leadT1ad

মানুষের মুক্তির গান যতদিন থাকবে, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ততদিন বেঁচে থাকবেন

আজ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুদিন। বাংলা গণসংগীতের ইতিহাসে যে কয়েকজন শিল্পী নতুন ধারা ও নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছেন—হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠই শুধু নন, পথিকৃৎ।

মাহমুদ নেওয়াজ জয়
মাহমুদ নেওয়াজ জয়

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ১৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

হেমাঙ্গ বিশ্বাস বাংলা গণসংগীতের এক অমর প্রতিভা। তাঁর জন্ম ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের মিরাশী গ্রামে। মৃত্যু ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর কলকাতায়। জন্মেছিলেন জমিদার হরকুমার বিশ্বাসের ঘরে। কিন্তু এই উচ্চবর্গীয় পরিবারে জন্ম তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে বাঁধতে পারেনি। বরং হেমাঙ্গ ছিলেন শোষিত ও শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির প্রশ্নে অটল। জীবনের শুরু থেকেই তাঁর পথ ছিল সংগ্রামী, বিপ্লবী এবং মানবপ্রেমী।

শৈশব থেকেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস গান আর কবিতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার পথে মাঠের হাওয়ায় গান গাইতেন, কৃষকরা তাঁর গান শুনে আনন্দিত হতেন। তাঁর মা সরোজিনী বিশ্বাস তবলা বাজাতে পারতেন এবং কিছুটা গানও জানতেন। তাই মায়ের হাত ধরেই হেমাঙ্গের কবিতা ও সংগীতচর্চার সূচনা। এরপর কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা পেয়েছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের কাছ থেকে। এর বাইরে নিজে নিজেই চর্চা করতেন।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সংগৃহীত ছবি
হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সংগৃহীত ছবি

কলেজ জীবনেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের রাজনৈতিক সচেতনতা জেগে ওঠে। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তিনি একাধিকবার কারাভোগ করেন। ১৯৩২ সালে দীর্ঘ তিন বছর যক্ষ্মা আক্রান্ত অবস্থায় জেলে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। জেলে ইংরেজদের নানা প্রস্তব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এই সময়ে কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি তিনি আস্থা হারান এবং মার্কসবাদী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন।

এরপর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংগীতচর্চা রূপ নিলো মানুষের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলনে। গণসংগীত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যুদ্ধাস্ত্র। তাঁর বিখ্যাত গান ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে’ শ্রমিক ও কৃষকের প্রতিরোধের প্রতীক। ফসল কাটার সময় ধান কেটে দস্যুর বিরুদ্ধে লড়ার আহ্বান, গানটিতে যে শক্তি আছে, তা শ্রোতার আত্মার গভীরে ঢুকে যায়।

চল্লিশের দশকের তেভাগা আন্দোলন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংগীতকর্মের এক অন্যতম মাইলফলক। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ক্ষোভকে তিনি গানে রূপ দেন। তাঁর কণ্ঠে গান হয়ে উঠে আন্দোলনের তলোয়ার। হেমাঙ্গ বিশ্বাস কখনো একা লড়তে চাননি; যাদের জন্য লড়াই, তাঁদের সঙ্গেই তিনি সংগ্রামে সামিল ছিলেন। তাঁর বিপ্লবী চেতনা এতই দৃঢ় ছিল যে বুর্জোয়া সমাজের প্রথা ও প্রভাব কখনো তাঁকে দমাতে পারেনি।

এরপর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংগীতচর্চা রূপ নিলো মানুষের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলনে। গণসংগীত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যুদ্ধাস্ত্র। তাঁর বিখ্যাত গান ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে’ শ্রমিক ও কৃষকের প্রতিরোধের প্রতীক।

১৯৪২ সালে সিলেটে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গঠন করেন ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’। গানের মাধ্যমে শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে সচেতনতা জাগানোর এই উদ্যোগ সিলেট ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন। এই সময়ে তিনি তাঁর বিখ্যাত গান ‘সুরমা নদীর গাঙচিল’ রচনা করেন। এটি নদী, প্রকৃতি, মানুষের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে একত্রিত করে একটি অদ্বিতীয় শিল্পকর্মে রূপ নেয়।

১৯৪৬ সালে আসামে গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরপর তিনবার একই পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি সংগীত ও আন্দোলনকে একত্রিত করেন। তখন তিনি লেখেন ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য’—একটি ব্যঙ্গাত্মক গান যা দেশজুড়ে সাড়া ফেলে। শোষণ, ভন্ডামি, জুলুম—যেখানে যেখানে তাঁর চোখ পড়ে, সেখানেই তাঁর গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদের শক্তিশালী অস্ত্র।

১৯৫১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস আবার গ্রেফতার হন। অসুস্থতার কারণে মুক্তিও পান। ১৯৫৭ সালে তাঁকে চিকিৎসার জন্য চীনে পাঠানো হয়। তিন বছর চীনে কাটিয়ে তিনি সেখানকার স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হন। সে সময় রচনা করেন ‘আমি যে দেখেছি সেই দেশ’। পরে ১৯৬১ সালে কলকাতার সোভিয়েত কনস্যুলেটে চাকরি নেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভাজনের কারণে ১৯৭৪ সালে চাকরি ছাড়তে হয়। ১৯৬৯ সালে নকশাল আন্দোলনের প্রতি তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন দেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ‘মাস সিঙ্গারস’ নামের সংগীত দল নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও আন্দোলনের চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সংগৃহীত ছবি
হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সংগৃহীত ছবি

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শঙ্খচিলের গান’ যুদ্ধবিরোধী মানবিক গান হিসেবে পরিচিত। আমেরিকার ভিয়েতনাম আক্রমণের প্রতিবাদে তিনি ১৯৬৪ সালে গানটি রচনা করেন। এটি বাংলা ভাষার এক ব্যতিক্রমধর্মী সৃষ্টি।

চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশক, তাঁর সংগীতচর্চা সবসময় সংগ্রামী, বিপ্লবী ও মানবিক ছিল। ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’, ‘জন হেনরী’, ‘আমরা করবো জয়’, ‘সুরমা নদীর গাঙচিল’, ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য’, 'জাগো সর্বহারা অনশনবন্দী কৃতদাস', 'আমি যে দেখেছি সেই দেশ', ‘শঙ্খচিলের গান’—এই সব গান শুধু কণ্ঠ নয়, ইতিহাস ও সংগ্রামের স্বর শোনার জন্য তৈরি এক জীবন্ত দলিল। এসব গান মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, সাহস দেয়, আন্দোলনের পথে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত