বাংলার নিজস্ব শোকের ঐতিহ্য, যেমন ‘বারোমাস্যা’র (নারীর বারো মাসের দুঃখের বর্ণনা) সাথে কারবালার কাহিনি একাত্ম হয়ে নতুন রূপ লাভ করে। এই ধারার অন্যতম পথিকৃৎ কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। তাঁর "জয়নবের চৌতিশা" বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। 'চৌতিশা' নামক দেশজ আঙ্গিকে তিনি কারবালার ঘটনাকে ইমাম হোসাঈনের বোন বিবি জয়নবের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন।
তাহমীদ চৌধুরী
‘মর্সিয়া’ শব্দটি বাংলায় এসেছে আরবি হাত ধরে। আভিধানিকভাবে যার অর্থ শোক প্রকাশের জন্য মাতম করা। ইংরেজিতে যাকে বলে কি না এলিজি । তবে পার্থক্য হচ্ছে, সাধারণ শোকগাথার চেয়ে মর্সিয়ার দরদ যেন আরও গভীর। আরবদেশের প্রাচীন এ লোকাচার কীভাবে বাংলার আলো বাতাসে নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই বেড়ে উঠলো?
রিছা থেকে মর্সিয়া
ইসলাম আসার আগে আরবের যাযাবর জীবন ছিল গোত্রভিত্তিক। এসব গোত্রে বীরত্বকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। তখন প্রচলন ছিল ‘রিছা’ নামে এক বিশেষ ধরনের শোকগাথার। কোনো বীর বা গোত্রপ্রধানের মৃত্যুতে মূলত নারীরা উচ্চস্বরে কান্নার সঙ্গে এসব কবিতা পড়ত। সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে আরবে যখন আল-খানসার নাম নেওয়া হয়, তাঁর রচিত রিছার কথাই স্মরণ করেন পাঠকেরা। সহোদর সাখর ও মুয়াবিয়ার মৃত্যুতে তিনি যে হৃদয়স্পর্শী কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন, তা আজও আরবি সাহিত্যের ধ্রুপদী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
তবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা এই ব্যক্তিগত শোক প্রকাশের ধারাকে চিরতরে বদলে দিল। রিছা বদলে হয়ে উঠলো এক মহাকাব্যিক ও আধ্যাত্মিক শোকপ্রকাশের মাধ্যম। সে ঘটনা হলো কারবালার হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি। ইসলামি ক্যালেন্ডারে তখন ৬১ হিজরি। মহররম মাসের দশম দিন, যা আজ 'আশুরা' নামে পরিচিত। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর। সেদিন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাঈন (রাঃ) কারবালার প্রান্তরে, ফোরাত নদীর তীরে স্বঘোষিত খলিফা ইয়াজিদের রক্তপিপাসু বাহিনীর দ্বারা নৃশংস কায়দায় বাহাত্তর জন সঙ্গীসহ সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। ঈমাম হোসাঈনের এই হৃদয়বিদারক শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামী শাসন কাঠামোতে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের কলঙ্কজনক অধ্যায় শুরু হয়। পরবর্তীতে ইমাম হোসাঈন এবং তাঁর সঙ্গীদের সেই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের মর্মান্তিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে যে বিশাল শোকসাহিত্য গড়ে উঠেছে, সেটিই 'মর্সিয়া' সাহিত্য নামে পরিচিতি লাভ করে।
যেভাবে ইরানের হাতে নতুন রূপ পেল মর্সিয়া
আরব থেকে মর্সিয়ার এই ধারা গিয়ে পৌঁছায় পারস্যে। এরপর এর আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে ঘটে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিশেষ করে ষোড়শ শতকে সাফাভি শাসনামলে ‘শিয়া ইসলাম’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার পর মর্সিয়া এক নতুন মাত্রা পায়। সে সময় এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মুহতাশাম কাশানী। তাঁর বারো খণ্ডের ‘হাফত-বান্দ’ ফার্সি সাহিত্যের মাইলফলক। এটি সাত স্তবকের স্তোত্র। তিনি এখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ইমাম হোসাঈনের জান কুরবানিকে ফুটিয়ে তোলেন। কাশানী বিষয়গুলো এমন শৈল্পিক উচ্চতায় উপস্থাপন করেন, যা পরবর্তী কবিদের জন্য অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
ভারতে মর্সিয়ার স্বর্ণযুগ
ভারতীয় উপমহাদেশে মর্সিয়া প্রথম আসে দাক্ষিণাত্যের গোলকোন্ডা ও বিজাপুরের শিয়া শাসিত রাজ্যগুলোর পথ ধরে। সেখানকার সুলতানরা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপোষক । তাঁরা পারস্য থেকে কবি-শিল্পীদের সাদরে আমন্ত্রণ জানান। গোলকোন্ডার সুলতান কুলি কুতুব শাহ ছিলেন নিজেও একজন প্রতিভাবান কবি। তাঁর হাত ধরেই প্রথম দাখিনি উর্দুর দক্ষিণ ভারতীয় ধরনে মর্সিয়া লেখা শুরু হয়।
মর্সিয়া তার স্বর্ণশিখরে পৌঁছায় উত্তর ভারতের লখনউ শহরে। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর আওধ রাজ্যের রাজধানী লখনউ শিয়া সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময়েই মর্সিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পরূপে গড়ে ওঠে। মহররমের শোকসভা বা 'মজলিস'-এ মর্সিয়া পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়।
এই স্বর্ণযুগের দুইজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মীর বাবর আলী আনিস ও মির্জা সলামত আলী দবির। তাঁরা মর্সিয়াকে মহাকাব্যের কাঠামো দেন। এতে সরাপা (চরিত্র পরিচিতি), চেহরা (প্রেক্ষাপট), জঙ্গ (যুদ্ধ), শাহাদাত (আত্মত্যাগ) এবং বেইনের (বিলাপ) মতো পর্ব থাকত। আনিস ও দবিরের সৃজনশীল প্রতিদ্বন্দ্বিতা উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
বাংলায় মর্সিয়া
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত একসময় বলেছিলেন, ‘মহাকাব্য লিখিবার উপযোগী একটি বিষয় রহিয়া গেল—সে মুসলমানদের মহররম। জগতে এমন করুণ রসাত্মক বিষয় আর নাই। হিন্দুদের মহাভারতে ‘অভিমন্যু-বধ’ যেমন একটি করুণ রসের প্রস্রবণ, মুসলমানদের মহররম তদপেক্ষা আরও অধিকতর করুণ-রসের মহাসমুদ্র। যদি কেহ লিখিতে পারেন, পরম উপাদেয় হইবে।’
যাইহোক, বাংলায় মর্সিয়ার আগমন ও বিকাশ ঘটেছে দুটি আলাদা পথে। একটি পথ ছিল অভিজাত শ্রেণির। মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাবদের দরবারে উর্দু ও ফার্সি ভাষায় মর্সিয়া পাঠের আসর বা মজলিসের আয়োজন হতো। এই ধারাটি মূলত শহুরে এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য পথটি ছিল গ্রামবাংলার। এ পথেই মর্সিয়া বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের দখল নেয়। বাংলায় আগে থেকেই নাথসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য এবং পুঁথির মতো আখ্যানমূলক কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ফলে কারবালার করুণ কাহিনি খুব সহজেই বাংলার মানুষের মন জয় করে নেয়। বাংলার নিজস্ব শোকের ঐতিহ্য যেমন—নারীর বারো মাসের দুঃখের বর্ণনা বারোমাস্যার সঙ্গে কারবালার শোক একাত্ম হয়ে যেন নতুন রূপ পায়। এ ধারার অন্যতম পথিকৃৎ কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। তাঁর ‘জয়নবের চৌতিশা’ বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। 'চৌতিশা' নামক দেশজ আঙ্গিকে তিনি কারবালার ঘটনাকে ইমাম হোসাঈনের বোন বিবি জয়নবের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন।
