ব্রাজিলের বেলেম শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক চুক্তির (ইউএনএফসিসিসি) আওতায় আয়োজিত ৩০তম জলবায়ু সম্মেলনে (কপ৩০) একত্র হয়েছে বিশ্ব। ১০ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত অ্যামাজন অরণ্যের কেন্দ্রস্থলে আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলনটি প্রতীকীভাবে ব্রাজিলেই ফিরেছে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলেই ইউএনএফসিসিসি-র সূচনা হয়েছিল। তাই এবারের সম্মেলন যেন পূর্ণচক্রে ফিরে আসা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র ও জনগোষ্ঠীর সুরক্ষাকে কেন্দ্র করে নতুন করে ভাবার সময়।
এই আয়োজন ঘটছে রেকর্ড গরম, পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূচকবিন্দু (টিপিং পয়েন্ট) অতিক্রম এবং নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে। ফলে কপ৩০ বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—এখন ঐক্যই একমাত্র পথ। উদ্বোধনী বক্তৃতায় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নির্বাহী সচিব সাইমন স্টিল বলেন, ‘কপ-৩০ এর মঞ্চে আপনাদের কাজ একে অপরের সঙ্গে লড়াই নয়, বরং জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করা।’
এ ছাড়া এমন এক সময় এ সম্মেলন হচ্ছে, যখন ক্যারিবীয় অঞ্চল ও এশিয়ায় প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় ও যুদ্ধ এবং বাণিজ্য বিরোধ থেকে শুরু করে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা জলবায়ু পরিবর্তনের ভাবনা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে।
কপ সম্মেলন কী
কপ (সিওপি) বা কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস একটি বৈশ্বিক কূটনৈতিক সম্মেলন। প্রতি বছর এটি ১৯৯২ সালের জলবায়ু চুক্তির অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির মূল নীতি—‘সাধারণ কিন্তু ভিন্ন দায়িত্ব’। এতে ধনী ও শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর উপর বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কপ সম্মেলন শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। এটি কিয়োটো প্রোটোকলের যুগ থেকে বিকশিত হয়ে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির কাঠামোতে পৌঁছায়। এর লক্ষ্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
কপ৩০ কেন গুরুত্বপূর্ণ
এবার কপের ৩০ম সম্মেলনে ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও আদিবাসী নেতারা যোগ দিয়েছেন। এর লক্ষ্য নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়া নয়, বরং পুরনো অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা। যেমন ২০২৩ সালের কপ২৮-এ দেওয়া জীবাশ্ম জ্বালানি ধীরে ধীরে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার নেতৃত্বাধীন আয়োজক দেশ এবার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানোয়। সম্মেলনের আরেকটি লক্ষ্য হলো খনন, কাঠ সংগ্রহ ও কৃষি সম্প্রসারণজনিত বননিধন প্রতিরোধ। অ্যামাজন বনের আদিবাসীরা ৩ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সম্মেলনে অংশ নিতে এসেছে।
মূলত আমাজন বন রক্ষার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে বেলেম শহরে এবারের আয়োজনটি করা হয়েছে। কারণ এই বনই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন শোষক। অথচ কাঠ সংগ্রহ, খনন ও কৃষি শিল্পের কারণে তা ক্রমেই হুমকির মুখে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—এ সম্মেলন ব্যর্থ হলে মানবজাতির প্রয়োজনীয় ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে, যা জলবায়ু বিপর্যয় রোধের জন্য অপরিহার্য।
এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশ্ব ইতোমধ্যেই প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বলেছেন। আর নয়তো পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এখন প্রয়োজন বৈশ্বিক নিঃসরণ কমানোর সুস্পষ্ট কৌশল, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিপুল জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করা এবং বিশ্বনেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
তবে সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুপস্থিতি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ব্রাজিলে, আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের দেশে। অথচ আমরা ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে তাদের প্রতি অসম্মান দেখাচ্ছি—এটা কী হচ্ছে?’
ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ যারা জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা। তিনি বলেন, ‘তারা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর আক্রমণ করছে। এখন সময় এসেছে তাদের আবারও পরাজিত করার।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য এবং উন্নয়নশীল দেশের সমন্বয়ে গঠিত জি৭৭+চায়না ব্লকের জন্য এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলীয় কূটনীতিক আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বলেন, ‘চীন এখন এমন সমাধান দিচ্ছে যা সবার জন্য উপকারী। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি ভালো সংকেত।’
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—এ সম্মেলন ব্যর্থ হলে মানবজাতির প্রয়োজনীয় ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে, যা জলবায়ু বিপর্যয় রোধের জন্য অপরিহার্য।
জলবায়ু বিষয়ক গবেষণায় অস্থির পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি
কপ৩০-এর আগে প্রকাশিত ২০২৫ সালের বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনগুলোতে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে, চরম আবহাওয়া প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে, আর বহু বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে।
আইপিসিসির জুন মাসের আপডেট অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন প্রতি দশকে ০.২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে, যা ১৯৯০-র দশকের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ দ্রুত। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৪.৫ মিলিমিটার করে বাড়ছে, যা বিংশ শতাব্দীর হারের দ্বিগুণ।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, ২০২৫ সাল হবে ইতিহাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় উষ্ণতম বছর। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, এখন বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী তীব্র গরমের ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ‘১.৫ ডিগ্রির সীমা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে তা হবে নৈতিক ব্যর্থতা ও প্রাণঘাতী উদাসীনতা।’
মার্চ ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত দাবানলে ৩.৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বনভূমি পুড়ে গেছে। এতে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে। ইউরোপে ২০২৪ সালের ভয়াবহ গ্রীষ্মে তাপজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৭০০ জন। ২০২৫ সালেও ২৪ হাজার ৪০০ জন মারা গেছে।
দ্য ল্যানসেট-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, তাপের কারণে ২০২৪ সালে কর্মক্ষমতা কমায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
জীববৈচিত্র্য এখন বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। সমুদ্রে উষ্ণ পানির কারণে প্রবালপ্রাচীরের স্থায়ী ধ্বংস শুরু হয়েছে। গবেষকরা সতর্ক করছেন, ১.৫ ডিগ্রি উষ্ণতা অতিক্রম করলে অ্যামাজন অরণ্য ঘাসভূমিতে পরিণত হতে পারে, যা পূর্বাভাসের চেয়েও দ্রুত ঘটছে। গলতে থাকা গ্রিনল্যান্ডের বরফ উত্তর আটলান্টিক স্রোত (এএমওসি) বন্ধ করে দিতে পারে, ফলে ইউরোপের শীত আরও তীব্র হবে।
অন্যদিকে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়ায় সাগরের অন্ধকার জলরাশি আরও বেশি সূর্যালোক শোষণ করছে, যা তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে এবং সমুদ্রের কার্বন শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নাসা ও নোয়া-র বাজেট ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এসব বাস্তবতা জলবায়ু নীতিতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ‘১.৫ ডিগ্রির সীমা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে তা হবে নৈতিক ব্যর্থতা ও প্রাণঘাতী উদাসীনতা।’
বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের সর্বশেষ পরিস্থিতি
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৫ জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে ২০৩৫ সালের মধ্যে (২০১৯ সালের তুলনায়) নিঃসরণ ৩৫ শতাংশ কমাতে হবে। আর ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে চাইলে নিঃসরণ কমাতে হবে ৫৫ শতাংশ। বর্তমান গতিপ্রকৃতি অনুসারে, যদি বড় পরিবর্তন না আসে, তবে ২১০০ সালের মধ্যে উষ্ণতা ২.৫ থেকে ২.৯ ডিগ্রিতে পৌঁছাবে। এতে পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে মহাবিপর্যয়।
গ্লোবাল এনার্জি রিভিউ ২০২৫ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জ্বালানি খাত থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বেড়েছে, যদিও বৃদ্ধি হার কিছুটা ধীর হয়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।
