leadT1ad

টিকটক নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের নতুন চাল, চাবিকাঠি কি মিত্রদের হাতে যাচ্ছে

জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটককে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও গণমাধ্যম অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের এক নতুন খেলা শুরু হয়েছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটককে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও গণমাধ্যম অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের এক নতুন খেলা শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।

এই নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকে টিকটকের কার্যক্রম ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক ধনকুবের মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। মিত্রদের তালিকায় রয়েছেন মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক এবং ওরাকলের ল্যারি এলিসনের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্বাহী আদেশ তথ্য প্রচারের ভবিষ্যৎ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও ক্ষমতার মধ্যকার জটিল সমীকরণ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে।

ভূরাজনীতির জটিল আবর্তে এক চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বছরের পর বছর ধরে, মার্কিন আইনপ্রণেতারাই অ্যাপটির চীনা মূল প্রতিষ্ঠান ‘বাইটড্যান্স’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। তাঁদের মূল আশঙ্কা, চীনা সরকার মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার পেতে পারে এবং ব্যবহারকারীরা কী ধরনের কনটেন্ট দেখবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এই উদ্বেগের ফলস্বরূপ গত বছরের ২৪ এপ্রিল কংগ্রেসে একটি দ্বিদলীয় আইন পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী, বাইটড্যান্সকে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের সম্পূর্ণ কার্যক্রম ও মালিকানা একটি মার্কিন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে হবে, নয়তো দেশব্যাপী নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন ও টিকটকের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তির প্রকাশিত শর্ত অনুযায়ী, টিকটকের মার্কিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত একটি নতুন কোম্পানি গঠন করা হবে। এই নতুন সংস্থার সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে ছয়জনই মার্কিন নাগরিক হবেন। ট্রাম্পের বাছাই করা ও প্রকাশ্যে সমর্থনপুষ্ট মার্কিন বিনিয়োগকারীদের একটি কনসোর্টিয়াম এই কোম্পানিতে একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব অর্জন করবে।

সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে ফক্স করপোরেশনের সিইও ও রুপার্ট মারডকের ছেলে ল্যাকলান মারডক এবং ওরাকলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও রিপাবলিকানদের অন্যতম প্রধান অর্থদাতা ল্যারি এলিসনের নাম শোনা যাচ্ছে। ডেল টেকনোলজিসের মাইকেল ডেলের নামও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে উঠে এসেছে।

এই ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট ওরাকল। মার্কিন ব্যবহারকারীদের ডেটা পরিচালনা এবং টিকটকের অত্যন্ত মূল্যবান সুপারিশকারী (ভিডিও রিকমেন্ডেশন) অ্যালগরিদম লাইসেন্স করার দায়িত্ব থাকবে ওরাকলের হাতে।

এই ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট ওরাকল। মার্কিন ব্যবহারকারীদের ডেটা পরিচালনা এবং টিকটকের অত্যন্ত মূল্যবান সুপারিশকারী (ভিডিও রিকমেন্ডেশন) অ্যালগরিদম লাইসেন্স করার দায়িত্ব থাকবে ওরাকলের হাতে।

হোয়াইট হাউস ইঙ্গিত দিয়েছে যে চুক্তিটি চূড়ান্ত এবং ট্রাম্প নিজেও দাবি করেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর কথা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার হুমকি থেকে মধ্যস্থতাকারী: ট্রাম্পের ভোলবদল

টিকটককে বাঁচানোর চুক্তির প্রধান রূপকার হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান ভূমিকা তাঁর আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথম মেয়াদে, ট্রাম্প ছিলেন এই অ্যাপের সবচেয়ে সোচ্চার বিরোধী। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট তিনি টিকটককে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এর মার্কিন কার্যক্রম বিক্রি করতে বাধ্য করার জন্য নির্বাহী আদেশ জারি করেন। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি ছিল, চীনা সরকার বাইটড্যান্সকে মার্কিন ব্যবহারকারীদের ডেটা হস্তান্তর করতে বাধ্য করতে এবং প্ল্যাটফর্মটিকে অপপ্রচারের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

ট্রাম্পের এই ভোলবদলের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ও কৌশলগত বিবেচনা। এপি নিউজের এক বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে, একসময় টিকটকের ‘ঘাতক’ হতে চাওয়া ট্রাম্পের এখন স্বঘোষিত ‘ত্রাতা’ হয়ে ওঠার বিষয়টি তাঁর লেনদেনভিত্তিক নীতি এবং রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানের চতুরতারই প্রমাণ দেয়।

