leadT1ad

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভাবনা কতটা

রোহিঙ্গা সংকট আট বছরে গড়িয়ে এক ভয়াবহ দোটানায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বলছে, শরণার্থীদের বোঝা তাঁর সহ্যসীমার বাইরে; আন্তর্জাতিক সহায়তাও দ্রুত কমছে। অথচ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, আরাকান আর্মির উত্থান ও জান্তার দমনপীড়নে ফেরত যাওয়ার সকল পথও রুদ্ধ। ন্যায়বিচার আর নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবিতে রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ করলেও বাস্তবে প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতিতে আটকে আছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০০: ০২
স্ট্রিম গ্রাফিক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত সহায়তা দিতে সক্ষম নয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর পথ সুগম করতে একটি সুস্পষ্ট ‘নিরাপদ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ’ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সোমবার (২৫ আগস্ট) কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনে এই আহ্বান জানান তিনি।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজেদের ঘরে, নিজেদের মাতৃভূমিতে ফেরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি দাতাদেরও অনুরোধ করেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা নিশ্চিতে সাহায্য তহবিল পুনরায় বৃদ্ধি করতে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। যাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে পদ্ধতিগত বৈষম্য, ভোটাধিকার হরণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর হামলার পর এক ধাক্কায় সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে (১৯৭৮, ১৯৯১–৯২, ২০১২ ও ২০১৬) মিয়ানমার জান্তার দমন–পীড়নের কারণে প্রায় তিন থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সম্প্রতি আরাকান আর্মির আক্রমণে নতুন করে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে। ২০১৭ সালের জাতিগত নিধন অভিযান ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই সময় রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, গণধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয় । জাতিসংঘ এই দমন–পীড়নকে স্পষ্টভাবে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৪৮ হাজার ৫২৯ জন। কক্সবাজারের ৩৩টি ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে এর মধ্যে ১১ লাখ ১১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ভৌগোলিক কারণে কক্সবাজার রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধান প্রবেশপথ। নাফ নদী পেরিয়ে কিংবা সমুদ্রপথে ভাঙাচোরা নৌকায় উপকূলে পৌঁছেছেন অনেকে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কক্সবাজারে ‘স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগে বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কক্সবাজারে ‘স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগে বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মনোভাবের পরিবর্তন

২০১৭ সালের আগস্টে মানবিক কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা তাকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশার কথা। তখন যেমন ভারত বাংলাদেশিদের আশ্রয় দিয়েছিল, তেমন বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল।

সমস্যা হলো বাংলাদেশের মতো রোহিঙ্গাদের কখনও নিজেদের রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গারা এখনো বাংলাদেশেই রয়ে গেছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে অনিশ্চয়তার মাঝেই নতুন প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে। খাদ্য ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা থাকায় ক্যাম্পগুলোতে জন্মহার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।

২০২২ সালে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশ হলেও রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ। ক্যাম্পে ইতিমধ্যে দুই লাখের বেশি শিশু জন্ম নিয়েছে।’

সময় যত গড়িয়েছে, বাংলাদেশের এই উদারতা নিজেদের বোঝায় পরিণত হয়েছে। সোমবার (২৫ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও স্বীকার করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি, সম্পদ, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রকৃতি, সমাজ এবং প্রশাসনের ওপর এর বিশাল প্রভাব পড়েছে।’

প্রত্যাবাসনে চ্যালেঞ্জ

রোহিঙ্গারা নিজেরাও দেশে ফিরতে চায়। ২০১৭ সালের গণহত্যার বিচার ও স্বদেশে প্রত্যাবাসনের দাবিতে গতকাল সোমবার হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদক টনি চেং বলেন, ‘আমরা এখানে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা দুইটি দাবি তুলেছে। প্রথমত, ২০১৭ সালের গণহত্যার ন্যায়বিচার। দ্বিতীয়ত, মাতৃভূমিতে ফেরত যাওয়ার দাবি। সবাই বলছে, আমরা দেশে ফিরতে চাই।’

কিন্তু প্রত্যাবাসন এত সহজ নয়। ২০২১ সাল থেকে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে চলছে। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্য অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, অন্যদিকে আরাকান আর্মি—উভয় পক্ষই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স গত সপ্তাহে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকাশ্যে অমান্য করে সেনা ও আরাকান আর্মি উভয়ই গুরুতর অপরাধ করে চলেছে।’

সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটে হস্তক্ষেপের মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেই। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রায় ১৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু আবার বিশ্ববাসীর নজরে আনার জন্য এই বৈঠকের আগে কক্সবাজারের সম্মেলন আয়োজন করা হলেও, নিরাপদ ও দ্রুত প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

সংকট দ্বিমুখী

আশ্রয় শিবিরগুলোর পরিস্থিতি বর্তমানে খুব একটা ভালো বলা যায় না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকার বাড়তি এই শরণার্থী নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিবিরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। শিবিরে কাজকর্ম বা জীবিকার সুযোগও সীমিত। ফলে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে তাদের নাগরিকত্ব বা স্থানীয় সমাজে একীভূত করার রাজনৈতিক ইচ্ছা একেবারে শূন্য।

তার ওপর আন্তর্জাতিক সাহায্যও দ্রুত কমছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইউএসএআইডির তহবিল কমিয়ে দেন, তখন থেকেই এই প্রবণতা শুরু। খাদ্য ঘাটতির খবর এখন শিবিরগুলোতে প্রতিদিনের বাস্তবতা।

তিন দফায় (১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১৮) মিয়ানমার থেকে পালানো ফাতেমা খাতুন আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার নিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে চাই। আমার জমি–সম্পত্তি ফিরে পেতে চাই। সেখানে শান্তি দেখতে চাই। আমি এখানে এসেছি আট বছর হলো। আর কতদিন এই কষ্ট সহ্য করব?’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক্সপ্লেইনার। বাংলা অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত