চট্টগ্রাম নগরীতে বিএনপি মনোনীত এমপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি প্রচারে গত বুধবার (৫ নভেম্বর) গুলিতে নিহত হন সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা (৪৩)। ১৫ মামলার আসামি সরোয়ারের হত্যার পর চট্টগ্রামে লোকমুখে ঘুরছে আরও দুই পরিচিত অপরাধীর নাম—শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ ও সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ।
তাঁদের মধ্যে বড় সাজ্জাদ জামিনে বেরিয়ে অনেক আগেই দেশ ছেড়েছেন। এরপর গত এক দশক ধরে তাঁর সন্ত্রাসের রাজত্ব ‘সামলাচ্ছিলেন’ ছোট সাজ্জাদ। গত ১৫ মার্চ গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে আছেন ১৭ মামলার এই আসামি। তাঁর স্ত্রীও এখন জেলে। তবে কারাগারে থাকলেও ছোট সাজ্জাদের নির্দেশেই নগরে একের পর এক সশস্ত্র ‘অপারেশন’ (হামলা-খুন) চলছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় লোকজন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, জেলে বসেই ছোট সাজ্জাদ ঠিক করেন দেন কোন এলাকায় কবে যাবে তাঁর গ্রুপ। তাঁদের কে কোথায় যাবে, কার বিরুদ্ধে অ্যাকশন (চড়াও) হবে। এ জন্য জেল থেকে নানা মাধ্যমে তিনি সাংকেতিক বার্তা পাঠান। এরপর সেই নির্দেশনা কার্যকর করে তাঁর সহযোগীরা। একে কেউ কেউ বলেন, ‘রিমোট কন্ট্রোল রাজত্ব’।
জেলে বসেই সাংকেতিক বার্তা
চট্টগ্রামে গত আট মাসে অন্তত পাঁচটি হত্যা এবং সাতটি সন্ত্রাসী হামলায় নাম এসেছে ছোট সাজ্জাদ গ্রুপের। এর মধ্যে পাঁচটিতে সরাসরি গুলি ছোড়া হয়। পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, কারাগারে বসেই সাজ্জাদ ‘টার্গেট লিস্ট’ তৈরি করে আস্থাভাজনদের দিয়ে বাইরে পাঠান।
জেলে থেকে কীভাবে নির্দেশনা পায় সাজ্জাদের বাহিনী, তা জানতে জেলার পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা, একজন জেল পুলিশ কর্মকর্তা, একজন বিশেষ ইউনিটের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্রিম। তাঁরা জানান, কারাগারের ভেতর থেকেই ফোন কল ও বার্তার মাধ্যমে নিজের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ছোট সাজ্জাদ। তাঁর নেটওয়ার্ক এতটাই গোছানো যে জেলের দেয়াল তেমন বাধা তৈরি করতে পারেনি।
ছোট সাজ্জাদের একাধিক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ দুজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ছোট সাজ্জাদের একাধিক ‘বিশ্বস্ত লিংক-ম্যান’ রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে পরিবার বা আইনজীবীর দেখা-সাক্ষাতের আড়ালে তারা সাজ্জাদের নির্দেশগুলো বাইরে পৌঁছে দেন। এই দুজনের ভাষ্য, সাক্ষাতে সাজ্জাদ কিছু গোপন ইঙ্গিত (কোড ওয়ার্ড) ব্যবহার করেন। যেমন– ‘চা বানাও’ মানে কারও বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু। ‘খাম পাঠাও’ মানে কাজ বাবদ টাকা পাঠানো। সাজ্জাদের লিংক-ম্যানরা কারাগারে সাক্ষাৎ শেষে বাইরে এসে ওইসব সংকেত (কোড) রূপান্তর করে সহযোগীদের পাঠান।
নগরীর বায়েজিদ থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাজ্জাদ খুব সাবধানী। কখনো স্পষ্ট করে কিছু বলে না। কথার মধ্যে ইঙ্গিত দেয়। তাতেই নির্দেশ বুঝে যায় তার লোকজন।’
চট্টগ্রাম কারাগারের একজন জেল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্ট্রিমকে বলেন, ‘ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন কয়েদি আসলে তাঁর ‘কর্মচারী’। ওরা ফোন লুকিয়ে রাখে, চার্জ দেয়, এমনকি কল রিসিভ করে বাইরে বার্তা পাঠায়।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা জানি, সে জেল থেকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু আমাদের হাত বাঁধা।’ তাঁর দাবি, সাজ্জাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার। তাঁরা প্রশাসনের ওপর চাপ দিয়ে সাজ্জাদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধা’ নিশ্চিত করেন।
যদিও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ্ শরীফের দাবি নিয়মের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘কারাবিধি অনুযায়ী, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নিয়ম রয়েছে। ওই সাক্ষাতে কী কথা হয়, সেটি আমরা শুনতে পারি না। এটি নিয়মবহির্ভূত। এ ছাড়া সপ্তাহে একবার ১০ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারেন বন্দিরা। সবগুলোই নিয়ম মাফিক হয়ে থাকে। এর বাইরে কারাগারে অন্য কারও মাধ্যমে মুঠোফোনে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। তবুও আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি, যেন কোনো বহিরাগত সাক্ষাৎ করতে না পারে।’
জেলারের এই বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের ভাষ্য মেলে না। সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের সাইবার ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, সাজ্জাদের ব্যবহৃত সিমগুলো সব ‘ব্ল্যাঙ্ক সিম’, যেগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। ফলে ডিজিটাল ট্র্যাক মেলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিছু বার্তায় আবার শুধু ইমোজি ব্যবহার করা হয়।
পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘যা দেখে মনে হচ্ছে সাজ্জাদের রিমোট কন্ট্রোল সাম্রাজ্য তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও জেল প্রশাসনের দুর্নীতি; দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল যোগাযোগের কৌশল এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবের নিরাপত্তা বলয়। তাঁর ভাষ্য, ‘সাজ্জাদ হয়তো বন্দি, কিন্তু বাস্তবে সে এখনো মুক্ত। তার ফোনের ওপাশেই চলছে এক অদৃশ্য রাজত্ব।’
