leadT1ad

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস

বাংলাদেশে ‘ন্যায়বিচার’ কতখানি?

১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। এই দিবসকে বিশ্বব্যাপী আইন ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কতটা দৃশ্যমান? ওয়ালিদের মতো শিশুহত্যায় বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা—আমাদের ন্যায়বিচারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।

শতাব্দীকা ঊর্মি
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪৫
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

এখনো কান্নার শব্দে কেঁপে ওঠে শিশু ওয়ালিদের ঘর। ৩ বছর পরেও তাঁর মা জানেন না কেন খুন হতে হলো তাঁর আদরের সন্তানকে।

২০২২ সালের ১৫ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর শিকারপুরে সাড়ে তিন বছরের শিশু মুহাম্মদ ওয়ালিদকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। এরপর কেটে গেছে তিন বছর। এখনো বিচার পায়নি ওয়ালিদের পরিবার।

বাংলাদেশের শিশুহত্যার পরিসংখ্যান এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরেই জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শিশুহত্যার সংখ্যা ২২০টি। মামলা হয় মাত্র ৮৭টির। কিছু মামলার খবর মিডিয়ায় এলেও বাকিগুলো রয়ে যায় অজানা। নিহত শিশুরা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। আর সমাজের নিম্নবর্গের মানুষেরা তো বেশিরভাগ সময় মামলাই করেন না।

বিশ্ব ন্যায়বিচার দিবসে বাংলাদেশের ন্যায়বিচার পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনা খুবই প্রাসঙ্গিক।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস

প্রতি বছর ১৭ই জুলাই বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। এটি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচার দিবস বা আন্তর্জাতিক বিচার দিবস নামেও পরিচিত। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বিকাশের স্বীকৃতিস্বরূপ এই দিনটি পালন করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১৭ই জুলাই ‘রোম সংবিধি’ গৃহীত হয়েছিল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালের ১ জুন উগান্ডায় অনুষ্ঠিত রোম সংবিধির পর্যালোচনা সম্মেলনে রাষ্ট্রপক্ষগুলোর পরিষদ ১৭ই জুলাইকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বজুড়ে মানুষ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রচারে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সমর্থনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বীকৃত এ দিবস বিশ্বের নানা দেশের বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর ও সহজ করার কথা বলা হয়। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার হালচাল ঠিক কেমন?

যেভাবে কাজ করে আইন

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একটি ‘সাধারণ আইন’-ভিত্তিক ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান ও সংসদ প্রণীত আইন ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে সেগুলোকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও (অনুচ্ছেদ ৪৪ ও ১০২) বলবৎ করতে পারে।

বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫২) যেকোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি বা অন্যান্য আইনি উপকরণ। সংসদ প্রণীত আইন, অধ্যাদেশ এবং রাষ্ট্রপতির আদেশকে প্রাথমিক আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে বিধি ও প্রবিধানকে ( সাধারণত কোনো আইন বা নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত নিয়মাবলি) দ্বিতীয় পর্যায়ের আইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ অনুযায়ী, আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন তাদের অধীনস্থ সকল আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। সুতরাং, বাংলাদেশে প্রচলিত আইন, দ্বিতীয় পর্যায়ের আইন এবং বিচারিক আইন বা নজির, প্রথা ও ব্যবহার সবই আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের বাস্তবতা

২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭৪% দেশে মৌলিক অধিকারের অবনতি হয়েছে। এই তালিকায় নাম আছে বাংলাদেশেরও। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ‘রুল অফ ল ইনডেক্স’ ২০২৪ অনুযায়ী, আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ১৪২টি দেশের মধ্যে ১২৭তম স্থানে রয়েছে। এ অবস্থানে বাংলাদেশের স্কোর ০.৩৯। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল। ২০০৮ সালে সারা দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লাখ। ২০২৩ সালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৩৭ লাখে। দেড় দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ লাখ মামলা।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিচারের ফলাফল পেতে কেটে যায় দীর্ঘদিন। বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তরে ঘটে দুর্নীতি। আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিচারকে প্রভাবিত করে। আইনের দুর্বল প্রয়োগ, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং পর্যাপ্ত বিচারক ও আদালতের অভাবও সমস্যার অন্তর্ভুক্ত। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার পাওয়া হয়ে ওঠে কঠিন। এতে জনগণের আস্থা ও বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এসব চ্যালেঞ্জ দূর করা না গেলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব।

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ স্ট্রিমকে জানান, ‘নিম্নবর্গের মানুষের জন্য মামলা মোকাদ্দমা একটা জটিল ব্যাপার। সমাজে যাদের ক্ষমতা কম, ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তাঁরা বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ক্ষমতাবানদের প্রভাবে অনেক সময় তাঁরা মামলা পর্যন্ত আসেনও না।’

বাংলাদেশে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের বাস্তবায়নের জন্য যে আরো বহুদূর যেতে হবে, এই বিষয়ে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। ন্যায়বিচার যেন কোনো বিশেষ ক্ষমতা বা যোগ্যতার অধীন হয়ে না পড়ে। শ্রেণি, ক্ষমতা, লিঙ্গ , বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিক যেন ন্যায়বিচার পেতে পারেন তার জন্য যা করা উচিত সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। দরকার অগ্রাধিকারগুলোকে চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত