leadT1ad

নেপালে চলমান গণবিক্ষোভ আর দুনিয়াজোড়া ডিজিটাল স্বৈরাচার

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৯
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

নেপাল বর্তমানে এক মারাত্মক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুর কারণে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, যার ফলে অনেক আহত এবং দুঃখজনকভাবে কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। তবে এই আন্দোলনে যা বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করছে তা হলো, এই আন্দোলন এবং সহিংসতার উত্থানে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ভূমিকা।

নেপাল সরকার প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের কার্যক্রম নিবন্ধন করতে এবং স্থানীয় আইন অনুসরণ করতে অনুরোধ করেছে। সরকারের বক্তব্য অনুসারে এর উদ্দেশ্য বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সামাজিক অস্থিরতা প্রতিরোধ। সেই সঙ্গে যেহেতু দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশের পরিচালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জড়িত। তাই সেখানে কোম্পানিগুলোর ইচ্ছার ওপর দেশের অর্থনীতিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মগুলো নেপাল সরকারের অনুরোধে খুব একটা সাড়া দেয়নি। এর ফলে একটি গুরুতর প্রশ্ন উঠছে: এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কি নিজেদের অবহেলার কারণে নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা এবং অস্থিরতা বাড়াচ্ছে?

সমস্যা যা নিয়ে

নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব) কোম্পানির সাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিরোধে জড়িয়েছে, যা মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এই বিরোধগুলো চারটি প্রধান ইস্যুর ওপর নির্ভর করে শুরু হয়েছে:

১. নিয়ন্ত্রণ ও দেশীয় আইন অনুসরণ: নেপাল সরকার সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে। কারণ এরা স্থানীয় আইন মেনে চলছে না এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তবে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সরকারের এই দাবী মানতে অস্বীকার করেছে।

২. বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে অসত্য তথ্য ছড়ানোর ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়েছে। সরকারের মতে, এসব প্ল্যাটফর্ম বিরোধী দলের পক্ষে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

৩. সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব: সরকারের মতে, সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর আঘাতে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

৪. অনলাইন সেফটি আইন ও প্রাইভেসি: নেপাল সরকার ২০২০ সালে আইসিটি আইন ও সাইবার ক্রাইম আইনের মাধ্যমে অনলাইন নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এই আইনকে তাদের ব্যবসায়িক স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।

নেপালে চলছে জেন-জিদের বিক্ষোভ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
নেপালে চলছে জেন-জিদের বিক্ষোভ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

সামাজিক মিডিয়ার অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ: অস্থিরতার মূল উৎস

এই সমস্যাটির কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা, যা একদিকে যেমন যোগাযোগের মাধ্যম, তেমনি প্রতিবাদী আন্দোলনের মেগাফোন হিসেবে কাজ করছে। ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো প্রতিবাদী জনতাকে সংগঠিত করতে এবং রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। নেপালে এসব প্ল্যাটফর্ম রাজনৈতিক বার্তা প্রচারে এবং প্রতিবাদ সংগঠনে ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু এখানে আরও একটি অন্ধকার দিক রয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মের ওপর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি না থাকার কারণে মিথ্যা তথ্য এবং ভুল ধারণা খুব সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা প্রতিবাদকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। নেপাল সরকারের দাবি তারা এই ধরনের বিভ্রান্তি এবং সহিংসতা প্রতিরোধে উদ্যোগ নিয়েছে, তবে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সাধারণত স্থানীয় আইন মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে এটি বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর আঘাত হানবে।

এখানে বড় প্রশ্ন উঠছে: এই কোম্পানিগুলো কি নিজেদের শক্তির দম্ভে দেশীয় আইন ও শাসনের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা দেখাচ্ছে?

নীতি প্রতিরোধের একটি প্যাটার্ন

নেপাল একা নয়; এই সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশে বিদ্যমান। বিভিন্ন সরকার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করতে চেয়েছে, তবে প্রায়ই তা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। যেমন, ভারতে সরকার সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর আরও কঠোর নজরদারি আরোপের চেষ্টা করেছ। বিশেষত যখন ভুল তথ্য বড় ধরনের দাঙ্গার জন্ম দেয়। তবে, ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তারা বলেছে যে, এটি তাদের মুক্তভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

মিয়ানমারেও ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, এটি সেখানে জাতিগত সহিংসতা উসকে দেওয়ার কাজ করেছে। রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ঘৃণা বক্তব্য ছড়ানো, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। তবে, ফেসবুক ওই সহিংসতা ঘটার পরই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল, কিন্তু তখন পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল।

আরেকটি উদাহরণ হলো, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ। সেখানে সামাজিক মাধ্যমকে রাজনৈতিক বিভাজন এবং অস্থিরতা উসকে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে এ জন্য সমালোচনা করা হয়েছে। কারণ তারা রাজনৈতিক বিভেদের ভাষা বা ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর যথাযথ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে হামলা হয়েছিল।

নেপালে চলছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
নেপালে চলছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ডিজিটাল স্বৈরাচার?

বিষয়টি এখন বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যখন স্থানীয় আইন মেনে চলতে অস্বীকার করে, তখন এটি ডিজিটাল স্বৈরাচারের একটি রূপ হিসেবে দেখা যায়। এই প্ল্যাটফর্মগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতি কোনো ধরনের শ্রদ্ধা না দেখিয়ে, নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করছে যে, তারা কোন ধরণের তথ্য ছাড় দেবে আর কী দেবে না। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের গণতন্ত্র, মুক্ত মতপ্রকাশ এবং বৈশ্বিক সংযোগের প্রচারক বলে দাবি করে। কিন্তু তারা স্থানীয় বাস্তবতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে। তারা কার্যত নিজেদেরই এক ধরনের দুনিয়াজোড়া শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।

নেপালে সরকার ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাদের দাবি অনুসারে, ডিজিটাল স্পেসের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস হিসেবে। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই কোম্পানিগুলো এতটা শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী যে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা খুবই কঠিন। তাদের আইন অমান্য করার প্রবণতা, একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রায় সব দেশেই জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানির একরোখা আধিপত্যের মধ্যে একটি বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চোখে পড়ছে।

না সরকার না কোম্পানি

নেপালের মতো দেশে চলমান অস্থিরতা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের সমস্যার সমাধান একপাক্ষিকভাবে সরকার বা প্রযুক্তি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সরকার যে প্রযুক্তি কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়, তাও জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হতে পারে। আবার, কোম্পানিগুলোও তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য স্থানীয় আইন মেনে চলে না, যা সহিংসতা বাড়ায়।

এজন্য একটা স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন, যা সরকারের এবং প্রযুক্তি কোম্পানির মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখবে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত, যাতে জনগণ সঠিক তথ্য বেছে নিতে পারে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, এবং সরকারকে আইনগত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।

অতএব, সমস্যা সমাধান করতে হলে সকল পক্ষ—সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানি, এবং জনগণ—একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এবং এর মধ্যে একটি নিরপেক্ষ তদারকি সংস্থা সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত