কারেন্সি, টেরাকোটা, পুঁথি দেখালেন। আর দেখালেন অনেক পুরানো ছবি। তাঁর ঢাকায় পড়ার সময়কার বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি। কলকাতা, পাকিস্তান, ইতালি, ফ্রান্সের ছবি।
অনেক পুরানো ছবি কপি করলাম। চারটা ফিল্ম নিয়েছিলাম, তা শেষ হওয়ায় ছবি তোলা শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকায় ফিরলাম। স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে এলাম একটি ড্রইং। তারপর মাঝেমধ্যেই ফোন দেই, নানা বিষয় নিয়ে গল্প হয়। ঢাকার খবরাখবর জানেন। আমার তো আর ফোন নাই। আমার সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নাই। আমিই ফোন দেই। ফোন দিতে দেরি হলে অভিযোগ করেন। তারপরের বছর ১৯৯৮ সালে জানালেন ঢাকায় আসছেন, চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে অংশ নিতে। দুই দিনের উৎসবে অনেক ছবি তুলেছি।
আজ থেকে ২৭ বছর আগের ঘটনা। তেমন বুঝে উঠতে পারিনি। তারপরও সামনে যা দেখেছি তারই ছবি তুলেছি। দুই দিনে ২০-২২ ফিল্ম ছবি তুলেছি।
মুর্তজা বশীরের কাছে কয়েকবার গিয়েছি। এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি কথা বলার কোনো সুযোগই পাননি। শেষ বার ছবি তোলার সময় জানালেন তিনি ঢাকায় আছেন। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বাসায় যাবেন শিল্পকলা একাডেমি থেকে সম্মাননা জানাতে।
সেদিনের তারিখটি আমার মনে নেই। ভূতের গলি দেবদাস চক্রবর্তী বা গৌতম চক্রবর্তীর বাসায় গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। অনেক শিল্পী একসঙ্গে দেবদাস চক্রবর্তীকে নিয়ে বসে গল্প করছেন। সেখানে ছিলেন শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ মহসীন, শওকাতুজ্জামান, সুবীর চৌধুরী, আনোয়ারুল হক পিয়ারু, রনজিৎ দাস। এছাড়া নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরও অনেকে ছিলেন সেখানে।
মুর্তজা বশীর বসে আছে সবার মাঝখানে। বের হওয়ার সময় কিছুক্ষণ গল্প হলো। গল্প হলো দেবদাস চক্রবর্তীকে নিয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই দুজনে জানের জান ছিলেন। মুর্তজা বশীরের বিয়েটার যোগসূত্র দেবদাস চত্রবর্তী। সেখানে তুললাম অনেক ছবি।
তারপর অনেক দিন দেখা নেই। আমি চলে গেলাম দেশের বাইরে। যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিদেশ থেকেই খবর পেলাম বশীর ভাই অবসর নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন ২০০৩ সালে। তখন আমি বশীর ভাই বলতাম।
দেশে ফিরে নানা অনুষ্ঠানে দেখা হয়, ছবি তুলি। বাসায় যেতে বলেন, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না। ২০১০ সালে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার জন্য ছবি তুলতে গিয়ে একবেলা কাটিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। কত গল্প করেছি, কত ছবি তুলেছি, হিসাব নেই। কারণ, তখন আমার হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা। ক্যামেরা বন্ধ করব, এমন সময় বললেন, আমার পছন্দের বিয়ারের ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে ছবি না তুলে শেষ করছ? ছবি তুললাম বাঁধাই করা সেই পোস্টারটির সামনে দাঁড় করিয়ে।