তবে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পের বক্তব্যে একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে। ট্রাম্প প্ল্যাটফর্মটির প্রতি নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করেন। ওই বছর ১ জুন ট্রাম্প নিজেও টিকটকে যোগ দিয়ে বিপুলসংখ্যক ফলোয়ারও অর্জন করেন।

ট্রাম্পের এই ভোলবদলের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ও কৌশলগত বিবেচনা। এপি নিউজের এক বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে, একসময় টিকটকের ‘ঘাতক’ হতে চাওয়া ট্রাম্পের এখন স্বঘোষিত ‘ত্রাতা’ হয়ে ওঠার বিষয়টি তাঁর লেনদেনভিত্তিক নীতি এবং রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানের চতুরতারই প্রমাণ দেয়।

কেন টিকটকের নিয়ন্ত্রণ চান ট্রাম্প

টিকটকের নিয়ন্ত্রণ নিতে ট্রাম্পের এই উদ্যোগের পেছনের উদ্দেশ্যগুলো জটিল ও বহুমাত্রিক। টিকটকের ওপর নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার মূলে রয়েছে গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রবল সম্ভাবনা। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র রুপার্ট মারডক ও ল্যারি এলিসন যদি টিকটকের নেতৃত্ব পেয়ে যান, তবে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া এই প্ল্যাটফর্ম ট্রাম্পের প্রচারণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্প ও ট্রাম্প প্রশাসনের আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে টিকটকের ব্যবহার বড় ধরনের অস্ত্র হিসেবে হাজির হতে পারে।

টিকটকের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহের আরেকটি বড় কারণ হলো তরুণদের কাছে এর আবেদন ও আকর্ষণ। এই ভোটারগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীদের জন্য কঠিন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের ১৭ কোটি ব্যবহারকারীর বেশিরভাগের বয়স ৩০-এর নিচে। তাঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটি একটি সরাসরি ও সেন্সরবিহীন মাধ্যম।

ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণের ঝুলিতে টিকটক যুক্ত হলে তা প্রচলিত সম্প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জগৎ পর্যন্ত গণমাধ্যমের ক্ষমতার এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটাবে। সমালোচকদের দাবি, এর মাধ্যমে জনমত গঠন ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা সম্ভব। প্ল্যাটফর্মটির শক্তিশালী অ্যালগরিদম, যা নির্ধারণ করে ব্যবহারকারীরা কোন কনটেন্ট দেখবেন, সেটিকে সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করে ট্রাম্পপন্থী বয়ান প্রচার ও ভিন্নমতকে দমন করা হতে পারে।

টিকটকের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহের আরেকটি বড় কারণ হলো তরুণদের কাছে এর আবেদন ও আকর্ষণ। এই ভোটারগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীদের জন্য কঠিন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের ১৭ কোটি ব্যবহারকারীর বেশিরভাগের বয়স ৩০-এর নিচে। তাঁদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটি একটি সরাসরি ও সেন্সরবিহীন মাধ্যম।

ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন যে, ২০২৪ সালের প্রচারণায় এই প্ল্যাটফর্মটি তাঁকে তরুণ ভোটারদের মধ্যে সমর্থন তৈরিতে সহায়তা করেছে। মিত্রদের মালিকানার অধীনে টিকটকের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করে ট্রাম্প কেবল নির্বাচনী হাতিয়ারই পাচ্ছেন না, বরং নিজেকে ‘টিকটককে বাঁচানো প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেও তুলে ধরছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, টিকটকের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য ট্রাম্পের এই চাল আসলে তাঁর রাজনৈতিক জুয়া।

টিকটকের প্রতি ট্রাম্পের এই সমর্থনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বিরোধও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ট্রাম্প বারবার ফেসবুককে ‘গণশত্রু’ বলে আক্রমণ করেছেন।

মিত্রদের হাতে টিকটককে রাখার এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে, ট্রাম্প একই সঙ্গে একদিকে ফেসবুককে দুর্বল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জগতে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, টিকটকের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য ট্রাম্পের এই চাল আসলে তাঁর রাজনৈতিক জুয়া। এই প্রজন্মের চেতনাকে ধারণ করা টিকটক প্ল্যাটফর্মের শক্তিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা মূলত ট্রাম্পের গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। পাশাপাশি তরুণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে চতুর রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ। তবে প্রস্তাবিত এই চুক্তি বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের ক্ষমতা এবং রাজনীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঝাপসা হয়ে যাওয়া সীমারেখা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এপি নিউজ, রয়টার্স, বিবিস, পলিটিকো এবং এবিসি নিউজ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত