এস এম সুলতান: একশ বছর পেরিয়ে
আজ ১০ আগষ্ট। কিংবদন্তি চিত্রকর এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মদিন। গ্রামবাংলার মাটি থেকে উঠে এসে কীভাবে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছালেন তিনি? স্বাধীন বাংলাদেশে এ চিত্রকর কি আদৃত হয়েছিলেন? সুলতানের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন, নন্দনতত্ত্ব, শিশুপ্রেমসহ এ লেখায় উঠে এসেছে এমন এক শিল্পীর অবয়ব, যিনি আমাদের চেনা হয়েও অচেনা।
মোহাম্মদ গোলাম রববানী
সৃজনশীলতার অভাব, রুচিবোধের সংকট এবং বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অনাগ্রহ ক্রমাগতভাবে আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাজনীতিকে গ্রাস করছে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়েও যে এর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, তা গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গত এক বছরে নির্মমভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এই মনস্তাত্ত্বিক অনগ্রসরতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এই মনস্তাত্ত্বিক অনগ্রসরতার পেছনের কারণ যা-ই হোক, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া এ অবস্থা থেকে যে উত্তরণ সম্ভব নয়, তা সহজেই অনুমেয়। এই বাস্তবতায় দেশের চারুকলা আন্দোলনের পথিকৃত, বহুমূখী মেধার অধিকারী শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের (এস এম সুলতান) জীবন দর্শন ও নন্দনতত্ব আমাদের জীবনে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সুলতান তাঁর শিল্পকলায় আজীবন শিকড়ের সন্ধান করেছেন এবং তার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিল্পকলার বুনিয়াদ গড়ে দিয়ে গেছেন। আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ তথা নিজেদের সত্তাকে টিকিয়ে রাখার কৌশল সুলতানের গণমুখী নন্দনতত্ত্বে প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর মতে, শিল্পকলার শিক্ষা ব্যক্তির রুচিবোধ জাগিয়ে তোলে, ব্যক্তির মননকে করে প্রগতিশীল। শিল্পকলাকে অবহেলা করে কোনো জাতিই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। এসব কারণেই আমাদের সময়ের জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এস এম সুলতানের নন্দনতত্ত্ব গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
বাল্যকালে এস এম সুলতানের ডাক নাম ছিল লাল মিয়া। তিনি ১৯২৪ সালে নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মেসের ছিলেন পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। ১৯২৮ সালে লাল মিয়া নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার সময়ই তিনি রাজমিস্ত্রি পিতার সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পিতার ইমারত নির্মাণের কারুকাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শুরু করেন আঁকাআঁকি। স্কুলের অঙ্কনের শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক, যিনি তাঁকে ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতেন। নড়াইল জমিদার বাড়ির ছেলে ধীরেন্দ্র নাথ রায়ও তাঁকে উৎসাহ দিতেন। আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ভিক্টোরিয়া স্কুল পরিদর্শনকালে ১০ বছর বয়সী লাল মিয়া ডা. শ্যামাপ্রসাদের পেন্সিল স্কেচ করেন, যা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই পেন্সিল স্কেচ আঁকার মধ্যে দিয়েই সুলতানের শিল্পী সত্তা প্রকাশ পায়।
শিল্পানুরাগী জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় ১৯৩৮ সালে সুলতানকে কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সুলতান প্রায় তিন বছর সেখানে ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু আর্ট কলেজের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি। তাই সুলতান আর্ট কলেজ ছেড়ে বিশ্ব পাঠশালার ছাত্র হয়ে এক যাযাবর জীবন বেছে নিলেন। খালি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। পথে-ঘাটে মানুষের ছবি এঁকে সামান্য টাকা রোজগার করেই মেটাতেন যাযাবর জীবনের ব্যয়। তাঁর এই যাত্রাপথে তিনি নিদারুণ কষ্টকে যেমন আলিঙ্গন করেছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন রাজকীয় আতিথিয়েতাও। সৃষ্টির ক্ষুধায় তাড়িত সেই যাযাবর জীবনের মধ্যে দিয়েই একদিন তিনি এস এম সুলতান হয়ে ওঠেন। চিত্রকলার জগতে গড়ে তোলেন আপন সালতানাত।
১৯৪৩ সালে কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে নীলাচল, জগন্নাথের রথ, আগ্রার তাজমহল, আজমীর শরীফ, লক্ষ্ণৌ, হরিয়ানা, মিসৌরী, দেরাদুন ও সিমলা ভ্রমণের পর তিনি পৌঁছান কাশ্মিরে। সিমলায় তিনি ছিলেন কাপুরতলার মহারাজার ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে। ১৯৪৬ সালে সুলতানের চিত্রকর্মের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল সিমলাতেই, যার উদ্বোধন করেছিলেন কাপুরতলার মহারাজা। সুলতান চাইলেই সেখানে একটি আয়েশী জীবন গড়তে পারতেন। কিন্তু সে পথ তিনি মাড়াননি।
বাল্যকালে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুটি কবিতায় কাশ্মিরের মানুষদের সংগ্রামের বিষয়ে জানার পর থেকেই কাশ্মিরের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তাই ১৯৪৬ সালে তিনি সিমলা থেকে কাশ্মিরে পাড়ি জমান। কাশ্মিরে অবস্থানকালে সুলতান নিসর্গের ছবি আঁকায় ডুবেছিলেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে সুলতান শ্রীনগর থেকে একটি শরণার্থীবাহী ট্রাকে উঠে লাহোরে পৌঁছান। কাশ্মিরে থাকাকালীন সময়ে তিনি যত নিসর্গের ছবি এঁকেছিলেন, দেশভাগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতিতে তার কিছুই তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে কাশ্মিরে আঁকা সুলতানের নিসর্গের ছবিগুলো আমাদের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে যায়। সেই ছবিগুলো খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি!
এস এম সুলতান লাহোরে পৌঁছে সে সময়ের প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এস আমজাদ আলীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আমজাদ আলী অতি অল্প সময়েই সুলতানের প্রতিভা বুঝতে পেরে আবদুর রহমান চুগতাইসহ পাকিস্তানের প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক করিয়ে দেন। আমজাদ আলী ও আবদুর রহমান চুগতাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সুলতানের চিত্রকর্মের একক প্রদর্শনী হয়, যার উদ্বোধন করেছিলেন ফিরোজ খান নূন (যিনি পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। লাহোর থেকে সুলতান চলে যান করাচিতে। সেখানে এস আমজাদ আলী, আবদুর রহমান চুগতাই ও শাকির আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯ সালে তাঁর আরেকটি একক প্রদর্শনী হয়। এভাবে তিনি পাকিস্তানে খ্যাতি অর্জন করেন।
‘…আমি চাই সব শিশু পেট পুরে দুধভাত খাবে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশু হবে। ওরা প্রাণ খুলে গাইবে, ছবি আঁকবে, খেলবে...আমার স্বপ্নের সাধ এই শিশু স্বর্গ। এখানে আসবে সব দেবশিশুরা। যারা নিষ্পাপ, যারা সুন্দর, যারা সত্যিকারের ছবির মতো।’ এস এম সুলতান, চিত্রশিল্পী
১৯৫০ সালে, এস এম সুলতান পাকিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ২৫টি দেশের শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তিনি প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সে বছরই তিনি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে আয়োজিত গ্রুপ প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসো, সালভাদর ডালি, জন ব্রাক, পল ক্লী প্রমূখ বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডে তাঁর মোট চারটি প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৮১ সালে জাপানের ফুফুওয়াকা মিউজিয়াম আয়োজিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম স্থান পায়। ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল।
নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে কলকাতা আর্ট কলেজ হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থান পাকিস্তানের লাহোর, করাচি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত চিত্রকলার বিশ্বমঞ্চ পর্যন্ত সুলতানের এক যুগের যাযাবর জীবনটা যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখব অজানার পথে পাড়ি জমানোর ইচ্ছাশক্তিটাই ছিল তাঁর মূল পুঁজি। উনিশ শতকের পৃথিবী কাঁপানো দার্শনিক ফ্রেডারিক নিৎসের ‘উইল টু পাওয়ার’ অর্থাৎ ক্ষমতার ইচ্ছা বা ইচ্ছাশক্তি তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে তিনি যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই জয় করেছেন।
চিত্রকলার বিশ্বমঞ্চ কাঁপানোর পর এক ঝটকায় সবকিছু ফেলে ১৯৫৩ সালে সুলতান ফিরে এলেন স্বদেশভূমিতে। কিন্তু বিশ্বব্যপী সমাদৃত সুলতান দেশের মাটিতে এসে সমাদর পাননি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এদেশে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। এই সময় তাঁর তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। অল্প কিছু গুণী মানুষ তাঁকে চিনতেন, যেমন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কবি জসীম উদ্দীন। দীর্ঘ সময় তিনি ঢাকায় থেকেছেন। এই শহরে তিনি তাঁর ক্যানভাসের আলো ছড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু এখানে তাঁর জায়গা হয়নি। এমনকি ১৯৫৬ সালে বর্ধমান হাউজে গোটা পাকিস্তানের চিত্রশিল্পীদের যে প্রদর্শনী হয়েছিল, সুলতানের চিত্রকর্ম সেখানে স্থান পায়নি। তবে তিনি তাঁর বিচিত্র বেশভূষা, ভবঘুরে জীবন এবং ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সহজ ও সাধারণ মাধ্যমের ব্যবহার ইত্যাদি দিয়ে সবার কৌতূহলের পাত্র হতে পেরেছিলেন। এখনো তিনি কৌতূহলের পাত্র হয়ে আছেন এবং থাকবেনও।
বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, খুলনায়। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকাস্থ জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। অবশেষে চারুকলায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছিল। ১৯৮৫ সালে তাঁকে দেওয়া হয় চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা। ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এ শিল্পী।
কৃষি-সংস্কৃতি পৃথিবীর আদিম সংস্কৃতি, যার মাধ্যমেই সভ্যতার সূত্রপাত। আর কৃষি সংস্কৃতির আরেক নাম মাটি ও মানুষের উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক, যা ছিল সুলতানের ক্যানভাসের মৌলিক বিষয়। মাটি ও মানুষের উৎপাদনশীলতার সেই ধ্রুপদি সম্পর্ক তিনি এত নিখুঁত ও গতিশীলভাবে এঁকেছেন যে তাঁর প্রতিটি চিত্রকর্মই যেন চলমান দৃশ্য বা প্রবাহমান গল্প। বাংলার কিষাণ-কিষাণীদের স্ফিত পেশিসমেত সুডৌল ফিগারগুলোর মাধ্যমে তিনি তাদের প্রবল উৎপাদনশীলতা ও পালন ক্ষমতাই ফুটিয়ে তুলেছেন। এ শিল্পীর ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ থেকে শুরু করে বাংলার কিষাণ-কিষাণীর প্রতিটি ফিগারই যেন মাটি থেকে উৎসারিত, মাটির রং ও গন্ধযুক্ত। তাঁর ক্যাসভাসের প্রতিটি ফিগারই যেন একটি একটি অপরাজিত সত্তা। কারণ, জীবনমুখী সুলতান তাঁর স্বপ্নের সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন নিজের ক্যানভাসের পাত্রপাত্রীদের মাধ্যমে। তাই তিনি বাংলার কিষাণ-কিষাণীদেরকে পাত্রপাত্রী বানিয়ে ক্যানভাসে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। বিমূর্ত চিত্রকলায় আস্থা ছিল না তাঁর। তাঁর মতে, ছবির ভাষা যদি দর্শক সহজে বুঝতে না পারে, তবে তা দুর্বোধ্য সৃষ্টি।
সুলতান ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত নিসর্গ-প্রেমিক শিল্পী। নিসর্গ-প্রেম তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি তাঁর নিসর্গের ছবির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, চোখ মেলে যা দেখা যাবে তাই আঁকতে হবে, এমন নয়। অনুভূতিতে সেটাকে কেমন দেখাল, তাই আঁকতে হবে। দেখাটাই আসল। এভাবে তিনি তাঁর কাছে শিখতে আসা শিশু শিল্পীদেরকে দিয়ে নিসর্গকে অনুভব করাতে চেয়েছেন। তিনি বলতেন, মানুষ যদি সুন্দরকে না দেখে, তবে সে কীভাবে বুঝবে যে সে কত অসুন্দরভাবে বেঁচে আছে? এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের নন্দনত্ত্ব সম্পর্কে কবি জসীম উদ্দীন বলেন, ‘সুলতানের ছবিতে যে অপূর্ব বর্ণসমাবেশের পরিচয় পাইলাম তাহা ভুলিবার নয়। নানা দুঃখ-কষ্ট অভাবের মধ্য দিয়া সুলতানকে চলিতে হইয়াছে। কিন্তু তাহার ছবিতে সেই দুঃখ-কষ্টের এতটুকুও ছাপ নাই। নানা অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে থাকিয়াও এই বীর শিল্পী তাঁর স্বপ্নালু জগতটিকে অটুট রাখিয়াছেন। তাঁর ছবিগুলি দেখিয়া দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত লোকগুলি যদি ক্ষণেকের জন্যও তাঁর স্বপ্ন জগতের এতটুকু স্বাদ পায় তাই কি শিল্পীর পক্ষে কম কৃতিত্ব।’
এস এম সুলতানের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিশুরা। তিনি শিশুদের সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। শিশুদের তিনি তাঁর ছবির মতো হৃষ্টপুষ্ট দেখতে চেয়েছেন। নড়াইলে প্রত্যাবর্তন করার পর সেখানে তিনি শিশুদের জন্য ‘নন্দন কানন প্রাইমারি স্কুল’, ‘নন্দন কানন হাই স্কুল’ ও ‘নন্দন কানন ফাইন আর্টস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নড়াইল সদরে, ‘কুড়িগ্রাম ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউট’ (চারুপীঠ) প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের বিকাশের জন্য ১৯৯০ সালে নড়াইলের নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন ‘শিশু স্বর্গ’। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে শিশুরা দুবেলা খেতে পায় না, যারা ন্যাংটো থাকে, পরার কাপড় নেই, উদোম গায়ে থাকে, যাদের পাঁজরের হাড়গুলো গুণে নেওয়া যায়, তাদের নিয়ে আমি শুরু করেছিলাম এই শিশু স্বর্গ। ওদের দেখে আমি ছবি আঁকা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তখন ভালো ছবি আঁকতে পারতাম না। আমার তুলিতে এই হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার শিশুগুলির ছবি ভাসত...আমি চাই সব শিশু পেট পুরে দুধভাত খাবে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশু হবে। ওরা প্রাণ খুলে গাইবে, ছবি আঁকবে, খেলবে...আমার স্বপ্নের সাধ এই শিশু স্বর্গ। এখানে আসবে সব দেবশিশুরা। যারা নিষ্পাপ, যারা সুন্দর, যারা সত্যিকারের ছবির মতো।’
শিশুশিক্ষার অংশ হিসেবে সুলতান শিশুদের নিসর্গের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য অনেক কষ্ট করে অর্থ সংগ্রহ করে শিশুদের জন্য গড়েছিলেন একটি বড় নৌকা। শিশুদের তিনি সেই নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে যেতেন প্রকৃতির কাছে, নিসর্গ দেখাতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নন্দনতত্ত্ব শিশুদের মানবিক গুনাবলী অর্জনে সাহায্য করে।
কোনো কোনো শিল্প সমালোচক এস এম সুলতানের মধ্যে পাবলো পিকাসো ও ভিনসেন্ট গগকে দেখতে পেয়েছেন। প্রকৃত বিচারে সুলতানের তুলনা সুলতান নিজেই। বাংলার মাটি-জল ও কিষাণ-কিষাণীর প্রতি গভীর মমতায় তিনি তাঁর ক্যানভাসে একটি চিত্র বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। বিশ্ব জয় করে অবশেষে তিনি নড়াইলে ফরে আসেন। সেখানকার গ্রামীণ নিসর্গের মধ্যে সৃজনশীল পেশিবহুল কিষাণ-কিষাণীর মধ্যে, জাত-পাতহীন ভালোবাসার মধ্যে তিনি যেন নির্বাণ লাভ করেছিলেন। তাঁর কাজ শুধু ক্যানভাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। নিসর্গপ্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি জীবনভর তাড়িত হয়েছেন।
সুলতানের জীবন দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে পারে। এসব বিচারে, শিল্পে, শিক্ষায়, জীবনবোধ ও নান্দনিকতায় আমাদের সময়ের জন্য শুধু নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এস এম সুলতানের ছবির দর্শন বা নন্দনতত্ত্ব গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক
সৃজনশীলতার অভাব, রুচিবোধের সংকট এবং বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অনাগ্রহ ক্রমাগতভাবে আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাজনীতিকে গ্রাস করছে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়েও যে এর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, তা গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গত এক বছরে নির্মমভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এই মনস্তাত্ত্বিক অনগ্রসরতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এই মনস্তাত্ত্বিক অনগ্রসরতার পেছনের কারণ যা-ই হোক, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া এ অবস্থা থেকে যে উত্তরণ সম্ভব নয়, তা সহজেই অনুমেয়। এই বাস্তবতায় দেশের চারুকলা আন্দোলনের পথিকৃত, বহুমূখী মেধার অধিকারী শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের (এস এম সুলতান) জীবন দর্শন ও নন্দনতত্ব আমাদের জীবনে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, সুলতান তাঁর শিল্পকলায় আজীবন শিকড়ের সন্ধান করেছেন এবং তার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিল্পকলার বুনিয়াদ গড়ে দিয়ে গেছেন। আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ তথা নিজেদের সত্তাকে টিকিয়ে রাখার কৌশল সুলতানের গণমুখী নন্দনতত্ত্বে প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর মতে, শিল্পকলার শিক্ষা ব্যক্তির রুচিবোধ জাগিয়ে তোলে, ব্যক্তির মননকে করে প্রগতিশীল। শিল্পকলাকে অবহেলা করে কোনো জাতিই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। এসব কারণেই আমাদের সময়ের জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এস এম সুলতানের নন্দনতত্ত্ব গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
বাল্যকালে এস এম সুলতানের ডাক নাম ছিল লাল মিয়া। তিনি ১৯২৪ সালে নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মেসের ছিলেন পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। ১৯২৮ সালে লাল মিয়া নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার সময়ই তিনি রাজমিস্ত্রি পিতার সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পিতার ইমারত নির্মাণের কারুকাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শুরু করেন আঁকাআঁকি। স্কুলের অঙ্কনের শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক, যিনি তাঁকে ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতেন। নড়াইল জমিদার বাড়ির ছেলে ধীরেন্দ্র নাথ রায়ও তাঁকে উৎসাহ দিতেন। আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ভিক্টোরিয়া স্কুল পরিদর্শনকালে ১০ বছর বয়সী লাল মিয়া ডা. শ্যামাপ্রসাদের পেন্সিল স্কেচ করেন, যা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই পেন্সিল স্কেচ আঁকার মধ্যে দিয়েই সুলতানের শিল্পী সত্তা প্রকাশ পায়।
শিল্পানুরাগী জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় ১৯৩৮ সালে সুলতানকে কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সুলতান প্রায় তিন বছর সেখানে ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু আর্ট কলেজের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি। তাই সুলতান আর্ট কলেজ ছেড়ে বিশ্ব পাঠশালার ছাত্র হয়ে এক যাযাবর জীবন বেছে নিলেন। খালি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। পথে-ঘাটে মানুষের ছবি এঁকে সামান্য টাকা রোজগার করেই মেটাতেন যাযাবর জীবনের ব্যয়। তাঁর এই যাত্রাপথে তিনি নিদারুণ কষ্টকে যেমন আলিঙ্গন করেছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন রাজকীয় আতিথিয়েতাও। সৃষ্টির ক্ষুধায় তাড়িত সেই যাযাবর জীবনের মধ্যে দিয়েই একদিন তিনি এস এম সুলতান হয়ে ওঠেন। চিত্রকলার জগতে গড়ে তোলেন আপন সালতানাত।
১৯৪৩ সালে কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে নীলাচল, জগন্নাথের রথ, আগ্রার তাজমহল, আজমীর শরীফ, লক্ষ্ণৌ, হরিয়ানা, মিসৌরী, দেরাদুন ও সিমলা ভ্রমণের পর তিনি পৌঁছান কাশ্মিরে। সিমলায় তিনি ছিলেন কাপুরতলার মহারাজার ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে। ১৯৪৬ সালে সুলতানের চিত্রকর্মের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল সিমলাতেই, যার উদ্বোধন করেছিলেন কাপুরতলার মহারাজা। সুলতান চাইলেই সেখানে একটি আয়েশী জীবন গড়তে পারতেন। কিন্তু সে পথ তিনি মাড়াননি।
বাল্যকালে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুটি কবিতায় কাশ্মিরের মানুষদের সংগ্রামের বিষয়ে জানার পর থেকেই কাশ্মিরের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তাই ১৯৪৬ সালে তিনি সিমলা থেকে কাশ্মিরে পাড়ি জমান। কাশ্মিরে অবস্থানকালে সুলতান নিসর্গের ছবি আঁকায় ডুবেছিলেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে সুলতান শ্রীনগর থেকে একটি শরণার্থীবাহী ট্রাকে উঠে লাহোরে পৌঁছান। কাশ্মিরে থাকাকালীন সময়ে তিনি যত নিসর্গের ছবি এঁকেছিলেন, দেশভাগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতিতে তার কিছুই তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে কাশ্মিরে আঁকা সুলতানের নিসর্গের ছবিগুলো আমাদের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে যায়। সেই ছবিগুলো খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি!