২০১৩ সালে সাংবাদিক আশফাকুর রহমান জানালেন, মুর্তজা বশীর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমাকে ডেকেছেন ছবি তোলার জন্য। আমি ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছলাম ইউনাইটেড হাসপাতালে। না, ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে যাওয়া অনুমতি নাই। মুর্তজা বশীরের বড় মেয়ে মুনিরা বশীর যুই আমাকে সহায়তা করলেন। তিনি আরেকটি ব্যাগে করে আমার ক্যামেরার ব্যগটি ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে তাঁর কেবিনে গিয়ে দেখি, আগের দিন লাইফ সার্পোটে নেওয়ার মত অবস্থা থেকে ফিরে আসা মানুষটির শরীর অনেকটাই অচেতনের মত। কিন্তু মুখটি তার স্বাভাবিক আছে। কথা বলছেন, অন্য সময়ের মতো ছবি তোলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেমন ছবি তুলছি সেটা আবার দেখাতে হচ্ছে।
একটা ছবি তুলতে হবে শরীরে লাগানো নানা উপাদান নিয়ে। অচল শরীর তুলে ধরলেন ছবি তোলার জন্য। নির্দেশনা দিলেন পিছনের ঘড়িটা যেন ছবিতে আসে। কারণ বাসায় গিয়ে এই সময়টার ড্রইং করবেন। নেবুলাইজার নেয়ার ছবি তুললাম অনেক সময় নিয়ে। যেমন ধোঁয়া চাচ্ছিলেন সেটা আমি আনতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ ছবি তোলার পর সফল হলাম। বাসায় ফিরে ফেসবুকে লিখে ছিলাম বশীর ভাই হাসপাতালে।
বাসায় ফিরে একদিন ফোন দিয়ে জানলেন হাসপাতালের ছবিগুলো প্রিন্ট করে দিয়ে আসতে। সেদিন বন্ধু আশফাকুর রহমানসহ পরিচিত কয়েকজন ছিল সেখানে। সবাই বশীর স্যার, বশীর স্যার বলছেন। আমিও বশীর স্যার বলা শুরু করলাম। ফেরার সময় স্যার বললেন যখনই সময় পাওয়া বাসায় এসো। খুব আনন্দিত হলাম।
সময় পেলেই আসব, এটাতো আমার সৌভাগ্য। তারপর নিয়মিতই যাওয়া শুরু হলো বশীর স্যারের বাসায়। কখনও সকালে, কখনও বিকেলে। সকালেই বেশি। প্রথমে শুধু ছবি তুলে গল্প করে ফিরতাম। পরে গল্পগুলো রেকর্ড করা শুরু করলাম। সেখান থেকে কোনোটা সাক্ষাৎকার, কোনোটা স্যারের লেখা হিসেবে ছাপা হতে লাগল। আর এই সময়ে তাঁর সারাদিনের প্রতিটি ঘটনার ছবি তুলেছি। তুলেছি বললে ভুল হবে। স্যারের নির্দেশনামতো ছবিগুলো তুলতে বাধ্য হয়েছি। সে কাজে আনন্দও পেয়েছি।
মুর্তজা বশীর ছবি তোলেন বিদেশে পড়ার সময়ই। তারও আগে পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলে রেখেছেন সারাজীবন। ছবি তোলা ছিল তাঁর একটি পছন্দের বিষয়। আমার দাঁড়ানো দেখে বুঝতে পারতেন ছবিটা কেমন তুলব। পছন্দ না হলে বলতেন আরেকটু ডানে গিয়ে দাঁড়াও, অথবা বামে। ক্যামেরার উল্টো পাশ থেকেও তিনি বুঝতে পারতেন ছবি কম্পজিশন। ছবি তুলেছি তিনি কীভাবে বসেন, কীভাবে হাঁটেন, কীভাবে ছবি আঁকেন। তাঁর ঘুমানোর ছবিও তুলতে হয়েছে।
নাপিত বাসায় এসে কেমন করে চুল-দাড়ি কাটে, কীভাবে তিনি শাওয়ার নেন, সেই ছবিও তুলেছি। তাঁর জীবনের সমস্ত ছবির ফিল্ম তিনি দান করেছেন আমাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ স্যারের শেষ ছবিটি তুলেছি। ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক লাখ ছবি তুলেছি। অনেক ভিডিও করেছি, লিখেছিও অনেক। তারপর করোনার কারণে আর স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। তখন স্যার নিয়মিত ফেসবুকে একটিভ ছিলেন। সেখানেই চলত যোগাযোগ। সে বছর ১৫ আগস্ট তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন।
