leadT1ad

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কে, কী নিয়ে তাঁর কাজ, কেন তিনি কুষ্টিয়ায়

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ২৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় সাহিত্য তাত্ত্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর, ২০২৫) ঢাকায় এসেছেন। কুষ্টিয়ায় জাতীয় লালন উৎসব ও লালন মেলায় অংশ নিতে বাংলাদেশে আসেন তিনি। লালন ফকিরের ১৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

স্পিভাক ১৭ অক্টোবরে ‘লালন বক্তৃতা’-য় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। দক্ষিণ এশীয় মরমিবাদ ও প্রান্তিক কণ্ঠ নিয়ে তাঁর দীর্ঘ গবেষণা লালনের দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। অনেকের মনেই প্রশ্ন, কে এই স্পিভাক?

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা ও প্রভাবশালী প্রবন্ধ— ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’। এছাড়া তিনি ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার বই ‘ডে লা গ্রামাটোলজি’-র ইংরেজি অনুবাদ ও ভূমিকার জন্যও সুপরিচিত। তাঁকে বলা হয়, নিম্নবর্গ বা প্রান্তিকদের কণ্ঠস্বর। তার লেখায় উপনিবেশের প্রভাব, ভাষা, ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্ব নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ আছে। ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?-এ তিনি দেখান, সমাজে নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর কীভাবে চেপে রাখা হয়।

স্পিভাক ইউরোপীয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের সমালোচনা করেন। তিনি নারীবাদ, ভাষান্তর এবং সাহিত্যতত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছেন। তাঁর মূল নৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হলো নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক মানুষের অবস্থান।

বিশেষ করে প্রান্তিক নারীদের স্থান নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, পশ্চিমা সংস্কৃতির ভাষাগত চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানে এই নারীরা কীভাবে উপেক্ষিত হয়। তার লেখায় বিশেষভাবে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের বাস্তবতাও তুলে ধরা হয়েছে।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের পেশাগত জীবন প্রায় পাঁচ দশকজুড়ে বিস্তৃত। তিনি শিক্ষকতা, অনুবাদ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়া–তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

কলকাতা থেকে বিশ্বজুড়ে

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের কলকাতায় (তৎকালীন ক্যালকাটা) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ বংশীয়। বাবা পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন চিকিৎসক, আর মা শিবানী চক্রবর্তী সমাজসেবক। তাঁর প্রপিতামহ বিহারীলাল ভাদুড়ি ছিলেন হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক এবং সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগী। পরিবারের এই মানবহিতৈষী ঐতিহ্য তাঁর চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলে।

তিনি কলকাতার সেন্ট জন’স ডায়োসেসান গার্লস হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. সম্পন্ন করে ১৯৬১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যে পড়েছেন। গবেষণা করেছেনে ডব্লু বি ইয়েটসের কবিতা নিয়ে।

কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের পেশাগত জীবন প্রায় পাঁচ দশকজুড়ে বিস্তৃত। তিনি শিক্ষকতা, অনুবাদ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়া–তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

স্পিভাক ১৯৭৬ সালে জ্যাক দেরিদার বই ‘অব গ্রামাটোলজি’-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এটি ছিল ইংরেজিভাষী পাঠকদের জন্য ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ তত্ত্বের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। অনুবাদের ভূমিকায় তিনি পাশ্চাত্য দর্শনের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে তিনি পেয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—গুগেনহাইম ফেলোশিপ, কিয়োটো প্রাইজ (২০১২), ভারতের পদ্মভূষণ (২০১৩) এবং সদস্যপদ পেয়েছেন আমেরিকান ফিলোসফিকাল সোসাইটি (২০০৭) ও ব্রিটিশ একাডেমিতে (২০২১)। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি পশ্চিমবঙ্গ-বিহার সীমান্তে ভূমিহীন কৃষকদের পড়ালেখা করান। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পরেশ চন্দ্র ও শিবানী চক্রবর্তী স্মৃতি ফাউন্ডেশন, যা গ্রামীণ শিক্ষায় অর্থ সহায়তা দেয়। এটা তাঁর তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের এক অনন্য উদাহরণ।

স্পিভাকের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাড়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’-এর মাধ্যমে। এই প্রবন্ধ উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়নের এক মাইলফলক। স্পিভাক দেখিয়েছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক ও উচ্চবিত্তদের চিন্তা সাধারণ মানুষকে, বিশেষত নারীদের, নীরব করে রাখে।

কেন বিখ্যাত?

স্পিভাকের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাড়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’-এর মাধ্যমে। এই প্রবন্ধ উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়নের এক মাইলফলক। স্পিভাক দেখিয়েছেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক ও উচ্চবিত্তদের চিন্তা সাধারণ মানুষকে, বিশেষত নারীদের, নীরব করে রাখে।

এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশের কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই। তারা নীতিনির্ধারণী আলোচনায় অংশ নিতে পারে না এবং সমাজের সম্পদের ন্যায্য ভাগ দাবি করার সুযোগও পায় না।

তিনি ১৮২৯ সালে সংঘটিত তাঁর আত্মীয়া ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ীর সতীদাহ ঘটনার উদাহরণ টেনে দেখান, পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদীরাও প্রায়ই উপেক্ষিতদের হয়ে নিজেরাই ‘কথা বলেন’, কিন্তু তাঁদের নিজের কণ্ঠকে প্রকাশ করতে দেন না। এই বিশ্লেষণ ‘এপিস্টেমিক ভায়োলেন্স’ বা ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা’-র ধারণাকে সামনে আনে।

নিম্নবর্গের মানুষরা কি কথা বলতে পারে? এই প্রশ্ন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে প্রবন্ধটি গভীর প্রভাব ফেলে।

স্পিভাকের বিশ্বজোড়া খ্যাতির মূল কারণ তাঁর অনুবাদ। তিনি জ্যাক দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বকে তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

সমালোচকেরা তাঁর লেখাকে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন। অনেকেই মনে করেন, তাঁর লেখা কঠিন ভাষায় লেখা। বয়স ৮৩ হলেও তিনি এখনো সক্রিয়।

স্পিভাক উপনিবেশ-পূর্ব অতীতকে বিশুদ্ধ রূপে পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ উপনিবেশবাদের প্রভাব তা বদলে দিয়েছে। তিনি পশ্চিমা গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা করেন। স্পিভাক বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে অ-পশ্চিমা সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখে বা কথা বলে, তা পক্ষপাতদুষ্ট। এই জ্ঞান উৎপাদন মূলত পশ্চিমের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে এবং নিরপেক্ষ নয়।

গায়ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বাংলার সাধক লালন ফকিরের গান তিনি বিশ্লেষণ করেন। ‘অ্যান এসথেটিক এডুকেশন ইন দ্য এরা অব গ্লোবালাইজেশন (২০১২)’-এ তিনি লালনের রচনা ও নিজের উপনিবেশ-উত্তর গবেষণার মাধ্যমে দেখান, কীভাবে নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যবোধ কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করতে পারে।

বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণে লিঙ্গ, শ্রেণি ও জাতিগত পরিচয়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিলে বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

তাঁর বই ‘অ্যা ক্রিটিক অব পোস্টকলোনিয়াল রিজন (১৯৯৯)-এ তিনি ইউরোপীয় দার্শনিকদের সমালোচনা করেন। নারীবাদ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্নধর্মী ও চ্যালেঞ্জিং। তিনি পশ্চিমা মধ্যবিত্ত নারীবাদীদের সমালোচনা করেন। তারা উন্নয়নশীল দেশের নারীদের শোষণের সাথে যুক্ত, এমনটাও মনে করেন। তিনি বলেন, ইতিহাসে পুরুষ-প্রাধান্যের (ফ্যালোজোসেন্ট্রিক) বিরুদ্ধে নারীদের হস্তক্ষেপ করতে হবে। তিনি লিঙ্গ পরিচয়কে ভৌগোলিক অবস্থান, শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একসূত্রে দেখেন।

গায়ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বাংলার সাধক লালন ফকিরের গান তিনি বিশ্লেষণ করেন। ‘অ্যান এসথেটিক এডুকেশন ইন দ্য এরা অব গ্লোবালাইজেশন (২০১২)’-এ তিনি লালনের রচনা ও নিজের উপনিবেশ-উত্তর গবেষণার মাধ্যমে দেখান, কীভাবে নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যবোধ কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করতে পারে। এই কল্পনাশক্তি মানুষকে ‘অন্যের’ সঙ্গে নৈতিকভাবে যুক্ত হতে সাহায্য করে। তাঁর মতে, কেবল সংস্কৃতি সংরক্ষণই সমস্যার সমাধান নয়; বরং নৈতিক ও কল্পনাপ্রসূত সংযোগই আসল পথ।

লালনের মত অনুযায়ী, জাত-ধর্ম বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে গুরুত্ব দিতে হয়। স্পিভাক এই ভাবনাকে তার ‘গ্রহীয় নৈতিকতা’ (প্ল্যানেটারি এথিকস)-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন।

এ ছাড়া, তিনি বিশ্বায়ন, সন্ত্রাসবাদ ও শিক্ষার স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেছেন।

স্পিভাক আমাদের শেখান কীভাবে নিজের বিশেষাধিকারকে অস্বীকার করে, নৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা গড়ে তুলতে হয়। তিনি চান আমরা যেন প্রান্তিকদের কণ্ঠস্বর শুনতে পারি।

লালন উৎসবে তার অংশগ্রহণ এবং কুষ্টিয়ায় তার উপস্থিতি, বাঙালির লোকজ জ্ঞান ও বৈশ্বিক চিন্তার মধ্যে এক নতুন সেতুবন্ধন তৈরি করবে। তাঁর এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সামনে প্রশ্ন তোলেন: বিভক্ত এই সময়ে আমরা কি নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক মানুষদের কথা বলতে দিতে পারি?

Ad 300x250

সম্পর্কিত