এস এম সুলতান লাহোরে পৌঁছে সে সময়ের প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এস আমজাদ আলীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আমজাদ আলী অতি অল্প সময়েই সুলতানের প্রতিভা বুঝতে পেরে আবদুর রহমান চুগতাইসহ পাকিস্তানের প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক করিয়ে দেন। আমজাদ আলী ও আবদুর রহমান চুগতাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সুলতানের চিত্রকর্মের একক প্রদর্শনী হয়, যার উদ্বোধন করেছিলেন ফিরোজ খান নূন (যিনি পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। লাহোর থেকে সুলতান চলে যান করাচিতে। সেখানে এস আমজাদ আলী, আবদুর রহমান চুগতাই ও শাকির আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৯ সালে তাঁর আরেকটি একক প্রদর্শনী হয়। এভাবে তিনি পাকিস্তানে খ্যাতি অর্জন করেন।
‘…আমি চাই সব শিশু পেট পুরে দুধভাত খাবে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশু হবে। ওরা প্রাণ খুলে গাইবে, ছবি আঁকবে, খেলবে...আমার স্বপ্নের সাধ এই শিশু স্বর্গ। এখানে আসবে সব দেবশিশুরা। যারা নিষ্পাপ, যারা সুন্দর, যারা সত্যিকারের ছবির মতো।’ এস এম সুলতান, চিত্রশিল্পী
১৯৫০ সালে, এস এম সুলতান পাকিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ২৫টি দেশের শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তিনি প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সে বছরই তিনি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে আয়োজিত গ্রুপ প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসো, সালভাদর ডালি, জন ব্রাক, পল ক্লী প্রমূখ বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডে তাঁর মোট চারটি প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৮১ সালে জাপানের ফুফুওয়াকা মিউজিয়াম আয়োজিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম স্থান পায়। ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল।
নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে কলকাতা আর্ট কলেজ হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থান পাকিস্তানের লাহোর, করাচি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত চিত্রকলার বিশ্বমঞ্চ পর্যন্ত সুলতানের এক যুগের যাযাবর জীবনটা যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখব অজানার পথে পাড়ি জমানোর ইচ্ছাশক্তিটাই ছিল তাঁর মূল পুঁজি। উনিশ শতকের পৃথিবী কাঁপানো দার্শনিক ফ্রেডারিক নিৎসের ‘উইল টু পাওয়ার’ অর্থাৎ ক্ষমতার ইচ্ছা বা ইচ্ছাশক্তি তাঁর জীবনে গভীরভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়ে তিনি যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই জয় করেছেন।
চিত্রকলার বিশ্বমঞ্চ কাঁপানোর পর এক ঝটকায় সবকিছু ফেলে ১৯৫৩ সালে সুলতান ফিরে এলেন স্বদেশভূমিতে। কিন্তু বিশ্বব্যপী সমাদৃত সুলতান দেশের মাটিতে এসে সমাদর পাননি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এদেশে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। এই সময় তাঁর তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। অল্প কিছু গুণী মানুষ তাঁকে চিনতেন, যেমন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কবি জসীম উদ্দীন। দীর্ঘ সময় তিনি ঢাকায় থেকেছেন। এই শহরে তিনি তাঁর ক্যানভাসের আলো ছড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু এখানে তাঁর জায়গা হয়নি। এমনকি ১৯৫৬ সালে বর্ধমান হাউজে গোটা পাকিস্তানের চিত্রশিল্পীদের যে প্রদর্শনী হয়েছিল, সুলতানের চিত্রকর্ম সেখানে স্থান পায়নি। তবে তিনি তাঁর বিচিত্র বেশভূষা, ভবঘুরে জীবন এবং ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সহজ ও সাধারণ মাধ্যমের ব্যবহার ইত্যাদি দিয়ে সবার কৌতূহলের পাত্র হতে পেরেছিলেন। এখনো তিনি কৌতূহলের পাত্র হয়ে আছেন এবং থাকবেনও।
বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, খুলনায়। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকাস্থ জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। অবশেষে চারুকলায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছিল। ১৯৮৫ সালে তাঁকে দেওয়া হয় চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা। ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এ শিল্পী।
কৃষি-সংস্কৃতি পৃথিবীর আদিম সংস্কৃতি, যার মাধ্যমেই সভ্যতার সূত্রপাত। আর কৃষি সংস্কৃতির আরেক নাম মাটি ও মানুষের উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক, যা ছিল সুলতানের ক্যানভাসের মৌলিক বিষয়। মাটি ও মানুষের উৎপাদনশীলতার সেই ধ্রুপদি সম্পর্ক তিনি এত নিখুঁত ও গতিশীলভাবে এঁকেছেন যে তাঁর প্রতিটি চিত্রকর্মই যেন চলমান দৃশ্য বা প্রবাহমান গল্প। বাংলার কিষাণ-কিষাণীদের স্ফিত পেশিসমেত সুডৌল ফিগারগুলোর মাধ্যমে তিনি তাদের প্রবল উৎপাদনশীলতা ও পালন ক্ষমতাই ফুটিয়ে তুলেছেন। এ শিল্পীর ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ থেকে শুরু করে বাংলার কিষাণ-কিষাণীর প্রতিটি ফিগারই যেন মাটি থেকে উৎসারিত, মাটির রং ও গন্ধযুক্ত। তাঁর ক্যাসভাসের প্রতিটি ফিগারই যেন একটি একটি অপরাজিত সত্তা। কারণ, জীবনমুখী সুলতান তাঁর স্বপ্নের সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন নিজের ক্যানভাসের পাত্রপাত্রীদের মাধ্যমে। তাই তিনি বাংলার কিষাণ-কিষাণীদেরকে পাত্রপাত্রী বানিয়ে ক্যানভাসে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। বিমূর্ত চিত্রকলায় আস্থা ছিল না তাঁর। তাঁর মতে, ছবির ভাষা যদি দর্শক সহজে বুঝতে না পারে, তবে তা দুর্বোধ্য সৃষ্টি।
সুলতান ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত নিসর্গ-প্রেমিক শিল্পী। নিসর্গ-প্রেম তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি তাঁর নিসর্গের ছবির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, চোখ মেলে যা দেখা যাবে তাই আঁকতে হবে, এমন নয়। অনুভূতিতে সেটাকে কেমন দেখাল, তাই আঁকতে হবে। দেখাটাই আসল। এভাবে তিনি তাঁর কাছে শিখতে আসা শিশু শিল্পীদেরকে দিয়ে নিসর্গকে অনুভব করাতে চেয়েছেন। তিনি বলতেন, মানুষ যদি সুন্দরকে না দেখে, তবে সে কীভাবে বুঝবে যে সে কত অসুন্দরভাবে বেঁচে আছে? এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের নন্দনত্ত্ব সম্পর্কে কবি জসীম উদ্দীন বলেন, ‘সুলতানের ছবিতে যে অপূর্ব বর্ণসমাবেশের পরিচয় পাইলাম তাহা ভুলিবার নয়। নানা দুঃখ-কষ্ট অভাবের মধ্য দিয়া সুলতানকে চলিতে হইয়াছে। কিন্তু তাহার ছবিতে সেই দুঃখ-কষ্টের এতটুকুও ছাপ নাই। নানা অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে থাকিয়াও এই বীর শিল্পী তাঁর স্বপ্নালু জগতটিকে অটুট রাখিয়াছেন। তাঁর ছবিগুলি দেখিয়া দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত লোকগুলি যদি ক্ষণেকের জন্যও তাঁর স্বপ্ন জগতের এতটুকু স্বাদ পায় তাই কি শিল্পীর পক্ষে কম কৃতিত্ব।’
এস এম সুলতানের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিশুরা। তিনি শিশুদের সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। শিশুদের তিনি তাঁর ছবির মতো হৃষ্টপুষ্ট দেখতে চেয়েছেন। নড়াইলে প্রত্যাবর্তন করার পর সেখানে তিনি শিশুদের জন্য ‘নন্দন কানন প্রাইমারি স্কুল’, ‘নন্দন কানন হাই স্কুল’ ও ‘নন্দন কানন ফাইন আর্টস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নড়াইল সদরে, ‘কুড়িগ্রাম ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউট’ (চারুপীঠ) প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের বিকাশের জন্য ১৯৯০ সালে নড়াইলের নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন ‘শিশু স্বর্গ’। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যে শিশুরা দুবেলা খেতে পায় না, যারা ন্যাংটো থাকে, পরার কাপড় নেই, উদোম গায়ে থাকে, যাদের পাঁজরের হাড়গুলো গুণে নেওয়া যায়, তাদের নিয়ে আমি শুরু করেছিলাম এই শিশু স্বর্গ। ওদের দেখে আমি ছবি আঁকা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তখন ভালো ছবি আঁকতে পারতাম না। আমার তুলিতে এই হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার শিশুগুলির ছবি ভাসত...আমি চাই সব শিশু পেট পুরে দুধভাত খাবে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশু হবে। ওরা প্রাণ খুলে গাইবে, ছবি আঁকবে, খেলবে...আমার স্বপ্নের সাধ এই শিশু স্বর্গ। এখানে আসবে সব দেবশিশুরা। যারা নিষ্পাপ, যারা সুন্দর, যারা সত্যিকারের ছবির মতো।’
শিশুশিক্ষার অংশ হিসেবে সুলতান শিশুদের নিসর্গের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্য অনেক কষ্ট করে অর্থ সংগ্রহ করে শিশুদের জন্য গড়েছিলেন একটি বড় নৌকা। শিশুদের তিনি সেই নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে যেতেন প্রকৃতির কাছে, নিসর্গ দেখাতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নন্দনতত্ত্ব শিশুদের মানবিক গুনাবলী অর্জনে সাহায্য করে।
কোনো কোনো শিল্প সমালোচক এস এম সুলতানের মধ্যে পাবলো পিকাসো ও ভিনসেন্ট গগকে দেখতে পেয়েছেন। প্রকৃত বিচারে সুলতানের তুলনা সুলতান নিজেই। বাংলার মাটি-জল ও কিষাণ-কিষাণীর প্রতি গভীর মমতায় তিনি তাঁর ক্যানভাসে একটি চিত্র বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। বিশ্ব জয় করে অবশেষে তিনি নড়াইলে ফরে আসেন। সেখানকার গ্রামীণ নিসর্গের মধ্যে সৃজনশীল পেশিবহুল কিষাণ-কিষাণীর মধ্যে, জাত-পাতহীন ভালোবাসার মধ্যে তিনি যেন নির্বাণ লাভ করেছিলেন। তাঁর কাজ শুধু ক্যানভাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। নিসর্গপ্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি জীবনভর তাড়িত হয়েছেন।
সুলতানের জীবন দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে পারে। এসব বিচারে, শিল্পে, শিক্ষায়, জীবনবোধ ও নান্দনিকতায় আমাদের সময়ের জন্য শুধু নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এস এম সুলতানের ছবির দর্শন বা নন্দনতত্ত্ব গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান সারা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ। ছাত্র-জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা দাবি। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পেছনে কোনো সুসংগঠিত পরিকল্পনা ছিল কি?
৫ ঘণ্টা আগেমোদির সাথে রিলেট করব, কোনোদিন ভাবি নাই। একজন জেনজি হিসেবে মোদি ট্রাম্পের থেকে যে দাগা খাইল, তার জন্য গভীর সিম্প্যাথি বোধ করলাম। এই রকম সিচুয়েশনে বা ‘সিচুয়েশনশিপ’-এ বেঈমানির শিকার আমরা রেগুলার হই।
৬ ঘণ্টা আগেআমার প্রিয় গায়ক আসিফ একটা সাবধানী পোস্ট দিছেন ফেসবুকে। পোস্ট দেইখা আমি হাসতে হাসতে শেষ। দেইখা মনে হইলো, মুরুব্বি, মুরুব্বি উঁহু হু হু!
৭ ঘণ্টা আগেআহমদ ছফা ‘বাংলার চিত্রঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’ প্রবন্ধে সুলতানের চিত্রকলা নিয়ে লিখেছিলেন, ‘তারপর কোনোরকম ভনিতা না করেই বাংলাদেশের চিত্র-দর্শকদের উদ্দেশ্যে অমোঘ নির্দেশবাণী উচ্চারণ করেছে: আমাদের দেখো।’ এই দেখার ভেতরে যত অদেখাকে তুলে ধরেছেন তিনি, তাতে তাঁকে জাতিস্মর বললেও কিছু কম হবে না।
১০ ঘণ্টা আগে