মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সিন্ডিকেট করে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করার মাধ্যমে ৩১০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির পাঁচ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পৃথক চারটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ১৮ হাজার ৫৬৩ জনের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আদায় করে এই বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।’
এর আগে গত ৪ নভেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলাগুলো দায়ের করেন। এই চার মামলায় মোট পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিরা হলেন—আর ভিং এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হেফজুল বারী মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, অদিতী ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিৎ সাহা, রাব্বি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বশির এবং সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফারিদা বানু ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল হাই।
যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ
দুদকের এজাহার ও অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭৭ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় যান। সরকার প্রতি কর্মীর জন্য মোট ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা।
কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এই চারটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও কর্মকর্তারা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এজাহারে অভিযোগ করা হয়, তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে এবং বিএমইটি ও বায়রার শর্ত ভঙ্গ করে কর্মীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আদায় করেন। মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা নিজেদের খরচে পাসপোর্ট তৈরি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি ফির অন্তর্ভুক্ত থাকা পাসপোর্টের ১০ হাজার টাকা এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ৭ হাজার ৫০০ টাকা কর্মীদের ফেরত দেয়নি। এর বাইরেও প্রতিটি কর্মীর কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত অর্থের চেয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা করে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে।
কার বিরুদ্ধে কত টাকার অভিযোগ
এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে মতিঝিলের আর ভিং এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হেফজুল বারী মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে ৮ হাজার ৭৭ জন কর্মীর কাছ থেকে ১৩৫ কোটি ২৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৪ কোটি ৫২ লাখ ১০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে দিলকুশার অদিতী ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিৎ সাহার বিরুদ্ধে। তাঁর প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৮৫২ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া পাঠায়।
দুদকের তৃতীয় মামলায় শান্তিনগরের সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফারিদা বানু ও এমডি মো. আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৪৮৬ জন কর্মীর কাছ থেকে ৫৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। চতুর্থ মামলাটি করা হয়েছে প্রগতি সরণির রাব্বি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বশিরের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে ৩ হাজার ১৪৮ জন কর্মীর কাছ থেকে ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৯০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
সব মিলিয়ে এই চারটি প্রতিষ্ঠান ১৮ হাজার ৫৬৩ জন শ্রমিকের কাছ থেকে ৩১০ কোটি ৯৩ লাখ ২ হাজার ৫০০ টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে এটিই দুদকের প্রথম পদক্ষেপ নয়। এর আগে গত ৬ নভেম্বর দেশটিতে কর্মী পাঠাতে ৫২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তারও আগে গত ১১ মার্চ ও ১৪ সেপ্টেম্বর হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে আরও একাধিক মামলা করেছিল সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুনরায় চুক্তি হওয়ার পর ২০২২ সালে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় যেতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
সব আসামির বিরুদ্ধেই দণ্ডবিধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।