বাঙালির জনপ্রিয় সংস্কৃতির শক্তিমান এক চরিত্রের নাম গোপাল ভাঁড়। তাঁর নাম শোনেন নি এমন লোক পাওয়াই মুশকিল। বাঙালির লোককথায় গোপালের অস্তিত্ব চিরায়ত রূপ লাভ করেছে। লোকে তাকে ভালোবাসে, তাঁর কথা শুনে হাসে, চমকে ওঠে তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিতে। গোপালের কাজ, যুক্তি অথবা হাস্যরস শ্রোতা আর পাঠককে মুগ্ধ করে। গোপাল আদতে কে? এই প্রশ্নের মীমাংসা হোক বা না হোক গোপালের রসময় অস্তিত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। লৌকিক আলাপে, ঠাট্টার রসালো মুহূর্তে গোপাল ঘুরে ফিরে আসে। পুনরুৎপাদিত হয় তাঁর গল্প। জীবন্ত মানুষ হিসেবে বেঁচেবর্তে থাকে বাঙালির প্রিয় গোপাল। কিন্তু জনপ্রিয় সংস্কৃতি বিষয়ক চর্চায় এই প্রভাবশালী ব্যক্তিটিকে ঘিরে ভাষ্য বা বিশ্লেষণের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অথচ গোপালকে কেন্দ্র করে বিশ্লেষণধর্মী কাজের সুযোগ আছে।
আমরা বড়জোর গোপালের জীবনের ছোট্ট একটি রূপরেখা পাই। তাতে জানা যায়, গ্রামীণ এক সাধারণ পরিবারে আঠারো শতকে গোপালের জন্ম। পেশায় ছিলেন নাপিত। পড়ালেখা করেন নি। প্রধান কারণ আর্থিক অসচ্ছলতা। গোপালের গুণ হলো ‘প্রখর বুদ্ধি’, ‘সহজাত পরিহাসরসিকতা’ ও ‘চাতুর্য’। গোপালকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ। আরও একটু আলোকিত করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের দ্বারা যে কোন ঘটনাকে এক অর্থবহ তাৎপর্য দান করতে পারতেন।’
গোপল ভাঁড় ও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সংগৃহীত কার্টুনগোপাল বিষয়ক এই বিবরণগুলো মূলত পুরনো পুথি-পুস্তক ও লোকবয়ানের অংশ। যেমন, গোপালের বুদ্ধি ও সরসতার একটি ছবি পাওয়া যায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনী-সন্দর্ভ নামক বইয়ে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের জীবনী মুখ্য বলে সভাসদ হিসেবেই গোপাল এ বইয়ে উপস্থিত। মজার ব্যাপার হলো, বইটিতে গোপালের একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। অন্তত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গোপালের ছবি বলেই দাবিই করেছেন। তাঁর গোপাল-বিবরণী দেখা যাক:
‘তাঁহার [কৃষ্ণচন্দ্রের হৃদয়ে সর্ব্বদা আনন্দ প্রদান করিবার জন্য গোপাল নামক জনৈক ‘ভাঁড়’ নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বেশ সুরসিক ও প্রত্যুপন্নমতি ছিলেন এবং হাস্যরস উদ্দীপনে তাঁহার সমাধিক শক্তি ছিল। তাঁহার নাম জড়িত যে সকল গল্প মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে তাহাতেই তাঁহার বুদ্ধির প্রাখর্য্য ও রসিকতা বিলক্ষণ প্রতীত হয়। গোপালের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য মহারাজ তাঁহাকে বড় ভালবাসিতেন। গোপালও রসিকতার গুণে সর্ব্বদাই মহারাজের বয়স্য স্বরূপ তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন। তজ্জন্য উভয়ের সম্প্রীতি বিশেষ ভাবে ঘনিষ্ঠতা ছিল। গোপালকে সকলেই ভালবাসিতেন এবং রাজার প্রিয়পাত্র বলিয়া সকলেই সম্মানও করিতেন। গোপালের রসালাপের চির প্রচলিত গল্প গুলিই তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিবে।
এই অমরত্ব সত্তে¡ও স্বীকার করতে হবে যে, কোনো বিদ্যায়তনিক কিংবা ক্যাননিক্যাল পরিসর থেকে গোপালের জনপ্রিয়তার সাংস্কৃতিক ভাষ্য খুব বেশি উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। গোপালকে প্রধানত পাওয়া যায় ইতিহাসপুস্তকের পাদটীকায় কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনচরিতে। জ্ঞান, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে গোপাল বিষয়ক মন্তব্য নেহাৎ কমই পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্তব্য থাকলেও গোপালের গল্পভাষ্য সেখানে অনুপস্থিত। পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ বইয়ে রজতকান্ত রায় অবশ্য গোপালের জন্য বেশ খানিকটা জায়গা বরাদ্দ করেছেন। সেখানে গোপালের নামে প্রচলিত কিছু গল্প বিশ্লেষণের পাশাপাশি আঠারো শতকের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করেছেন তিনি। রজতকান্ত গোপালকে স্থাপন করেছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ভেতর।
উল্লেখ করার মতো ঘটনা এই যে, উনিশ শতকে গোপাল ভাঁড় নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার পরিচিতিমূলক বক্তব্যে পাচ্ছি ‘রহস্যজনক মাসিকপত্র’। বাংলা ভাষার ‘রহস্য’ শব্দটির আরেক অর্থ হাস্য-পরিহাস। গোপাল যদি অত জনপ্রিয় না-ই হবেন, তাহলে পরিহাস-আশ্রয়ী পত্রিকার নাম কেন হবে গোপাল ভাঁড়? এই দৃষ্টান্ত মারফত বোঝা যায় উনিশ শতকীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছেও গোপাল ভাঁড়ের একটি জনভিত্তি ছিল। প্রশ্ন হলো, এ কালের পাঠক হিসেবে আমরা কীভাবে গোপাল ভাঁড় আর তাঁর গল্পগুলোকে পাঠ করব? কেননা গল্পের ধারাবাহিকতায় আমাদের কাছে মোটা দাগে সনাতনী গোপাল এলেও আমরা এখন আর পড়ে নেই কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায়।
গোপাল যদি আঠারো শতকের ব্যক্তি হয়ে থাকেন তাহলে এরই মধ্যে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। বহু প্রজন্ম ধরে গোপাল ভাঁড় পেয়েছে নতুন নতুন পাঠক। শুধু পাঠক নয়, গোপালের ভাগ্যে দর্শকও জুটেছে। গোপাল ভাঁড়কে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে নির্মিত হয়েছে সিনেমা। সাম্প্রতিক কালে তৈরি করা হয়েছে টিভি ধারাবাহিক। ২০১৫ সালে জনপ্রিয় অ্যানিমেশন কার্টুন সিরিজ হিসেবে গোপাল ভাঁড়ের ডিজিটাল পুনর্জন্ম ঘটেছে। অর্থাৎ মৌখিক সংস্কৃতির কথনমূলক ঐতিহ্য থেকে আরেক স্তরে উন্নীত হয়েছে গোপাল ভাঁড়। তাই বলে কি গোপালের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে কথকতার জগৎ থেকে?
আদতে তা নয়। বরং ডিজিটাল পৃথিবীতে প্রবেশের পর গোপাল তাঁর পূর্ববর্তী অস্তিত্বকেও জারি রাখল। এর প্রধান কারণ এই নয় যে, আমরা এখনো গোপালের আঠারো-উনিশ শতকীয় গল্পের যুগের সামাজিক সত্তায় বসবাস করি। এ যুগে আমাদের সামনে শাক্ত-বৈষ্ণব দ্বন্দ্ব, জাতিসমস্যা কিংবা রাজা-নবাবের ক্ষমতার রেশারেশি প্রধান সমস্যা নয়। তাহলে আমরা কেন গোপালের গল্পে ফিরি? এর প্রধান কারণ প্রকৃতপক্ষে রসশাস্ত্রীয়।
লৌকিক রসিকতা শ্রোতা ও বক্তার চিত্তকে স্পন্দিত করে। ব্যক্তিক অথবা সামাজিক কোনো একটি প্রসঙ্গের সূত্র ধরে উঠে আসে গোপাল ভাঁড়ের প্রসঙ্গ। এতে করে দুই পক্ষের জন্য বুদ্ধির ব্যায়াম হয়। এরই সূত্রে ধরে আবির্ভূত হয় দ্বিতীয় কারণটি; যা মূলত ভাষিক। হাস্য-রসিকতা-রঙ্গব্যঙ্গের জন্য ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেকোনো সাধারণ হাস্যরসকে ‘উইট’-এ রূপান্তরিত করতে গেলে লেখক/বক্তাকে ভাষার খেলাটা ভালোভাবেই জানতে হয়। শুধু তা-ই নয়, রঙ্গব্যঙ্গের ভাষা সব সময়ই প্রতিষ্ঠিত ও প্রথাগত ভাষাদর্শকে ডিঙিয়ে যায়, ভাষাদর্শের ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্ন করে।
গোপাল ভাঁড়কেও ভাষা নিয়ে খেলতে দেখা যায়। খেলতে খেলতে এই ভাষা ডিঙিয়ে যায় সামাজিক আদর্শের সীমা। আর তাই অভিজাত ভোক্তাদের কাছে গোপালের গল্পের ভাষা বা প্রসঙ্গ অনেক সময় হয়ে ওঠে ‘অশিষ্ট’ ও ‘অশ্লীল’। ভাষার খেলার একটি উদাহরণ দেয়া যাক; যেমন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ক্ষুব্ধ হয়ে গোপালের মুখ দেখতে না চাওয়ায় গোপাল পরদিন সভায় গিয়ে তার পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। গোপালের পক্ষ থেকে যুক্তি এই, মহারাজ আমার মুখ দেখতে চান নি। তাই আমি মুখ ঘুরিয়ে বসে আছি। অন্য এক গল্পে দেখা যাচ্ছে, গোপাল খাটের এক পায়াকে বলেছে ‘খট্বাঙ্গপুরাণ’; খাটের অঙ্গ, তাই ‘খট্বাঙ্গ’।
কথার লড়াইয়ে একবার এক মুসলমান মৌলবিকে গোপালের কাছে পরাস্ত হতে দেখা যায়। মৌলবি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞানী। এক নিমন্ত্রণে গিয়ে গোপাল গিয়ে দেখে মৌলবি খাচ্ছে। গোপাল জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাচ্ছেন মৌলবি মশাই?’ মাছ খেতে খেতে জবাবে মৌলবি বলল, ‘তোমাদের অবতার ভোজন করছি।’ ভারতীয় পুরাণে মাছ হলো দশম অবতার। মৌলবি অবতারের কোনো নাম উল্লেখ না করায় গোপাল বলল, ‘নিশ্চয়ই তৃতীয় অবতার?’ মৌলবি তওবা বলে উঠে পড়লেন। মুখে আর কোনো খাবার তুলল না। কারণ তৃতীয় অবতার হলো শূকর। ইসলামে শূকর নিষিদ্ধ বস্তু।
‘গোপাল ভাঁড়ের ১১১ হাসির গল্প’ বইয়ের প্রচ্ছদ। সংগৃহীত ছবিতৃতীয় বা দশম অবতার নিয়ে এই খেলা এক অর্থে ভাষার খেলাও। কেননা খেলাটি সম্পন্ন হয়েছে ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রেখে দেয়ার মাধ্যমে। মৌলবি ও গোপালের কাছে ‘অবতার’ শব্দটি ধারণ করেছে দুটি বিপরীত অর্থ। আর তাই এই খেলা হয়ে ওঠে ‘উচ্চমার্গীয়’; যার শাস্ত্রজ্ঞান আছে কেবল তার পক্ষেই এই বাকপটুতায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব।
লোকগল্প এক অর্থে ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তির খেলা; গোপালের গল্পও তা-ই। তাঁর নামে প্রচলিত গল্পে পাওয়া যায় ভাষার যুক্তি, প্রতিযুক্তি, ফ্যালাসি—যা মস্তিষ্ককে নাড়িয়ে দেয়। জগৎ ও জীবনের বহুমাত্রিক বিষয়ে গোপালের কাজ ও যুক্তি অনুষঙ্গ হিসেবে আসে। আর তাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্যের অনুচ্চার্য প্রেক্ষাপট ধরে গোপালের গল্পগুলো কখনো কখনো জোরেশোরে টান দেয়। গোপাল প্রশ্ন করে ফেলে ক্ষমতাসম্পর্ককে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কিংবা নবাবকে বোকা বানাতে গোপাল সন্ত্রস্ত হয় না মোটেও। রাজনৈতিকভাবে যে শাসককে প্রশ্ন করা যাচ্ছে না, প্রতি মুহূর্তে ‘জি হুজুর’, ‘জি হুজরু’ সহমত পোষণ করতে হচ্ছে সেই শাসককেই যখন বোকার হদ্দ বানানো হয় তখন নিম্নবর্গের সাধারণ শ্রোতারা গোপালের গল্প শুনে, পড়ে অথবা দেখে আনন্দ পাবেই। বাস্তবেও শাসকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা যায় না, ব্যঙ্গ করা যায় না, কিন্তু কথার মারপ্যাচ দিয়ে গোপাল ঠকিয়ে দেয় শাসক পক্ষকে। এখানেই নিম্নবর্গের গভীর গভীরতর আমোদ।
বলা যায়, বাস্তব জীবনের প্রসঙ্গগুলোকে গোপাল উসকে দেয়, আরেকটু তাৎপর্যায়িত করে গোপালের গল্প। আমরা কল্পনা করে নিই গোপালের গলার স্বর ও হাসি। অবশ্য যাঁরা বই আকারে সচিত্র গোপাল ভাঁড়ের মুখোমুখি হয়েছেন অথবা ডিজিটাল মাধ্যমে যাঁরা গোপালকে দেখতে অভ্যস্ত তাদের ব্যাপার আলাদা। কল্পনার ব্যক্তিরূপ তাঁরা দেখে ফেলেছেন।
আমরা ভাবতে পারি, গোপালীয় গল্পের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি, মাধ্যম ও কৌশলগুলো নিয়ে। গোপালের গল্পকে যাঁরা পরিবেশন করছেন তাঁরা কথক/ লেখকসুলভ কর্তৃত্বকে চাপিয়ে দিচ্ছেন কিনা? কেননা কথায় কথা বাড়ে, কথায় সংযুক্তি ঘটে; পাশাপাশি কথা থেকে কথার ছাড়ও ঘটে যায়। মৌখিক সংস্কৃতির এই প্রবণতাগুলো বৈশ্বিক। পরিবেশনার মাধ্যম যখন বদলায় তখন পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে আধেয়-জগতেও। প্রকৃতপক্ষে জনপ্রিয় সংস্কৃতি আর গোপাল ভাঁড়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
গোপাল ভাঁড়ের গল্প পাঠের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য; গোপাল ভাঁড়কে প্রথমত পাঠ করা দরকার মৌখিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে; এর সঙ্গে যুক্ত আছে কথকের মতাদর্শ ও পারফরমেন্স। সেদিক থেকে আঠার শতক থেকে এই কাল পর্যন্ত গোপালের প্রাসঙ্গিকতাকে খেয়াল করা জরুরি। আলাপ ও আড্ডায় একজন কথক কেন গোপালের গল্পকে হাজির করছেন, তার কার্যকারণ বোঝার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা যায়।