তবে বাংলা ভাষায় মর্সিয়া-আখ্যানের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন নিঃসন্দেহে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’। পদ্য না বলে বরং বিষাদ সিন্ধুকে 'গদ্য মহাকাব্য' বলাই উচিত। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ মর্সিয়া সাহিত্যের ধারায় লেখা উপন্যাস। তবে এতে আধুনিক উপন্যাসের সুবিন্যস্ত বন্ধনরীতি অনুসরণ করা হয়নি। তিনি ফার্সি ও উর্দু আখ্যানের মহাকাব্যিক বিস্তারকে বাংলার লোককথার সাবলীল গদ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন আখ্যান রচনা করেন। বিষাদ সিন্ধু কারবালার কাহিনিকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়।
মহররম ও কারবালা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক কবিতা লিখেছেন। তার মধ্যে ‘মহররম’ শিরোনামের কবিতাটি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। সেখানে তিনি প্রথম দুই চরণে লিখছেন—
‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এসেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃ মোহররমের চাঁদ’
এছাড়া, জারি গানের মাধ্যমেও মর্সিয়া বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহররম মাসে গ্রামের গায়েনরা দল বেঁধে কারবালার কাহিনি সুর করে গেয়ে শোনান। এই রীতি আজও বাংলার গ্রামাঞ্চলে জীবন্ত লোক-ঐতিহ্য হিসেবে চালু আছে।
আরবের প্রাচীন লোকাচার থেকে পারস্যের পথে যাত্রা করে, লখনউয়ের ধ্রুপদী সাহিত্যের উঠোন পেরিয়ে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতেও মিশে গেছে মর্সিয়া। মর্সিয়ার এই দীর্ঘ অভিযাত্রা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক চরিত্রের এক উজ্জ্বল প্রমাণ। এ পথে মর্সিয়া ভৌগোলিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সীমানা খুব সহজে অতিক্রম করেছে।
কিন্তু এই ব্যাপক বিস্তারের মূল কারণ কী? সম্ভবত কারবালার ঘটনার সার্বজনীন আবেদনই এর প্রধান কারণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম ও সত্যের জন্য আত্মত্যাগের আদর্শ কোনো বিশেষ সময় বা ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। মানুষের মনে অন্যায় প্রতিষ্ঠার শোক যতদিন থাকবে, ততদিন তার কাব্যিক প্রকাশের আবেদনও টিকে থাকবে। যেমন নজরুলও লিখে গেছেন সেই কবে! তবু পড়তে গেলেই সমকালীন মনে হয়—
এভাবেই কারবালা ও মর্সিয়া-সাহিত্য সমকালের সাথে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যুগে যুগে।
১. মুসলিম বাংলা সাহিত্য, মুহাম্মদ এনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৯
২. নেটস অফ এওয়ারনেস: উর্দু পোয়েট্রি এন্ড ইটস ক্রিটিকস, ফ্রান্সেস ডব্লিউ প্রিচ্চেত, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৯৪
৩. আ হিস্ট্রি অফ উর্দু লিটারেচার, মুহাম্মাদ সাদিক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৪
৪. রিলিজিয়াস পারফর্মেন্স ইন কনটেম্পোরারি ইসলাম: শিয়া ডিভোশনাল রিচুয়ালস ইন সাউথ এশিয়া, ভার্নন জেমস স্কুবেল, ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনা প্রেস, ১৯৯৩
৫. "দ্য কসমিক এগ্রেরিয়ান: বেঙ্গলি রেসপন্সেস টু দা মিথ অফ কারবালা" ইন বেঙ্গল: সাইটস এন্ড সাইটস, টনি কে স্টুয়ার্ট, এডিটেড বাই প্রতাপ আদিত্য পাল, মার্গ পাবলিকেশনস, ২০০৩
‘মর্সিয়া’ শব্দটি বাংলায় এসেছে আরবি হাত ধরে। আভিধানিকভাবে যার অর্থ শোক প্রকাশের জন্য মাতম করা। ইংরেজিতে যাকে বলে কি না এলিজি । তবে পার্থক্য হচ্ছে, সাধারণ শোকগাথার চেয়ে মর্সিয়ার দরদ যেন আরও গভীর। আরবদেশের প্রাচীন এ লোকাচার কীভাবে বাংলার আলো বাতাসে নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই বেড়ে উঠলো?
রিছা থেকে মর্সিয়া
ইসলাম আসার আগে আরবের যাযাবর জীবন ছিল গোত্রভিত্তিক। এসব গোত্রে বীরত্বকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। তখন প্রচলন ছিল ‘রিছা’ নামে এক বিশেষ ধরনের শোকগাথার। কোনো বীর বা গোত্রপ্রধানের মৃত্যুতে মূলত নারীরা উচ্চস্বরে কান্নার সঙ্গে এসব কবিতা পড়ত। সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে আরবে যখন আল-খানসার নাম নেওয়া হয়, তাঁর রচিত রিছার কথাই স্মরণ করেন পাঠকেরা। সহোদর সাখর ও মুয়াবিয়ার মৃত্যুতে তিনি যে হৃদয়স্পর্শী কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন, তা আজও আরবি সাহিত্যের ধ্রুপদী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
তবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা এই ব্যক্তিগত শোক প্রকাশের ধারাকে চিরতরে বদলে দিল। রিছা বদলে হয়ে উঠলো এক মহাকাব্যিক ও আধ্যাত্মিক শোকপ্রকাশের মাধ্যম। সে ঘটনা হলো কারবালার হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি। ইসলামি ক্যালেন্ডারে তখন ৬১ হিজরি। মহররম মাসের দশম দিন, যা আজ 'আশুরা' নামে পরিচিত। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিল ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর। সেদিন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাঈন (রাঃ) কারবালার প্রান্তরে, ফোরাত নদীর তীরে স্বঘোষিত খলিফা ইয়াজিদের রক্তপিপাসু বাহিনীর দ্বারা নৃশংস কায়দায় বাহাত্তর জন সঙ্গীসহ সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। ঈমাম হোসাঈনের এই হৃদয়বিদারক শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামী শাসন কাঠামোতে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের কলঙ্কজনক অধ্যায় শুরু হয়। পরবর্তীতে ইমাম হোসাঈন এবং তাঁর সঙ্গীদের সেই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের মর্মান্তিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে যে বিশাল শোকসাহিত্য গড়ে উঠেছে, সেটিই 'মর্সিয়া' সাহিত্য নামে পরিচিতি লাভ করে।
যেভাবে ইরানের হাতে নতুন রূপ পেল মর্সিয়া
আরব থেকে মর্সিয়ার এই ধারা গিয়ে পৌঁছায় পারস্যে। এরপর এর আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে ঘটে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিশেষ করে ষোড়শ শতকে সাফাভি শাসনামলে ‘শিয়া ইসলাম’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার পর মর্সিয়া এক নতুন মাত্রা পায়। সে সময় এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মুহতাশাম কাশানী। তাঁর বারো খণ্ডের ‘হাফত-বান্দ’ ফার্সি সাহিত্যের মাইলফলক। এটি সাত স্তবকের স্তোত্র। তিনি এখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ইমাম হোসাঈনের জান কুরবানিকে ফুটিয়ে তোলেন। কাশানী বিষয়গুলো এমন শৈল্পিক উচ্চতায় উপস্থাপন করেন, যা পরবর্তী কবিদের জন্য অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
ভারতে মর্সিয়ার স্বর্ণযুগ
ভারতীয় উপমহাদেশে মর্সিয়া প্রথম আসে দাক্ষিণাত্যের গোলকোন্ডা ও বিজাপুরের শিয়া শাসিত রাজ্যগুলোর পথ ধরে। সেখানকার সুলতানরা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের উদার পৃষ্ঠপোষক । তাঁরা পারস্য থেকে কবি-শিল্পীদের সাদরে আমন্ত্রণ জানান। গোলকোন্ডার সুলতান কুলি কুতুব শাহ ছিলেন নিজেও একজন প্রতিভাবান কবি। তাঁর হাত ধরেই প্রথম দাখিনি উর্দুর দক্ষিণ ভারতীয় ধরনে মর্সিয়া লেখা শুরু হয়।
মর্সিয়া তার স্বর্ণশিখরে পৌঁছায় উত্তর ভারতের লখনউ শহরে। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর আওধ রাজ্যের রাজধানী লখনউ শিয়া সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময়েই মর্সিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পরূপে গড়ে ওঠে। মহররমের শোকসভা বা 'মজলিস'-এ মর্সিয়া পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়।
এই স্বর্ণযুগের দুইজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মীর বাবর আলী আনিস ও মির্জা সলামত আলী দবির। তাঁরা মর্সিয়াকে মহাকাব্যের কাঠামো দেন। এতে সরাপা (চরিত্র পরিচিতি), চেহরা (প্রেক্ষাপট), জঙ্গ (যুদ্ধ), শাহাদাত (আত্মত্যাগ) এবং বেইনের (বিলাপ) মতো পর্ব থাকত। আনিস ও দবিরের সৃজনশীল প্রতিদ্বন্দ্বিতা উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
বাংলায় মর্সিয়া
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত একসময় বলেছিলেন, ‘মহাকাব্য লিখিবার উপযোগী একটি বিষয় রহিয়া গেল—সে মুসলমানদের মহররম। জগতে এমন করুণ রসাত্মক বিষয় আর নাই। হিন্দুদের মহাভারতে ‘অভিমন্যু-বধ’ যেমন একটি করুণ রসের প্রস্রবণ, মুসলমানদের মহররম তদপেক্ষা আরও অধিকতর করুণ-রসের মহাসমুদ্র। যদি কেহ লিখিতে পারেন, পরম উপাদেয় হইবে।’
যাইহোক, বাংলায় মর্সিয়ার আগমন ও বিকাশ ঘটেছে দুটি আলাদা পথে। একটি পথ ছিল অভিজাত শ্রেণির। মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাবদের দরবারে উর্দু ও ফার্সি ভাষায় মর্সিয়া পাঠের আসর বা মজলিসের আয়োজন হতো। এই ধারাটি মূলত শহুরে এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য পথটি ছিল গ্রামবাংলার। এ পথেই মর্সিয়া বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের দখল নেয়। বাংলায় আগে থেকেই নাথসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য এবং পুঁথির মতো আখ্যানমূলক কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ফলে কারবালার করুণ কাহিনি খুব সহজেই বাংলার মানুষের মন জয় করে নেয়। বাংলার নিজস্ব শোকের ঐতিহ্য যেমন—নারীর বারো মাসের দুঃখের বর্ণনা বারোমাস্যার সঙ্গে কারবালার শোক একাত্ম হয়ে যেন নতুন রূপ পায়। এ ধারার অন্যতম পথিকৃৎ কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। তাঁর ‘জয়নবের চৌতিশা’ বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। 'চৌতিশা' নামক দেশজ আঙ্গিকে তিনি কারবালার ঘটনাকে ইমাম হোসাঈনের বোন বিবি জয়নবের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন।
তবে বাংলা ভাষায় মর্সিয়া-আখ্যানের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন নিঃসন্দেহে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’। পদ্য না বলে বরং বিষাদ সিন্ধুকে 'গদ্য মহাকাব্য' বলাই উচিত। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ মর্সিয়া সাহিত্যের ধারায় লেখা উপন্যাস। তবে এতে আধুনিক উপন্যাসের সুবিন্যস্ত বন্ধনরীতি অনুসরণ করা হয়নি। তিনি ফার্সি ও উর্দু আখ্যানের মহাকাব্যিক বিস্তারকে বাংলার লোককথার সাবলীল গদ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন আখ্যান রচনা করেন। বিষাদ সিন্ধু কারবালার কাহিনিকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়।
মহররম ও কারবালা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক কবিতা লিখেছেন। তার মধ্যে ‘মহররম’ শিরোনামের কবিতাটি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। সেখানে তিনি প্রথম দুই চরণে লিখছেন—
‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এসেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃ মোহররমের চাঁদ’
এছাড়া, জারি গানের মাধ্যমেও মর্সিয়া বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহররম মাসে গ্রামের গায়েনরা দল বেঁধে কারবালার কাহিনি সুর করে গেয়ে শোনান। এই রীতি আজও বাংলার গ্রামাঞ্চলে জীবন্ত লোক-ঐতিহ্য হিসেবে চালু আছে।
আরবের প্রাচীন লোকাচার থেকে পারস্যের পথে যাত্রা করে, লখনউয়ের ধ্রুপদী সাহিত্যের উঠোন পেরিয়ে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতেও মিশে গেছে মর্সিয়া। মর্সিয়ার এই দীর্ঘ অভিযাত্রা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক চরিত্রের এক উজ্জ্বল প্রমাণ। এ পথে মর্সিয়া ভৌগোলিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সীমানা খুব সহজে অতিক্রম করেছে।
কিন্তু এই ব্যাপক বিস্তারের মূল কারণ কী? সম্ভবত কারবালার ঘটনার সার্বজনীন আবেদনই এর প্রধান কারণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম ও সত্যের জন্য আত্মত্যাগের আদর্শ কোনো বিশেষ সময় বা ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। মানুষের মনে অন্যায় প্রতিষ্ঠার শোক যতদিন থাকবে, ততদিন তার কাব্যিক প্রকাশের আবেদনও টিকে থাকবে। যেমন নজরুলও লিখে গেছেন সেই কবে! তবু পড়তে গেলেই সমকালীন মনে হয়—
এভাবেই কারবালা ও মর্সিয়া-সাহিত্য সমকালের সাথে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যুগে যুগে।
১. মুসলিম বাংলা সাহিত্য, মুহাম্মদ এনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৯
২. নেটস অফ এওয়ারনেস: উর্দু পোয়েট্রি এন্ড ইটস ক্রিটিকস, ফ্রান্সেস ডব্লিউ প্রিচ্চেত, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৯৪
৩. আ হিস্ট্রি অফ উর্দু লিটারেচার, মুহাম্মাদ সাদিক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৪
৪. রিলিজিয়াস পারফর্মেন্স ইন কনটেম্পোরারি ইসলাম: শিয়া ডিভোশনাল রিচুয়ালস ইন সাউথ এশিয়া, ভার্নন জেমস স্কুবেল, ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনা প্রেস, ১৯৯৩
৫. "দ্য কসমিক এগ্রেরিয়ান: বেঙ্গলি রেসপন্সেস টু দা মিথ অফ কারবালা" ইন বেঙ্গল: সাইটস এন্ড সাইটস, টনি কে স্টুয়ার্ট, এডিটেড বাই প্রতাপ আদিত্য পাল, মার্গ পাবলিকেশনস, ২০০৩
এক মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনার পর থেকেই শুরু হয় ফ্রিদার চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার গল্প। ফ্রিদা বলেন, ‘বাস আমাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে আমি হতে চেয়েছিলাম একজন ডাক্তার।’
৮ ঘণ্টা আগেআজ ৬ জুলাই। বাংলাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়ার দিন। গান দিয়েই তিনি ছুঁয়ে গেছেন একের পর এক প্রজন্মের হৃদয়। আর হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন একজন ‘কণ্ঠশ্রমিক’। আজ এন্ড্রু কিশোরের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা ফিরে তাকাব তাঁর বর্ণাঢ্য...
১১ ঘণ্টা আগে১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই, জেফ বেজোস শুরু করেছিলেন তাঁর নতুন ব্যবসা। সিয়াটলে নিজের ভাড়া বাসার গ্যারেজে চালু হওয়া এই কোম্পানির নাম রেখেছিলেন, ‘অ্যামাজন’। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এই ছোট অনলাইন দোকানটাই একদিন হয়ে উঠবে পুরো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস।
১১ ঘণ্টা আগেবাংলার ফোকলোরের প্রবাদ, লোককাহিনি, ঘেটুগান, ভূতের গল্প—আবারও ফিরে এসেছে ডিজিটাল মাধ্যমে। ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েব সিরিজ আর কার্টুনে ভেসে বেড়াচ্ছে শিকড়ের গল্পগুলো। নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখছে এই ডিজিটাল মাধ্যমে ফোকলরের আবার ফিরে আসা।
১৪ ঘণ্টা আগে