সাজ্জাদকে আটক করা গেলেও তাঁর নেটওয়ার্ক বন্ধ করা যায়নি বলে স্বীকারও করেছেন বায়েজিদ থানার এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি জানান, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসের মিশ্রণ ঘটেছে। সাজ্জাদদের মতো অপরাধীরা রাজনীতির আশ্রয়ে বেঁচে থাকে। সাজ্জাদ জেলে গেলেও তার অনুসারীরা প্রতিদিন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যা নামলেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, কেউ মুখ খুলতে চায় না।
জননিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলছেন, যতক্ষণ না কারাগার-বাহির উভয় দিকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়, ততক্ষণ এই ধরনের ‘রিমোট কন্ট্রোল রাজত্ব’ বন্ধ করা কঠিন। তাঁর মতে, রাজনীতি, পুলিশ ও অপরাধী—এই ত্রিমুখী জোটই চট্টগ্রামকে সবচেয়ে অরক্ষিত শহরে পরিণত করছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগ নেয় সন্ত্রাসীরা
গত বছর আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর সারা দেশেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এই সুযোগে চট্টগ্রামে খুনসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। গত এক বছরে জোড়া খুনসহ চট্টগ্রামে অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ডে এসেছে ছোট সাজ্জাদের অনুসারীদের নাম। আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও ভাড়াটে খুনি হিসেবে এই বাহিনীর সদস্যরা কাজ করেন বলে অভিযোগ আছে।
ছোট সাজ্জাদ মূলত আলোচনায় আসে গত বছরের ২৯ আগস্ট। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ওই দিন বায়েজিদ বোস্তামী থানার অনন্যা আবাসিক এলাকায় প্রতিপক্ষ মো. আনিস ও কায়সারকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। এরপর থেকে তাঁর নাম হয়ে ওঠে শহরের ভয়ের কারণ।
ওই ঘটনার পর চলতি বছরের ২৯ মার্চ রাতে দিকে বাকলিয়া থানার এক্সেস রোডে মোটরসাইকেলে এসে প্রাইভেট কারে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় সাজ্জাদের অনুসারীরা। এতে নিহত হন আব্দুল্লাহ আল রিফাত ও মো. বখতিয়ার ওরফে মানিক নামে দুই যুবক। তাঁদের স্বজনেরা জানান, সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারে সহায়তা করার সন্দেহ থেকে রিফাত ও মানিকে হত্যা করা হয়।
একই কারণে এক সময় বড় সাজ্জাদের সহযোগী সরোয়ার বাবলাও তাঁদের টার্গেট ছিল। ওই দিন বেঁচে গেলেও গত বুধবার আর পারেননি। বায়েজিদ থানার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া এলাকায় খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এমনকি বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহও ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন। অথচ প্রার্থী নিজে উপস্থিত থাকায় সেখানে নূন্যতম নিরাপত্তা থাকার কথা ছিল।
এই হত্যায় নাম এসেছে ছোট সাজ্জাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত রায়হান গ্রুপের। বিষয়টি নিয়ে গত বুধবার রাতেই সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত হতে পারে, সে বিষয়ে পুলিশের ধারণা আছে। অপরাধীদের মূল টার্গেট ছিল সরোয়ার, এরশাদ উল্লাহ নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাজ্জাদ ও তাঁর স্ত্রী বর্তমানে কারাগারে। বাইরে থেকে তাঁর অনুসারীরা “রিমোট কিলিং মিশন” চালাচ্ছে। আমরা তাদের শনাক্তের মতো আলামত পেয়েছি।’
তবে আইনশৃঙ্খলা বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামের এই সহিংসতার মূল শিকড় কারাগার ও রাজনীতির যোগসাজশে। ‘অপরাধীরা এখন ভয় পায় না, কারণ তারা জানে, আইন তাদের ধরলেও রাজনীতি ছাড়বে না’, বলেন নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক সিএমপির সাবেক এক অতিরিক্ত কমিশনার।
হঠাৎ আসেনি মোহাম্মদ রায়হানের নাম
বুধবার সরোয়ারকে গুলি করে খুনের ঘটনায় মোহাম্মদ রায়হান জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার ও পুলিশ। তিনি ছোট সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী। তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে। প্রচার আছে, ছোট সাজ্জাদ জেলে যাওয়ার পর তিনিই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এর আগে ২৫ অক্টোবর রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতল বাজারসংলগ্ন এলাকায় গুলিতে খুন হন যুবদল কর্মী আলমগীর আলম। ওই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে রায়হানকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন দেখা যায় তাঁকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে পরিচয় হয় রায়হানের। গত বছরের ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। পুলিশ জানিয়েছে, রায়হানের নামে ৭টি হত্যাসহ ১৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় জোড়া খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
সিএমপির উপ-মিশনার (উত্তর) আমিরুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘বর্তমানে যেসব সন্ত্রাসী চট্টগ্রামে অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছে। হঠাৎ করে এসে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলে যাচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদেরও সখ্য রয়েছে। তারাই এসব নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এ কারণেই মাঠ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হলেও মূলোৎপাটন করা সম্ভব হচ্ছে না।’