leadT1ad

অনেক বছর পর ইউনূস-তারেকের সফল রাজনৈতিক বৈঠক

অসফল রাজনৈতিক বৈঠকের পাল্লা বেজায় ভারি

লন্ডনে অনুষ্ঠিত মুহাম্মদ ইউনুস এবং তারেক রহমানের বৈঠক শুধু বাংলাদেশের নয়, উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু বৈঠক আছে যেগুলো একেবারেই সফল হয়নি, বরং তাদের ব্যর্থতা ইতিহাসের মোড় বদলে দিয়েছে । 

রাতুল আল আহমেদ
প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৫, ২২: ৪৭
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ১৫: ৪৯
লন্ডনে মুহাম্মদ ইউনুস ও তারেক রহমানের বৈঠক। ছবি: বিএনপির ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

দক্ষিণ এশিয়ায় নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বৈঠক একটা সময় স্বাভাবিক ঘটনাই ছিল। সফল হোক বা বিফল রাজনৈতিক সে সব বৈঠকের তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠকের বদলে কাদা ছোড়াছুড়ি. কথার ফুলঝুড়ি ছিল নিত্যকার ঘটনা। তবে আজ ১৩ জুন লন্ডনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে বৈঠক করলেন, সেটিকে সফল হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমন বৈঠকের নজির পাওয়া দুষ্কর। 

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং জহওরলালা নেহরু। সংগৃহীত ছবি
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং জহওরলালা নেহরু। সংগৃহীত ছবি

জিন্নাহ নেহরু বৈঠক ১৯৪৬

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বৈঠকগুলোর মধ্যে ১৯৪৬-এর বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বৈঠক ছিল এখানকার মানুষদের ভাগ্যের মোড় বদলে দেওয়ার মতো ঘটনা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বম্বের বাড়িতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও জিন্নাহ এ বৈঠক করেন। 

১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে তারা ব্রিটিশ ভারতে দ্রুতই এখানকার মানুষদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই লক্ষ্যে তারা ১৯৪৬ সালে ‘মন্ত্রী মিশন কমিশন’ নামে একটি দল পাঠায় এখানে। তাদের প্রস্তাব ছিল এই উপনিবেশকে ৩ ভাগে বিভক্ত করে ফেডারেল কাঠামো গঠন করা। 

শুরুতে কংগ্রেস ও লিগ দুইপক্ষ প্রস্তাবে রাজি থাকলেও জুলাইয়ে নেহরু জানান তাঁর দল এই প্রস্তাবনা মানতে বাধ্য নয়। জিন্নাহ একে লিগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখেন। 

এই প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালের আগস্টে নেহরু ও জিন্নাহর মধ্যে এই বৈঠক হয়।  জিন্নাহ সেখানে স্পষ্ট বলেন মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয়। নেহরু যুক্তভারতের পক্ষে থাকলেও ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। বৈঠকের ব্যর্থতার ফলেই জিন্নাহ ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের’ ডাক দেন। অভিযোগ রয়েছে, এখান থেকেই কলকাতা দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। যা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী, বিহার, যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) পাঞ্জাবসহ গোটা ব্রিটিশ ভারতে। এই বৈঠক ফলপ্রসু হলে হয়তো ইতিহাসের চাকা আরেকদিকে বাঁক নিতো।

শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের বৈঠক। দৈনিক ইত্তেফাকের নিউজ কাটিং
শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের বৈঠক। দৈনিক ইত্তেফাকের নিউজ কাটিং

মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ১৯৭১

জিন্নাহ-নেহরু বৈঠকের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না ১৯৭১ সালের শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের বৈঠক। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও বেঁকে বসে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ৮৮টি আসনে জেতা  ভুট্টো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি আলাদা প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাব করেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জান্তা সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়। 

এই প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক শুরু হয় ১৬ই মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন)। আলোচনার মূল বিষয় ছিল ক্ষমতা হস্তান্তর। তবে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তাঁর সামরিক জান্তার মনোভাব ছিল প্রতারণার মাধ্যমে সময় নষ্ট করা। মুজিব তাঁর দলের ৬-দফা দাবির ভিত্তিতে একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর খসড়া তুলে ধরেন জান্তা সরকারের কাছে।  এর মধ্যে পাকিস্তানি পক্ষ গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে।

আলোচনার এই কূটকৌশলের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ জানায় তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। এখন সিদ্ধান্তের পালা প্রেসিডেন্টের। কিন্তু সিদ্ধান্ত আসেনি। ২৫ মার্চ রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পূর্ব পরিকল্পিত সামরিক হামলা চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ইয়াহিয়া খান আলোচনা ভেস্তে দিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সামরিক পন্থা বেছে নেন।

এই আলোচনার ব্যর্থতার ফল হিসেবে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ধারাবাহিক টেলিফোন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ধারাবাহিক টেলিফোন

জলিল-মান্নান বৈঠক ২০০৬

স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। দুইটি নির্বাচন এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও বিপত্তি বাধে ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে। 

বিএনপি সংবিধান অনুযায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে কে এম হাসানকে নিয়োগ দিতে চায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় ১৪ দলের জোট তাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে তীব্র আপত্তি তোলে। সংবিধানের ব্যাখ্যার দোহাই দিয়ে বিএনপি প্রথমে বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের নাম সামনে আনে। বিরোধী পক্ষ আরও তীব্রভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার মধ্যে ধারাবাহিক টেলিফোন সংলাপ চললেও বিএনপি এক পর্যায়ে আবার তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়। বিচারপতি কে এম হাসানকে নিয়ে কোনো আপস না হওয়ায় আলোচনার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের নাম নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প খুঁজে না পাওয়া এবং বিএনপির অবস্থান অনড় থাকায় সংকট আরও জটিল হয়।

শেষ পর্যন্ত আলোচনার কোনো ইতিবাচক ফল না আসায় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। এভাবেই একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়।  এবং দেশ অচিরেই প্রবেশ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার চরম পর্যায়ে। ফলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার  ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক-এগারো নামে পরিচিত।  

এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো না যদি জলিল ও মান্নানের মধ্যকার আলোচনা ফলপ্রসু হতো। দুই পক্ষের সমঝোতা হলে  আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন নিয়মতান্ত্রিকভাবে হতো বলে অনেকের ধারণা। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

আশরাফ-ফখরুল বৈঠক ২০১৩ 

২০১১ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। ফলে ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।  রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা হিসেবে তখন উঠে আসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যকার আলোচনার কথা। আলোচনাটি বাস্তবে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পেয়ে বরং বিভ্রান্তি ও অস্বীকারের মধ্যেই চাপা পড়ে যায়। প্রথমে আশার সঞ্চার করলেও শেষ অব্ধি পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে ব্যর্থ হয় এই বৈঠক।

তখনকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন।  বিএনপিকে এতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। জবাবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের দাবি জানিয়ে পাল্টা প্রস্তাব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে চিঠি পাঠান এবং আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি টেলিফোনে তাঁদের কথা বলার কথাও জানা যায় তখনকার গণমাধ্যমগুলোতে।

এই পরিস্থিতিতে ২৩ নভেম্বর রাতের বেলায় কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল খবর প্রচার করে সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা ফখরুল বনানীর একটি বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তবে রাতেই মির্জা ফখরুল সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব খবরকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেন। এ সময় তাঁর বক্তব্য ছিল, আওয়ামী লীগের কারো সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি ।

বিএনপি তখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো আলোচনায় আগ্রহী ছিল না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ছিল সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবে অনড়। এর মধ্যেই আলোচনার যে ক্ষীণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটিও রাজনৈতিক নাটকীয়তার ভেতর শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। 

হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুজনার দুটি পথ কেবল যে দুটি দিকে বেঁকেই গেল এবং কখনোই তারা আর মিলতে পারলো না, এর পেছনে এই না হওয়া বৈঠকের যে বড় ভূমিকা ছিল তা কি আজ কেউ অস্বীকার করতে পারবে! 

Ad 300x250

সম্পর্কিত