দ্বিতীয়ত, গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করা দরকার লিখিত সংস্কৃতির পাটাতনে গোপাল ভাঁড়ের উঠে আসার বৃত্তান্ত; শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে গোপালের পুনর্বয়ন ও বয়ান কীভাবে ঘটল? এই হিসাব মিলাতে গিয়ে সাধারণত উনিশ শতকের বটতলার পুঁথিপত্র প্রকাশনার পর্বটিকে মনে রাখা হয়। কিন্তু সেই সময়ে গোপাল মুদ্রিত হলেও চিত্রিত হয় নি। অর্থাৎ গোপালের অবয়ব উঠে আসে নি বইয়ের পাতায়। মুদ্রণযন্ত্রের উৎকর্ষ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে গোপালের কল্পিত অবয়বের একটি প্রতিমূর্তি তৈরি হতে আরম্ভ করেছে। শহুরে পাঠক গোপালের অশিষ্ট কথা ও কাণ্ডকারখানাকে ভালোভাবে গ্রহণ করল কি? প্রশ্ন থেকে যায়।
তৃতীয়ত, ভিজ্যুয়াল পরিবেশনায় গোপাল ভাঁড়ের উপস্থাপন কীভাবে ঘটেছে—খোঁজা যেতে পারে এই প্রশ্নের জবাব। স্বীকার করতেই হবে, পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় গোপাল ভাঁড়ের ডিজিটাল পরিবেশনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। হাজার পর্ব ছাড়িয়ে গেছে অ্যানিমেশন কার্টুন। এইসব গল্পে গোপাল থাকলেও সব গল্প গোপালের নয়। আদতে গোপালের অতগুলো গল্প কারো দ্বারা সংকলিত হয় নি। মুখে মুখে হাজারখানেক গল্পও নেই।
চতুর্থত, কালানুক্রমিক ও কালকেন্দ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে গোপাল ভাঁড় বিষয়ক বিবরণ তৈরি করা যায়। অর্থাৎ সম্পন্ন হতে পারে গোপাল বিষয়ক লেখালেখি ও তৎপরতার ইতিহাস লিপিবব্ধকরণের কাজ। সত্যিকার অর্থে, গোপাল ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সে প্রশ্নের চেয়েও জরুরি কাজ হলো গোপালের সাংস্কৃতিক বিস্তারের ইতিহাস পুনর্গঠন করা।
পঞ্চমত, আঞ্চলিকতার পটভূমিতে গোপাল ভাঁড়ের গল্প কখন, কীভাবে বাংলা অঞ্চলের পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে এলো? এমন একটি প্রশ্নের মীমাংসাও আমরা করতে পারি। এই অনুসন্ধানের মূলে সক্রিয় ভাবনা হলো, পূর্ববাংলা একটি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল। অনেক গল্পেই মুসলমান নবাব ও চরিত্রকে পরাস্ত হতে দেখা যায়। তাহলে মুসলমান মনস্তত্তে গোপাল ভাঁড়ের সাদরে গৃহীত হওয়ার কারণ কী? বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের আত্মবিবরণী বা স্মৃতিচারণে এ সম্পর্কিত কোনো উল্লেখ আছে কিনা, খুঁজে দেখা দরকার।
এ জাতীয় প্রশ্ন সামনে রেখে গোপাল ভাঁড় প্রসঙ্গে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো কাজ সম্পন্ন হয়েছে কিনা জানি না। তবে অনুমান করি, গবেষণামূলক কাজ সম্পাদন করার সুযোগ আছে। সমস্যা হলো, ঐতিহাসিকেরা যেসব প্রামাণিক তথ্য-উপাত্তের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলেন, গোপাল ভাঁড় বিষয়ে সে ধরনের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে। অবশ্য লোকায়ত গল্পের ধারাকে ইতিহাসের উপাত্ত-আশ্রয়ী ব্যাখ্যায় প্রামাণ্য করে তুলতেই হবে তাও নয়। ইতিহাসের সত্য আর বাস্তবের সত্যকে তুল্যমূল্য বিচারের মানদণ্ড দাঁড় করালে কোনো লৌকিক রচনাকেই ব্যাখ্যার আওতায় আনা যাবে না। এ কারণে প্রামাণিকতার প্রসঙ্গকে জোরদার না করেই গোপাল ভাঁড়ের গল্পগুলোর সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তৈরি করা যায়।
এর বাইরে কথা বলা যায় মতাদর্শ সৃষ্টি ও উৎপাদন প্রসঙ্গে। কেননা গোপালের গল্পের ভেতর দিয়ে গোপালের সমান্তরালে কথক বা নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিও উঠে আসে। এ কারণে যুগের প্রভাবে গোপালের গল্পের নবায়নও ঘটতে পারে। তার প্রমাণ হলো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে পরিবেশিত গোপাল ভাঁড়। এখানে দেখা যাচ্ছে, কাহিনির প্রতিবেশ গড়ে উঠেছে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভাকে কেন্দ্র করে। মন্ত্রী, সেনাপতি, ভাঁড়, কবি, বিজ্ঞানী, বৈদ্য সহযোগে জ¦লজ¦ল করছে রাজসভা। চরিত্র হিসেবে এসেছে গ্রামীণ প্রতারক, ভোলা ময়রা, একদল দুষ্টু শিশু। প্রায়শই দৃশ্যায়িত হয় গোপালের পারিবারিক জীবনের খণ্ডাংশ। অদ্ভুত সব বায়না ধরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বিপদে ফেলতে চান মুর্শিদাবাদের নবাব। কৃষ্ণচন্দ্রকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় খাম্বাজ রাজা। অধিকাংশ গল্পে অ্যান্টাগনিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হন রাজমন্ত্রী। সিরিজের প্রবহমানতার কারণেই গোপালকে পাওয়া যায় জীবনের সমগ্রতাসমেত।
‘হাসির রাজা গোপাল ভাঁড়’ বইয়ের প্রচ্ছদ। সংগৃহীত ছবিগোপাল ভাঁড়ের প্রচলিত গল্পগুলোতে এরকম প্রতিবেশ, ঘটনা ও চরিত্রের নিত্য আনাগোনা নেই; এ কালে যা রচিত হচ্ছে তার সবটাই মূলত গোপালকেন্দ্রিক কল্পনার বিশদ বিস্তার। তা কখনো কখনো এতটাই একাল ঘেঁষে বর্ণিত হয় যে, গোপালকে দেখা যায় বিজ্ঞান বিষয়ে চিন্তা করতে। আঠার শতকের গল্পের চরিত্র হিসেবে গোপালের মনোজগতে পশ্চিমী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কোনো ঐতিহাসিক কারণ নেই। কিন্তু ডিজিটাল গোপাল ভাঁড়কে দেখা যায় বিজ্ঞানোচিত কাজেকর্মে অংশ গ্রহণ করতে। গোপাল ভাঁড় সিরিজের বিজ্ঞানীর কর্মকাণ্ডেও মিশে আছে পশ্চিমী বিজ্ঞান।
কখনোবা গোপালকে দেখা যায় খাঁটি দেশপ্রেমিকের ভ‚মিকায়। তাঁর হাতে মাঝেমধ্যেই নাকাল হতে হয় কোনো ব্রিটিশ সেনা অথবা কর্মকর্তাকে। ইংরেজদের মতো করে কেক বানিয়ে গোপাল সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, ক্রিকেট খেলে। গোপাল তাঁর বুদ্ধির জোরে—অবশ্যই তা কৌতুক ও হাস্য-উদ্দীপক— ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে। এতে কোনো দোষ নেই। আঠারো শতকেও নিশ্চয়ই নিজের অঞ্চল, ভূমি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, গোপাল ভাঁড় বিষয়ক গল্পের প্রচলিত সংকলনগুলোতে ব্রিটিশ বিরোধিতার কোনো গল্প পাওয়া যায় না। দেশপ্রেমের এই উপস্থাপনায় খুব সহজেই শনাক্ত করা যায় জাতীয়তাবাদের ছায়া। সংগত কারণে সংশয়াছন্ন মন জিজ্ঞেস করে ওঠে গোপালের গল্পে জাতীয়তাবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে কেন?
জাতীয়তাবাদ বিষয়ক অধিকাংশ তাত্তি¡ক একমত হবে যে, ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটেছে আরও পরে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে তো নয়—উনিশ শতকের শেষভাগে। জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক শ্রেণি হিসেবে শহুরে মধ্যবিত্তকে ঠিকঠাক মতো গড়ে উঠতে সময় লেগেছে কম করে হলেও একশো বছর। মধ্যবিত্তের আঁতুড়ঘর হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্মই হয়েছে উনিশ শতকে। আর তাই, আঠারো শতকীয় গোপাল কোত্থেকে জাতি ও জাতীয়তাবাদের ধারণা পাবে? কেনইবা গোপালের গল্পে কেন জাতিচিন্তা ও প্রতিরোধী ভাবনার সমাগম ঘটবে?
নিহিত সত্য হলো, বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তার কল্পনায় গোপালকে এভাবেই দেখতে চায়; গোপালের সময়পর্বের ইতিহাসকেও তারা ভাবতে চায় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসদৃষ্টির কাঠামোয়। বাঙালি জাতিকে তারা কল্পনা করে নেয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচিন্তার প্রশ্রয়ে। আর সেই কল্পনাকেই স্থান দেয়া হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে।
গোপাল ভাঁড়ের নবায়নের আরেকটি নমুনা দেখা যাক। এ গল্পে দেখা যাচ্ছে, চুল ন্যাড়া থাকায় দুজন নারীকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ইংরেজদের সহায়তায় গোপালের স্ত্রী নিজের চুল কেটে পরচুলা বানিয়ে মেয়ে দুটিকে কেশবতী করে তুলেছে। ওদিকে মুর্শিদাবাদের নবাব সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। মেয়ে দুটি সে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। দুজনের নতুন রূপ দেখে সবাই বিস্মিত। গোপালের বউকে দেখা যায়, নতুন কেশবিন্যাসে; চুলগুলো বিদেশি মেমদের মতো করে কাটা। চুলহীনতার কারণে অবহেলিত— এমন মেয়েদের সহায়তা করার জন্য গোপালের বউ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়।
পরোপকারকামী আপাতনিরীহ এই গল্পটিতে নারীর সৌন্দর্যের ধারণার পাশাপাশি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার ধারণাও দেওয়া হয়েছে। এ গল্পের একটি সংলাপে গোপালকে ‘নারীশক্তি’ শব্দটি প্রয়োগ করতে দেখা যায়। আঠারো শতকের গোপালের গল্পে এ ধরনের ভাবনা থাকার কোনো ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ নেই। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, পুরনো গোপালকে নিয়ে আসা হয়েছে নতুন সাংস্কৃতিক আদর্শের ভেতর, যেখানে ‘সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা’, ‘নারীশক্তি’র মতো বিষয়গুলো জায়গা পেয়েছে। আর এ সংস্কৃতি অ্যানিমেটেড গোপাল ভাঁড়ের নির্মাতা ও দর্শকদের চেনা সংস্কৃতির অংশ, যা গড়ে উঠেছে বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পৃথিবীতে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গোপালের গল্প থেমে নেই। দশকের পর দশক পেরিয়ে নবায়িত হয়েছে তার ভাব ও ভাষা। গোপালের পাঠক, শ্রোতা, দর্শক বারবার তাকে পেয়েছে সময়ানুগ চেহারায়। লৌকিক নায়কেরা সম্ভবত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এভাবেই পুনর্জন্ম লাভ করে।