জাতিসংঘের (ইউএনএফসিসিসি) এক আপডেটে বলা হয়েছে, দেশগুলো তাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ ১২ শতাংশ কমতে পারে। কিন্তু ওইসিডির ক্লাইমেট অ্যাকশন মনিটর ২০২৫ সতর্ক করেছে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবায়নের মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে—ফলে নিঃসরণ এখনো রেকর্ড উচ্চতায় রয়ে গেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃসরণকারী দেশ চীন কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখাচ্ছে। কার্বন ব্রিফ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, টানা ১৮ মাস ধরে চীনের কার্বন নিঃসরণ স্থিতিশীল রয়েছে বা কমছে। এর পেছনে রয়েছে ২০২৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে সৌরশক্তিতে ৪৬ শতাংশ ও বায়ুশক্তিতে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এর ফলে মাত্র নয় মাসে যুক্ত হয়েছে ২৪০ গিগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ সক্ষমতা।
কপ৩০-এর সফলতা নির্ভর করছে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তরিত হওয়ার উপর। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ, অভিযোজন তহবিল নিশ্চিত করা এবং কার্বন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করার মতো পদক্ষেপ।
কার্বন ব্রিফ-এর প্রধান বিশ্লেষক লাউরি মাইলিভির্তা বলেন, ‘পুরো বছরজুড়ে চীনের নিঃসরণ কমে যেতে পারে।’ যদিও রাসায়নিক শিল্পে নিঃসরণ এখনো বেশি এবং কিছু খাতে লক্ষ্য পূরণ পিছিয়ে আছে।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের লি শু বলেন, ‘চীনের সাম্প্রতিক জলবায়ু লক্ষ্যগুলোকে সর্বোচ্চ সীমা নয়, বরং প্রাথমিক মান হিসেবে দেখা উচিত’, কারণ অতীতে দেশটি প্রায়ই ঘোষিত লক্ষ্য অতিক্রম করেছে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ব্রাজিল কপ৩০-এ যৌথভাবে একটি কার্বন বাজার জোট গঠন করেছে, যাতে নিঃসরণের ওপর মূল্য নির্ধারণ কার্যকর হয়। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোও এখন কার্বন ট্যাক্স চালুর পরিকল্পনা করছে।
রয়টার্স-এর বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের জলবায়ু নীতি প্রত্যাহার ‘কাজকে বিলম্বিত করতে পারে, তবে থামাতে পারবে না’, কারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে। তবুও ইউএন নিউজ সতর্ক করেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনো ‘মন্থর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
অস্ট্রেলিয়ার রেইনফরেস্ট: কার্বন শোষক থেকে নিঃসরণকারীতে পরিণত
ইতিহাসে প্রথমবার, অস্ট্রেলিয়ার হাজার বছর পুরনো উষ্ণমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট এখন কার্বন শোষণকারী নয়, বরং নিঃসরণকারী উৎসে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশিত হয়।
কুইন্সল্যান্ডের আর্দ্র উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের বন, যা একসময় গাছ বাড়িয়ে অতিরিক্ত কার্বন শোষণ করত, এখন মৃত গাছের কাণ্ড ও ডাল থেকে তা উল্টো নিঃসরণ করছে। প্রতি হেক্টরে বছরে ৪১ কিলোগ্রাম কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। প্রধান গবেষক অধ্যাপক স্যান্ড্রা বেরি বলেন, ‘আমাদের নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার রেইনফরেস্ট আর আগের মতো বেশি কার্বন শোষণ করবে—এই ধারণা ভুল।’
১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্থানীয় উষ্ণতার কারণে তাপপ্রবাহ, খরা ও ঘূর্ণিঝড় এখন আরও ভয়াবহ হয়েছে। ফলে পরিণত গাছগুলো দ্রুত মারা যাচ্ছে, আর নতুন চারা সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারছে না। এভাবে এই বনভূমি প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক পর্যায়ে ‘কার্বন সিঙ্ক’ থেকে ‘কার্বন সোর্স’-এ পরিণত হলো।
দ্য গার্ডিয়ান সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক জলবায়ুতেও এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে, কারণ এই বনগুলো বিপুল কার্বন সংরক্ষণ করতো। ফ্রান্স ২৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের রেইনফরেস্ট আর নেট কার্বন শোষণকারী হিসেবে কাজ করছে না।’
এই পরিস্থিতি অ্যামাজনের বনভূমির মতোই বিপদের ইঙ্গিত দেয়, যা কপ৩০-কে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করছে। দ্য কনভারসেশন-এর বিশেষজ্ঞরা একে বর্ণনা করেছেন ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন শোষক ভাণ্ডারের ক্ষতি’ হিসেবে, যা নিঃসরণ বাড়ার চক্রকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
কপ৩০-এর সফলতা নির্ভর করছে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তরিত হওয়ার উপর। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ, অভিযোজন তহবিল নিশ্চিত করা এবং কার্বন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করার মতো পদক্ষেপ।
সাইমন স্টিল সম্মেলনের মঞ্চে বলেন, ‘অগ্রগতি ঘটে কারণ এমন স্থানেই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাই।’ কিন্তু যখন রেইনফরেস্ট বিদ্রোহ করছে এবং নিঃসরণ আবারও বেড়ে উঠছে, তখন সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। মানবজাতির জন্য এখন সিদ্ধান্তের ঘড়ি জোরে বাজছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, দ্য ডন, ইউরো নিউজ, রয়টার্স, ইউএনএফসিসিসি ওয়েবসাইট