একটি ঘটনা সবসময় চোখের সামনে ভাসে। ২০১৬ সালে ‘রবীন্দ্রসংগীতে ফুল’ নামে একটা সিরিজ ছবি তুললাম। সেই ছবিগুলো ছিল ফুলের সমন্বয়ে রবীন্দ্রপোট্রেট। ছবিগুলো স্যারকে দেখালাম। স্যার খুব পছন্দ করলেন। বললেন, আমার একটা ছবি তোল প্রজাপতির সঙ্গে। পাশেই টাঙানো ছিল শো-পিছ প্রজাপতি। মাল্টিপল শট হলে অপশনে গিয়ে ক্যামেরায় সেট করে নিতে হয় কয়টা শট নিব। দুটি ছবি সেটাপ করে নিলে দুটি শট নেওয়ার পর ব্লান্ড করে একটা ছবি হয়ে যাবে। দুটি ছবির কোনটা প্রাধান্য পাবে এটা নির্ভর করে আগে তোলা এবং ছবির রংয়ের ওপর। অনেকটা আন্দাজের উপর ছবি তুলতে হয়। স্যার শর্ত দিয়েছেন তাঁর নাক রাখতে হবে প্রজাপতির মধ্যেখানে। দুই পাখায় দুটি চশমা।
প্রায় আধা ঘন্টা এই ছবি তোলার খেলা খেললাম। অসুস্থ শরীর নিয়েও স্যার হাসি মুখে ছবি তোলার সময় পার করলেন। এরকম ছবি আরেক দিন তুলে ছিলাম তাঁর পেইন্টিংয়ের নারী ফিগারের সঙ্গে। এই যে লক্ষ লক্ষ ছবি তুলেছি, সে ছবির প্রতিটিরই রয়েছে মজার মজার গল্প। আছে কষ্টেরও।
চাচি মারা গেলেন। সকালে ফোন দিয়ে কাঁদলেন। চাচি হাসপাতালে ছিলেন বলে আমার বুঝতে ভুল হয়নি। আমি ফোন কেটে দ্রুত তাঁর বাসায় চলে এলাম। শোকে পাথর হয়ে আছে মুর্তজা বশীর। আমি এটাসেটা করার চেষ্টা করছি। সেটা দেখে হাত-ইশারায় ডেকে বললেন, তোমার কাজ তুমি কর। অন্য কাজে হাত দেয়ার দরকার নাই। বশীর স্যার নাই, আমি সেই স্মৃতিগুলো নিয়েই বেঁচে আছি।
মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিত্রশিল্পী। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়)-এর দ্বিতীয় ব্যাচের ভর্তি হন ১৯৪৯ সালে। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে ১৭ আগষ্ট ঢাকার শহরে। বাবা জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মা মরগুবা খাতুন। স্বাভাবিকভাবেই এই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির অন্দরমহলে প্রবেশ ছিল তাঁর শৈশব থেকেই।
কমিউনিস্ট আন্দোলন, আর্ট কলেজে ভর্তি -- একটি নিয়মের মধ্যে হলেও ক্যানভাসে তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে আটকে থাকেননি অনেক দিন। ইতালিতে শিল্পকলায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে আবার থিতু হয়েছেন মাতৃভুমিতে। অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদে। তাঁর ক্যানভাসে বিষয় বদল করেছেন একের পর এক। এঁকেছেন দেয়াল সিরিজ, এপিটাফ অব মার্টার, প্রজাপ্রতির পাখা, কালিমা তাইবা। ছিলেন দক্ষ লেখক, মুদ্রসংগ্রাহক। কাজ করেছেন পোড়ামাটির টেরাকোটা নিয়ে। চলচ্চিত্র গড়ার কাজও করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
মুর্তজা বশীর একজন ভাষাসৈনিক, যুক্ত ছিলেন দেশ স্বাধীন করার কাজেও। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ চিত্রধারণার প্রবর্তক। লিনোকাট মাধ্যমে তাঁর আঁকা ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শীর্ষক ছবিটি ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রথম চিত্রকর্ম। তিনি ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।
মুর্তজা বশীরের সঙ্গে যাঁরা মিশেছেন তাঁরা জানেন তিনি একটি আদর্শ। সবসময় আলাপচারিতায় সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় ছিলনা তাঁর জানা নেই। সব বিষয়ে বলতে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেটাই গোগ্রাসে গিলেছি আট বছর। তাঁর ছবি, লেখা ও সংগ্রহের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। তাঁর জীবনের শেষ আট বছর ছায়ার মতো থাকলেও এই পরিচয়ের শুরুটা প্রায় দুই যুগ আগে।
পড়াশোনা শেষ করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি। ছবি তুলি আর লেখালেখি করার চেষ্টা করি। সেটা ১৯৯৭ সালের কথা। চিত্রশিল্পীদের নিয়ে আমার আগ্রহটা বেশি। শিল্পী কাজী আবদুল বাসেত আমার এলাকার লোক। চিন্তা করলাম সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটা তাঁকে দিয়ে শুরু করি। ফোন করে গিয়ে হাজির হলাম স্যারের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার বাসয়। সাক্ষাৎকার শেষ করে স্যারকে আমার তোলা কিছু ফুলের ছবি দেখালাম। সেগুলো ছিল ফুলের ভিতরের অংশের ছবি। স্যার দেখে বললেন-‘এগুলোত বিমূর্ত চিত্রকলা। তোমার ভেতর শিল্পীমন আছে। শিল্পী হলে ভালো করতে। যাক ভালো ছবি তোল এটাও কম নয়। এখন অনেক বড় বড় শিল্পী বেঁচে আছে তাঁদের ছবি তুলে রাখ। সেটাও হবে ভিন্ন এক শিল্পকলা।’
ভাবলাম ঠিকই তো, এ কাজও মন্দ নয়। শুরু করলাম শিল্পীদের ছবি তোলার কাজ। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী তখন চারুকলার নিয়মিত শিক্ষক। তিন জনই জননন্দিত শিল্পী। অবাক হওয়ার বিষয় হলো কাইয়ুম চৌধুরীকে চিনতাম পত্রিকার সাহিত্যপাতা ও বিশেষ সংখ্যা সচিত্র করণের কারণে। হাশেম খানকে চিনতাম পাঠ্যবইয়ের ছবি দেখে। আর রফিকুন নবীকে কার্টুনের জন্য।
চিত্রশিল্পী বলতে বুঝলাম আমিনুল ইসলামকে। চলন-বলন কথায়, ঢংয়ে একজন আদর্শ শিল্পী। তিনি ঢাকার চারুকলার (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) প্রথম ছাত্র। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার পতিকৃৎ। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য মালিবাগে পুরানো ধাঁচের সুন্দর একটি বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। বেল বাজাতেই শার্টের ওপরের বোতামগুলো খোলা, মাথায় ঝাঁকড়া চুলওয়ালা এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। বললেন, আমিই আমিনুল ইসলাম।
খোলা বুকের গলার নিচ থেকে যতটুকু দেখা যায় কাটা, সেলাইয়ের চিহ্ন চোখে পড়ছিল। আমি কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইলাম ঐ কাটাচিহ্নের দিকে। আমাকে স্বাভাবিক করতে বললেন, চল ওপরে যাই। দোতলায় গিয়ে দেখি ছবি আর ছবি। অনেকক্ষণ ছবি দেখিয়ে গল্প করলেন। বললাম, অনেক শিল্পীর ছবি তুলেছি, বাইরে গিয়ে ডে-লাইটে আপনার ছবি তুলব। জানতে চাইলেন কার কার ছবি তুলেছি। ১০/১২ জনের নাম বললাম। বললেন, বশীরের ছবি তোলনি, তাইলে আর কি তুলেছ? বললাম, তিনি আবার কে? আমার তালিকায় এই নামের শিল্পী তো নাই।
তিনি বুঝতে পারলেন, এই বিষয়ে আমার জ্ঞান কম। বললেন, আরে সে তো থাকে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম চারুকলায় শিক্ষকতা করে। শিল্পী কাকে বলে, গিয়ে দেখ। দিলেন তাঁর ফোন নাম্বারও। শিল্পী আমিনুল ইসলামের ছবি তুলে ফিরে এসে সন্ধ্যায় ফোন দিলাম মুর্তজা বশীরকে। তিনিই ফোন ধরলেন। অনেক গল্প হলো। ঢাকার গল্প, চারুকলার গল্প এবং ঢাকার শিল্পীদের গল্প। কী ক্ষুরধার কথা, অসাধারণ শব্দ চয়ন! মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছিলাম। তিনিই বললেন চট্টগ্রামে আসো, অনেক গল্প হবে। বললাম আগামী সপ্তাহে আসছি। দিনক্ষণ ঠিক করে নিলাম তাঁর ঠিকানা।
নির্দিষ্ট দিনে সকালবেলায় চট্টগ্রামে মুর্তজা বশীরের নাসিরাবাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। ঘর ভর্তি হাজারো ছবি আর সংগৃহীত উপাদান। একটা একটা করে তাঁর আঁকা ছবি দেখালেন। ছবিগুলোর বিষয়-সময় সম্পর্কে ধারণা দিলেন। তাঁর সংগৃহীত কয়েন-কারেন্সি, টেরাকোটা, পুঁথি দেখালেন। আর দেখালেন অনেক পুরানো ছবি। তাঁর ঢাকায় পড়ার সময়কার বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি। কলকাতা, পাকিস্তান, ইতালি, ফ্রান্সের ছবি।
অনেক পুরানো ছবি কপি করলাম। চারটা ফিল্ম নিয়েছিলাম, তা শেষ হওয়ায় ছবি তোলা শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকায় ফিরলাম। স্মৃতি হিসেবে সঙ্গে নিয়ে এলাম একটি ড্রইং। তারপর মাঝেমধ্যেই ফোন দেই, নানা বিষয় নিয়ে গল্প হয়। ঢাকার খবরাখবর জানেন। আমার তো আর ফোন নাই। আমার সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নাই। আমিই ফোন দেই। ফোন দিতে দেরি হলে অভিযোগ করেন। তারপরের বছর ১৯৯৮ সালে জানালেন ঢাকায় আসছেন, চারুকলার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে অংশ নিতে। দুই দিনের উৎসবে অনেক ছবি তুলেছি।
আজ থেকে ২৭ বছর আগের ঘটনা। তেমন বুঝে উঠতে পারিনি। তারপরও সামনে যা দেখেছি তারই ছবি তুলেছি। দুই দিনে ২০-২২ ফিল্ম ছবি তুলেছি।
মুর্তজা বশীরের কাছে কয়েকবার গিয়েছি। এতই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি কথা বলার কোনো সুযোগই পাননি। শেষ বার ছবি তোলার সময় জানালেন তিনি ঢাকায় আছেন। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বাসায় যাবেন শিল্পকলা একাডেমি থেকে সম্মাননা জানাতে।
সেদিনের তারিখটি আমার মনে নেই। ভূতের গলি দেবদাস চক্রবর্তী বা গৌতম চক্রবর্তীর বাসায় গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। অনেক শিল্পী একসঙ্গে দেবদাস চক্রবর্তীকে নিয়ে বসে গল্প করছেন। সেখানে ছিলেন শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ মহসীন, শওকাতুজ্জামান, সুবীর চৌধুরী, আনোয়ারুল হক পিয়ারু, রনজিৎ দাস। এছাড়া নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরও অনেকে ছিলেন সেখানে।
মুর্তজা বশীর বসে আছে সবার মাঝখানে। বের হওয়ার সময় কিছুক্ষণ গল্প হলো। গল্প হলো দেবদাস চক্রবর্তীকে নিয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই দুজনে জানের জান ছিলেন। মুর্তজা বশীরের বিয়েটার যোগসূত্র দেবদাস চত্রবর্তী। সেখানে তুললাম অনেক ছবি।
তারপর অনেক দিন দেখা নেই। আমি চলে গেলাম দেশের বাইরে। যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিদেশ থেকেই খবর পেলাম বশীর ভাই অবসর নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন ২০০৩ সালে। তখন আমি বশীর ভাই বলতাম।
দেশে ফিরে নানা অনুষ্ঠানে দেখা হয়, ছবি তুলি। বাসায় যেতে বলেন, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না। ২০১০ সালে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার জন্য ছবি তুলতে গিয়ে একবেলা কাটিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। কত গল্প করেছি, কত ছবি তুলেছি, হিসাব নেই। কারণ, তখন আমার হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা। ক্যামেরা বন্ধ করব, এমন সময় বললেন, আমার পছন্দের বিয়ারের ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে ছবি না তুলে শেষ করছ? ছবি তুললাম বাঁধাই করা সেই পোস্টারটির সামনে দাঁড় করিয়ে।
২০১৩ সালে সাংবাদিক আশফাকুর রহমান জানালেন, মুর্তজা বশীর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমাকে ডেকেছেন ছবি তোলার জন্য। আমি ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছলাম ইউনাইটেড হাসপাতালে। না, ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে যাওয়া অনুমতি নাই। মুর্তজা বশীরের বড় মেয়ে মুনিরা বশীর যুই আমাকে সহায়তা করলেন। তিনি আরেকটি ব্যাগে করে আমার ক্যামেরার ব্যগটি ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে তাঁর কেবিনে গিয়ে দেখি, আগের দিন লাইফ সার্পোটে নেওয়ার মত অবস্থা থেকে ফিরে আসা মানুষটির শরীর অনেকটাই অচেতনের মত। কিন্তু মুখটি তার স্বাভাবিক আছে। কথা বলছেন, অন্য সময়ের মতো ছবি তোলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেমন ছবি তুলছি সেটা আবার দেখাতে হচ্ছে।
একটা ছবি তুলতে হবে শরীরে লাগানো নানা উপাদান নিয়ে। অচল শরীর তুলে ধরলেন ছবি তোলার জন্য। নির্দেশনা দিলেন পিছনের ঘড়িটা যেন ছবিতে আসে। কারণ বাসায় গিয়ে এই সময়টার ড্রইং করবেন। নেবুলাইজার নেয়ার ছবি তুললাম অনেক সময় নিয়ে। যেমন ধোঁয়া চাচ্ছিলেন সেটা আমি আনতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ ছবি তোলার পর সফল হলাম। বাসায় ফিরে ফেসবুকে লিখে ছিলাম বশীর ভাই হাসপাতালে।
বাসায় ফিরে একদিন ফোন দিয়ে জানলেন হাসপাতালের ছবিগুলো প্রিন্ট করে দিয়ে আসতে। সেদিন বন্ধু আশফাকুর রহমানসহ পরিচিত কয়েকজন ছিল সেখানে। সবাই বশীর স্যার, বশীর স্যার বলছেন। আমিও বশীর স্যার বলা শুরু করলাম। ফেরার সময় স্যার বললেন যখনই সময় পাওয়া বাসায় এসো। খুব আনন্দিত হলাম।
সময় পেলেই আসব, এটাতো আমার সৌভাগ্য। তারপর নিয়মিতই যাওয়া শুরু হলো বশীর স্যারের বাসায়। কখনও সকালে, কখনও বিকেলে। সকালেই বেশি। প্রথমে শুধু ছবি তুলে গল্প করে ফিরতাম। পরে গল্পগুলো রেকর্ড করা শুরু করলাম। সেখান থেকে কোনোটা সাক্ষাৎকার, কোনোটা স্যারের লেখা হিসেবে ছাপা হতে লাগল। আর এই সময়ে তাঁর সারাদিনের প্রতিটি ঘটনার ছবি তুলেছি। তুলেছি বললে ভুল হবে। স্যারের নির্দেশনামতো ছবিগুলো তুলতে বাধ্য হয়েছি। সে কাজে আনন্দও পেয়েছি।
মুর্তজা বশীর ছবি তোলেন বিদেশে পড়ার সময়ই। তারও আগে পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলে রেখেছেন সারাজীবন। ছবি তোলা ছিল তাঁর একটি পছন্দের বিষয়। আমার দাঁড়ানো দেখে বুঝতে পারতেন ছবিটা কেমন তুলব। পছন্দ না হলে বলতেন আরেকটু ডানে গিয়ে দাঁড়াও, অথবা বামে। ক্যামেরার উল্টো পাশ থেকেও তিনি বুঝতে পারতেন ছবি কম্পজিশন। ছবি তুলেছি তিনি কীভাবে বসেন, কীভাবে হাঁটেন, কীভাবে ছবি আঁকেন। তাঁর ঘুমানোর ছবিও তুলতে হয়েছে।
নাপিত বাসায় এসে কেমন করে চুল-দাড়ি কাটে, কীভাবে তিনি শাওয়ার নেন, সেই ছবিও তুলেছি। তাঁর জীবনের সমস্ত ছবির ফিল্ম তিনি দান করেছেন আমাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ স্যারের শেষ ছবিটি তুলেছি। ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক লাখ ছবি তুলেছি। অনেক ভিডিও করেছি, লিখেছিও অনেক। তারপর করোনার কারণে আর স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। তখন স্যার নিয়মিত ফেসবুকে একটিভ ছিলেন। সেখানেই চলত যোগাযোগ। সে বছর ১৫ আগস্ট তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন।
একটি ঘটনা সবসময় চোখের সামনে ভাসে। ২০১৬ সালে ‘রবীন্দ্রসংগীতে ফুল’ নামে একটা সিরিজ ছবি তুললাম। সেই ছবিগুলো ছিল ফুলের সমন্বয়ে রবীন্দ্রপোট্রেট। ছবিগুলো স্যারকে দেখালাম। স্যার খুব পছন্দ করলেন। বললেন, আমার একটা ছবি তোল প্রজাপতির সঙ্গে। পাশেই টাঙানো ছিল শো-পিছ প্রজাপতি। মাল্টিপল শট হলে অপশনে গিয়ে ক্যামেরায় সেট করে নিতে হয় কয়টা শট নিব। দুটি ছবি সেটাপ করে নিলে দুটি শট নেওয়ার পর ব্লান্ড করে একটা ছবি হয়ে যাবে। দুটি ছবির কোনটা প্রাধান্য পাবে এটা নির্ভর করে আগে তোলা এবং ছবির রংয়ের ওপর। অনেকটা আন্দাজের উপর ছবি তুলতে হয়। স্যার শর্ত দিয়েছেন তাঁর নাক রাখতে হবে প্রজাপতির মধ্যেখানে। দুই পাখায় দুটি চশমা।
প্রায় আধা ঘন্টা এই ছবি তোলার খেলা খেললাম। অসুস্থ শরীর নিয়েও স্যার হাসি মুখে ছবি তোলার সময় পার করলেন। এরকম ছবি আরেক দিন তুলে ছিলাম তাঁর পেইন্টিংয়ের নারী ফিগারের সঙ্গে। এই যে লক্ষ লক্ষ ছবি তুলেছি, সে ছবির প্রতিটিরই রয়েছে মজার মজার গল্প। আছে কষ্টেরও।
চাচি মারা গেলেন। সকালে ফোন দিয়ে কাঁদলেন। চাচি হাসপাতালে ছিলেন বলে আমার বুঝতে ভুল হয়নি। আমি ফোন কেটে দ্রুত তাঁর বাসায় চলে এলাম। শোকে পাথর হয়ে আছে মুর্তজা বশীর। আমি এটাসেটা করার চেষ্টা করছি। সেটা দেখে হাত-ইশারায় ডেকে বললেন, তোমার কাজ তুমি কর। অন্য কাজে হাত দেয়ার দরকার নাই। বশীর স্যার নাই, আমি সেই স্মৃতিগুলো নিয়েই বেঁচে আছি।
মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিত্রশিল্পী। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়)-এর দ্বিতীয় ব্যাচের ভর্তি হন ১৯৪৯ সালে। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে ১৭ আগষ্ট ঢাকার শহরে। বাবা জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মা মরগুবা খাতুন। স্বাভাবিকভাবেই এই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির অন্দরমহলে প্রবেশ ছিল তাঁর শৈশব থেকেই।
কমিউনিস্ট আন্দোলন, আর্ট কলেজে ভর্তি -- একটি নিয়মের মধ্যে হলেও ক্যানভাসে তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে আটকে থাকেননি অনেক দিন। ইতালিতে শিল্পকলায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে আবার থিতু হয়েছেন মাতৃভুমিতে। অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদে। তাঁর ক্যানভাসে বিষয় বদল করেছেন একের পর এক। এঁকেছেন দেয়াল সিরিজ, এপিটাফ অব মার্টার, প্রজাপ্রতির পাখা, কালিমা তাইবা। ছিলেন দক্ষ লেখক, মুদ্রসংগ্রাহক। কাজ করেছেন পোড়ামাটির টেরাকোটা নিয়ে। চলচ্চিত্র গড়ার কাজও করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
মুর্তজা বশীর একজন ভাষাসৈনিক, যুক্ত ছিলেন দেশ স্বাধীন করার কাজেও। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ চিত্রধারণার প্রবর্তক। লিনোকাট মাধ্যমে তাঁর আঁকা ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শীর্ষক ছবিটি ভাষা আন্দোলন বিষয়ক প্রথম চিত্রকর্ম। তিনি ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান।
তাহসান আর মিথিলার ছাড়াছাড়ির গসিপে পার্টিসিপেট করে নাই এমন মানুষ খুব কমই ছিল। ব্যাটারা ব্যাপক দুঃখী আর ভিক্টিমাইজড মোডে চলে গেলেও নারীরা মৃদু খুশিই হইছে। এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে সিঙ্গেল দেখাই তো আরাম, নাকি? আমার এক বান্ধবীর মোবাইলের ওয়ালপেপারেও সেইভ করা ছিল তাহসানের ছবি।
৩ ঘণ্টা আগেভোর থেকেই ঢাকার আকাশে উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজে শুরু হয় শুভ জন্মাষ্টমীর উৎসব। রঙিন শোভাযাত্রা, ভক্তদের ঢল ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজা-অর্চনায় মুখর ছিল পুরান ঢাকা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি ঘিরে ভক্তি, আনন্দ আর সম্প্রীতির আবহে মিলেমিশে ছিল আবেগ, স্মৃতি ও সামাজিক একতার আহ্বান।
১ দিন আগেশিল্পী হিসেবে নিজের সৃষ্টির মধ্যে ততদিন একজন আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাংলা গান বেঁচে থাকবে। পাশাপাশি আমার প্রজন্মের সবার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন একজন বড় ভাই হিসেবে, মেন্টর হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে। কারণ, একজন আইয়ুব বাচ্চু বাংলা রকযাত্রায় আমাদের ছায়াবৃক্ষ।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় রক মিউজিকের অন্যতম অগ্রগামী পথিক ছিলেন বাচ্চু। পরে সেই পথ ধরে হেঁটে চলেছে আরও অনেকেই। এক জীবনে নন্দিত গানের যত পসরা সাজিয়েছেন, দুই হাতে তা ধরার নয়। গিটারের তারে এবি যে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়েছেন, তাকে বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।
১ দিন আগে