leadT1ad

ইসরায়েল কেন ব্যবহার করতে পারবে না মাইক্রোসফটের প্রযুক্তি

ফিলিস্তিনিদের ওপর গণনজরদারিতে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মাইক্রোসফট।

স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা
ফিলিস্তিনিদের ওপর গণনজরদারিতে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে সমালোচনার মুখে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মাইক্রোসফট। স্ট্রিম গ্রাফিক

ফিলিস্তিনিদের ওপর গণনজরদারিতে নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মাইক্রোসফট। মার্কিন এই প্রযুক্তি জায়ান্ট ইসরায়েলের এলিট গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইউনিট ৮২০০’-এর জন্য তাদের অ্যাজুর ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) পরিষেবাগুলোর একাংশ বাতিল করে দিয়েছে।

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো তিন বছরব্যাপী এক বিশাল নজরদারি কর্মসূচির অবসান ঘটল।

অ্যাজুর ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম: যে প্রযুক্তি নিয়ে এত আলোচনা

মাইক্রোসফট অ্যাজুর হলো একটি ক্লাউড কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম, যা ব্যবহারকারীদের ডেটা বা তথ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় সীমাহীন স্টোরেজ ও কম্পিউটিং শক্তি সরবরাহ করে।

মাইক্রোসফট অ্যাজুর হলো একটি ক্লাউড কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম, যা ব্যবহারকারীদের ডেটা বা তথ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় সীমাহীন স্টোরেজ ও কম্পিউটিং শক্তি সরবরাহ করে।

এই প্ল্যাটফর্মে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করা সম্ভব। মূলত বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য তৈরি এই প্ল্যাটফর্মের অন্যতম গ্রাহক ছিল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০২১ সালে মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা এবং ইউনিট ৮২০০-এর তৎকালীন কমান্ডার ইয়োসি সারিয়েলের মধ্যে একটি বৈঠকের পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়।

ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি ও গাজা হামলায় অ্যাজুরের ব্যবহার

ইসরায়েলের ‘ইউনিট ৮২০০’ গোয়েন্দা সংস্থাটি মাইক্রোসফটের অ্যাজুর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী গণনজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা পশ্চিম তীর ও গাজার লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকের ফোনকল রেকর্ড করত।

অ্যাজুরের বিপুল স্টোরেজ ও এআই ক্ষমতা ব্যবহার করে রেকর্ড করা কলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা হতো। সেগুলো বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা তথ্য বের করা হতো। গোয়েন্দা সূত্রমতে, এই ক্লাউড-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মটি পরবর্তী সময়ে গাজায় বিমান হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও হামলার প্রস্তুতি সহজ করতেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

এই কর্মসূচির ব্যাপকতা বোঝা যায়, ইউনিট ৮২০০-এর ভেতরে ‘প্রতি ঘণ্টায় দশ লক্ষ কল’ স্লোগান থেকে। অ্যাজুরের বিপুল স্টোরেজ ও এআই ক্ষমতা ব্যবহার করে রেকর্ড করা কলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা হতো। সেগুলো বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা তথ্য বের করা হতো। গোয়েন্দা সূত্রমতে, এই ক্লাউড-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মটি পরবর্তী সময়ে গাজায় বিমান হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও হামলার প্রস্তুতি সহজ করতেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

যেভাবে ফাঁস হলো গোপন আঁতাতের তথ্য

ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ প্রথম এই গোপন আঁতাতের তথ্য ফাঁস করে। ‘+৯৭২ ম্যাগাজিন’ এবং হিব্রু ভাষার গণমাধ্যম ‘লোকাল কল’-এর সাথে যৌথভাবে পরিচালিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তারা প্রকাশ করে, কীভাবে ইউনিট ৮২০০ ফিলিস্তিনিদের ফোন কলের বিশাল ডেটাবেস সংরক্ষণের জন্য অ্যাজুর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে।

এই প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত মাইক্রোসফটের একটি ডেটাসেন্টারে প্রায় ৮,০০০ টেরাবাইট সমপরিমাণ কল রেকর্ডের ডেটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

মাইক্রোসফটের অস্বীকার ও অভ্যন্তরীণ চাপ

গার্ডিয়ানের প্রথম প্রতিবেদনের পর মাইক্রোসফট একটি অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা শুরু করে। তবে চলতি বছরের মে মাসে তারা জানায় যে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের পরিষেবার শর্ত লঙ্ঘন করেছে বা গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য অ্যাজুর এবং এর এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে — এমন কোনো প্রমাণ তারা খুঁজে পায়নি। কিন্তু মাইক্রোসফটের এই বক্তব্যে বিতর্ক থামেনি। কোম্পানির ভেতরে ও বাইরে তীব্র চাপ তৈরি হয়।

চলতি বছরের আগস্ট মাসে গার্ডিয়ান এবং তার সহযোগীরা নতুন আরেকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা মাইক্রোসফটকে তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। এই তদন্তে স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করা হয় যে, ক্লাউড-ভিত্তিক নজরদারি প্রকল্পটি সরাসরি গাজায় বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু গবেষণা ও শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

‘নো অ্যাজুর ফর অ্যাপার্টহাইড’ নামে মাইক্রোসফটের কর্মীদের একটি গোষ্ঠী ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। এই বিক্ষোভগুলো কোম্পানির মার্কিন সদর দপ্তর এবং ইউরোপের ডেটাসেন্টারগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।

গার্ডিয়ানের দ্বিতীয় তদন্ত

চলতি বছরের আগস্ট মাসে গার্ডিয়ান এবং তার সহযোগীরা নতুন আরেকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা মাইক্রোসফটকে তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। এই তদন্তে স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করা হয় যে, ক্লাউড-ভিত্তিক নজরদারি প্রকল্পটি সরাসরি গাজায় বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু গবেষণা ও শনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর মাইক্রোসফটের সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। তারা আশঙ্কা করেন যে, প্রথম পর্যালোচনার সময় তাদের ইসরায়েলি কর্মীরা হয়তো পুরো সত্য প্রকাশ করেনি।

চাপের মুখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও পরিষেবা বাতিল

গার্ডিয়ানের নতুন প্রতিবেদনের পর মাইক্রোসফট মার্কিন আইন সংস্থা ‘কভিংটন অ্যান্ড বার্লিং’-এর তত্ত্বাবধানে আরও একটি পর্যালোচনা শুরু করে। পর্যালোচনার প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতেই মাইক্রোসফট ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের জানায় যে, ইউনিট ৮২০০ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণনজরদারি চালিয়ে তাদের পরিষেবার শর্ত লঙ্ঘন করেছে।

পর্যালোচনার প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতেই মাইক্রোসফট ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের জানায় যে, ইউনিট ৮২০০ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণনজরদারি চালিয়ে তাদের পরিষেবার শর্ত লঙ্ঘন করেছে।

এরপরই কোম্পানির ভাইস-চেয়ার ও প্রেসিডেন্ট ব্র্যাড স্মিথ কর্মীদের পাঠানো এক ইমেইলে জানান যে, মাইক্রোসফট ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই ইউনিটের জন্য ক্লাউড স্টোরেজ এবং এআই পরিষেবাসহ কয়েকটি পরিষেবা বাতিল ও নিষ্ক্রিয় করেছে। স্মিথ আরও বলেন, ‘আমরা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণনজরদারি সহজ করার জন্য কখনোই প্রযুক্তি সরবরাহ করি না।’

যদিও এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে মাইক্রোসফটের অন্যান্য বাণিজ্যিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না, তবে এটি গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কোনো মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির প্রথম প্রকাশ্য পদক্ষেপ।

(ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অবলম্বনে)

Ad 300x250

সম্পর্কিত