leadT1ad

ব্রাজিলে চলছে কপ-৩০, ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কেমন

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩৫
সোমবার থেকে ব্রাজিলের বেলেমেতে শুরু হয়েছে সম্মেলন। সংগৃহীত ছবি

প্রায় ৩৩ বছর আগে ব্রাজিলের রিও শহরে হয়েছিল জাতিসংঘের প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন। যেখান থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার পথচলা শুরু হয়। এবার সেই ব্রাজিলেই বসেছে ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন। আমাজন মহাবনের ভেতরের বৃষ্টি-বনাঞ্চলের শহর নামে পরিচিত বেলেমে। গতকাল সোমবার থেকে ব্রাজিলের এই শহরে সম্মেলন শুরু হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের অংশগ্রহণে এই সম্মেলন দুই সপ্তাহব্যাপী চলবে।

এই সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়ন, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিপূরণ ইস্যু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে। বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও দাবিনামা চূড়ান্ত করেছে। সম্মেলনে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার বিশেষ উপস্থাপনাও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের অবস্থা কী

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকা প্রতি বছর ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির কীভাবে মোকাবিলা করা হবে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হবে কি না—এই প্রশ্ন সামনে রেখে বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ১১টি উপজেলার অন্তত ১০ হাজার পরিবার উপকূলীয় এলাকায় বাড়ি হারিয়ে কাজ ও মাথা গোঁজার আশায় শহরমুখী হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত ১০ বছর ধরে প্রতি বছরই ঝড় হচ্ছে, প্রতি ঝড়েই বাড়িঘর ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আগের তুলনায় ফসল উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। আছে লবণ পানির সমস্যাও। খাবার পানির জন্য যেতে হয় দুই মাইল দূর পর্যন্ত।’

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৩.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যার জন্য দায়ী করা হয় কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত দেশগুলোকে। আর ঠিক এ কারণেই আসন্ন কপ সম্মেলনে এ ক্ষতির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে জোরালোভাবে অংশ নিতে চায় বাংলাদেশ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাওসেডের নলেজ ম্যানেজমেন্ট টিম লিডার সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘এবারের সম্মেলনে আমরা চাই ক্ষতিপূরণ ও অভিযোজন তহবিলের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে। আমাদের তরুণ কর্মীরা জোরালো প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন এবং নেগোসিয়েশনে লবিং করা।’

ক্ষতিপূরণ হিসেবে এখন যা পাওয়া যায়, তা দাবির তুলনায় অনেক কম বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘তার ওপর তা লোন আকারে আসে; অথচ এই অর্থ গ্রান্ট হিসেবে পাওয়া উচিত ছিল। তাই এবার এ দাবিটিকে আরও জোরালো করার পরিকল্পনা রয়েছে।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে গবেষণাধর্মী প্রমাণাদি অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক ঘাটতি আছে বলে তিনি জানান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবিসমূহ স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

কপ কী?

কপ অর্থ কনফারেন্স অব পার্টিজ। জাতিসংঘের জলবায়ু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর বৈঠককে কপ বলা হয়। ১৯৯২ সালের জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের মাধ্যমে দেশগুলো একসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজ করার অঙ্গীকার করে। এতে বলা হয়, যেসব ধনী দেশ বেশি দূষণ ঘটিয়েছে, তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

প্রতি বছর একেক দেশ আয়োজক হয়, এবার সভাপতিত্ব করছে ব্রাজিল। দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনে বিশ্বনেতারা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করেন, নতুন লক্ষ্য ঠিক করেন এবং পুরনো প্রতিশ্রুতির জবাব দেন।

কপ ৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ

এ বছরের সম্মেলনকে অনেকে বলছেন ‘ফিরে দেখা কপ’। কারণ প্রথম জলবায়ু সনদও হয়েছিল ব্রাজিলেই। ব্রাজিল জানিয়েছে, এবার তারা ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী’দের গুরুত্ব দেবে। বিশেষ করে আমাজনের আদিবাসী সম্প্রদায় ও দরিদ্র দেশগুলো।

দেশটি বলছে, নতুন প্রতিশ্রুতি নয় বরং আগেরগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। যেমন, আগের কপে জীবাশ্ম জ্বালানি কমানোর যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবে দেখতে চায় ব্রাজিল। এ বছর প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হচ্ছে—পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে।

মূলত আমাজন বন রক্ষার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে বেলেম শহরে এবারের আয়োজনটি করা হয়েছে। কারণ এই বনই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন শোষক। অথচ লগিং, খনন ও কৃষি শিল্পের কারণে তা ক্রমেই হুমকির মুখে।

কারা থাকছেন সম্মেলনে

বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন এবারের সম্মেলনে। অনেক দেশ আবার স্বার্থভিত্তিক জোট হিসেবে কাজ করে। প্রধান জোটগুলোর মধ্যে রয়েছে ছোট দ্বীপ দেশগুলোর জোট অ্যওসিস। এই জোটটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অস্তিত্বের সংকটের মুখে রয়েছে। আছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবচেয়ে বড় ব্লক জি–৭৭ চায়না। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও চীনের গ্রুপ বেসিক।

যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেতৃত্বের জায়গা কিছুটা ছাড় দিয়েছে, আর সেই জায়গা পূরণে এগিয়ে আসছে চীন ও ব্রাজিল।

সম্মেলনে কী হয়

দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে দেশগুলো নিজেদের অগ্রাধিকার তুলে ধরে, আলোচনা শুরু হয় নীতিগত বিষয় নিয়ে। এই সময় অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান নতুন প্রকল্প, অর্থায়ন বা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে।

দ্বিতীয় সপ্তাহে যোগ দেন দেশগুলোর মন্ত্রী ও শীর্ষ কর্মকর্তা। যারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, আইনি ও কারিগরি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে। এর পাশাপাশি চলে নানা সাইড ইভেন্ট, বেসরকারি সংস্থার কর্মসূচি, করপোরেট লবিং, বিনিয়োগ বৈঠক ইত্যাদি।

এ বছর কিছুটা ভিন্নভাবে আয়োজন করেছে ব্রাজিল। বিনিয়োগকারীদের বৈঠক হচ্ছে সাও পাওলোতে, স্থানীয় নেতাদের বৈঠক রিও ডি জেনেওরিওতে, আর মূল জলবায়ু আলোচনা বেলেমে, ১০ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত।

সহজ মনে হলেও জটিল

দেখতে যতটা সহজ মনে হয়, কপ আসলে ততটাই জটিল। দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে দর কষাকষি করে, অনেকে ‘লাল দাগ’ টানে। শেষ সপ্তাহে সারারাত জেগে সমঝোতা খোঁজা হয়। সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সম্মতির ভিত্তিতে, ভোটে নয়।

আর শেষ দিনের গ্যাভেল পড়তে দেরি হয় প্রায়ই—কখনো একদিন, কখনো দুই। সাংবাদিকরা মজা করে বলেন, ‘কপ কাভার করতে যাচ্ছেন? স্ন্যাকস নিয়ে যান!’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত