leadT1ad

মিডিয়া ফ্লোটিলা কী, কারা এবং কেন আয়োজন করেছেন

মিডিয়া ফ্লোটিলা একদিকে বৈশ্বিক প্রতিরোধের প্রতীক, অন্যদিকে সংহতির প্রকাশ। তবে এগুলো প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধ, ড্রোন হামলা বা জাহাজে চড়াও হওয়ার মতো ঝুঁকির মুখে পড়ে। বিশিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন জলবায়ু আন্দোলনের কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এবং বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহীদুল আলম।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩২
শহীদুল আলম ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালি থেকে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় যোগ দেবেন। স্ট্রিম গ্রাফিক

মিডিয়া ফ্লোটিলা হলো এক ধরনের নৌ-যাত্রা। ফিলিস্তিনের গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এর আয়োজন করেন। সাধারণ সাহায্যবাহী নৌবহর যেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ায় মনোযোগী, সেখানে মিডিয়া ফ্লোটিলার লক্ষ্য মূলত তথ্যের অবরোধ ভাঙা। ইসরায়েল অধিকাংশ বিদেশি সাংবাদিককে গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়। ২০০৭ সাল থেকেই ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় আন্তর্জাতিক পর্যযবেক্ষকদের প্রবেশ কার্যত সীমিত।

অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি উপকূলে পৌঁছে সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এর মধ্যে রয়েছে মানবিক বিপর্যয়, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও অবরুদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবন। এই মিশনগুলো সমন্বয় করে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এএফসি), যা বিভিন্ন নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে (অক্টোবর ২০২৩) এ ধারণাটি আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৬৬ হাজারে পৌঁছেছে। গাজায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা আধুনিক কালের যে কোনও যুদ্ধের চেয়ে বেশি।

মিডিয়া ফ্লোটিলা একদিকে বৈশ্বিক প্রতিরোধের প্রতীক, অন্যদিকে সংহতির প্রকাশ। তবে এগুলো প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধ, ড্রোন হামলা বা জাহাজে চড়াও হওয়ার মতো ঝুঁকির মুখে পড়ে।

বিশিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন জলবায়ু আন্দোলনের কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এবং বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহীদুল আলম। তাদের উপস্থিতি এসব যাত্রাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত করে তোলে। থুনবার্গ ও শহিদুল আলম তরুণ প্রজন্ম এবং গ্লোবাল সাউথের অংশগ্রহণকে প্রতিফলিত করেন।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় গ্রেটা থুনবার্গ এবং তার সতীর্থরা। ছবি: সংগৃহীত।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় গ্রেটা থুনবার্গ এবং তার সতীর্থরা। ছবি: সংগৃহীত।

ফ্রিডম ফ্লোটিলা থেকে মিডিয়া ফ্লোটিলা

মিডিয়া ফ্লোটিলার শিকড় রয়েছে গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা আন্দোলনে। এর সূচনা হয় ২০০৮ সালে, যখন ফ্রি গাজা মুভমেন্ট ছোট নৌযান পাঠায় সাহায্য ও কর্মী নিয়ে। সবচেয়ে বড় সংঘাত ঘটে ২০১০ সালের মে মাসে। তখন ছয়টি জাহাজের বহর ফ্রিডম ফ্লোটিলা-১ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মুখে পড়ে। তুরস্কের আইএইচএইচ হিউম্যানিটেরিয়ান রিলিফ ফাউন্ডেশন এর নেতৃত্বে পাঠানো ওই বহরে ছিল ৭০০ কর্মী ও ১০ হাজার টন সাহায্যসামগ্রী।

আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি কমান্ডোরা হামলা চালালে এমভি মাভি মারমারা জাহাজে নয়জন তুর্কি কর্মী নিহত হন। সব জাহাজ জব্দ করা হয়। এ ঘটনাটি ‘গাজা ফ্লোটিলা রেইড’ নামে পরিচিত এবং বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে। এরপরই ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)।

পরবর্তী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভিযান ছিল—

২০১১ (ফ্রিডম ফ্লোটিলা ২)। দুটি জাহাজ যাত্রা শুরু করলেও ইসরায়েলি চাপের মুখে গ্রিস তা আটকে দেয়।

২০১৫ (ফ্রিডম ফ্লোটিলা ৩)। একটি জাহাজ গাজার জলসীমায় পৌঁছালেও ফেরত পাঠানো হয়।

২০১৬ (উইমেন্স বোট টু গাজা)। নোবেলজয়ী মাইরেড ম্যাগুয়ারসহ নারীদের দলটি আটক হয়।

২০২৫ সালের মিশন। জুনে একটি বহর আটক করা হয়।

ইয়াসেমিন আকার, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। ছবি: সংগৃহীত।
ইয়াসেমিন আকার, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। ছবি: সংগৃহীত।

এরপর ৩০ আগস্ট ইতালির কাতানিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে এখন চলমান ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। ‘সুমুদ’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ প্রতিরোধ। এতে ৪৫টি দেশের প্রায় ৫০০ কর্মী ৫২টি জাহাজে যাত্রা করেন। প্রতীকী সহায়তা হিসেবে আছে চাল ও চিকিৎসাসামগ্রী। এটি ইতিহাসে এ ধরণের বৃহত্তম বেসামরিক নেতৃত্বাধীন কনভয়।

মিডিয়া ফ্লোটিলার ধারণাটি আসে পরবর্তী সময়ে। প্রাথমিক মিশনগুলোতে সাংবাদিক থাকলেও ২০২০-এর দশকে আলাদা করে মিডিয়া ফ্লোটিলা চালু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সাংবাদিকদের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করা, যা ২০২৩ সালের হামাস হামলার পর আরও কড়াকড়ি হয়।

এখন এসব মিশনে সরাসরি সম্প্রচার, স্যাটেলাইট সংযোগ ও নৌযান থেকেই নথিপত্র প্রচারের ব্যবস্থা থাকে। ফলে গাজার কণ্ঠস্বর বৈশ্বিকভাবে পৌঁছে যায়।

বর্তমান (সেপ্টেম্বর ২০২৫) মিডিয়া ফ্লোটিলায় ৪৫ দেশের ১০০-এর বেশি সাংবাদিক ও চিকিৎসক অংশ নিয়েছেন। তারা একটি বড় জাহাজ ও ১০টি ছোট নৌযানে মূল বহরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

মিডিয়া ফ্লোটিলা কীভাবে কাজ করে

মিডিয়া ফ্লোটিলা সংগঠিত করতে দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ কাজটি করে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি)। তারা বিশ্বজুড়ে স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করে। অংশগ্রহণকারীদের শান্তিপূর্ণ নীতিতে অটল থাকতে হয়। তাদের মিডিয়া নীতি, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আইনে আইনি অধিকার নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

একটি মিডিয়া ফ্লোটিলার ধাপগুলো হলো:

নিরপেক্ষ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু। সাধারণত ইতালি, স্পেন বা তিউনিসিয়ার মতো দেশ বেছে নেওয়া হয়।

বহর আকারে যাত্রা। ইয়ট, মাছ ধরার নৌকা এবং ছোট সাহায্যবাহী জাহাজ একত্রে চলে। এরা ভারী পণ্য নয়, বরং ক্যামেরা, ড্রোন ও স্যাটেলাইট সরঞ্জাম বহন করে।

গাজার দিকে অগ্রসর হওয়া। লক্ষ্য থাকে ২০ নটিক্যাল মাইল দূরের অবরোধ অঞ্চলে পৌঁছানো। পথে সরাসরি সম্প্রচার করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।

নথিভুক্তকরণ ও প্রচার। ইসরায়েলি জাহাজের মুখোমুখি হওয়া, ফিলিস্তিনিদের সাক্ষাৎকার (যদি নামা সম্ভব হয়) এবং অবরোধের প্রভাব তুলে ধরা হয়। এগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

অর্থায়ন হয় অনুদান ও এনজিওর সহায়তায়। প্রতিজনের খরচ প্রায় ৫ হাজার ১০ হাজার ইউরো। আইনি চ্যালেঞ্জে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন ব্যবহার করা হয়। এতে বলা হয়, অবরোধ নৌচলাচলের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।

গত শুক্রবার গাজাগামী জাহাজ বহর ক্রিট দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছোট দ্বীপ কাউফোনিসিয়ায় নোঙর ফেলেছে। ছবি: সংগৃহীত।
গত শুক্রবার গাজাগামী জাহাজ বহর ক্রিট দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছোট দ্বীপ কাউফোনিসিয়ায় নোঙর ফেলেছে। ছবি: সংগৃহীত।

উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণকারী

গ্রেটা থুনবার্গ: সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ২০২৫ সালের জুনে একটি ফ্লোটিলায় যোগ দেন। তার সঙ্গী ছিলেন ফরাসি এমইপি রিমা হাসান ও জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ। ড্রোন হামলার পর সেই মিশন ব্যর্থ হয়। তাকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়। লাইভস্ট্রিমে তিনি গাজা অবরোধকে ‘গণহত্যা’ বলেন এবং বৈশ্বিক অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে যুক্ত করেন। সেপ্টেম্বরে তিনি আবারও অংশ নেন। তবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরে তাকে নেতৃত্ব কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার অংশগ্রহণ ইউরোপের সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

শহিদুল আলম: বাংলাদেশের খ্যাতনামা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ২৭ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন যে তিনি গাজা মিডিয়া ফ্লোটিলায় যোগ দেবেন। এ লক্ষ্যে তিনি ইতিমধ্যেই ইতালির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ইতালির স্থানীয় সময় ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি এতে যোগ দেবেন। তার লক্ষ্য গাজার গণহত্যা নথিভুক্ত করা।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘গাজায় গণহত্যা চলছে। ইসরায়েল ও আমেরিকা একসঙ্গে মানুষ হত্যা করছে। অনেক পশ্চিমা দেশও এতে জড়িত। তারা সহযোগিতা করছে এবং এ অপরাধের অংশীদার। তবে সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। সেই প্রতিবাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমি আগামীকাল মিডিয়া ফ্লোটিলায় যোগ দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে যাচ্ছি। তবে আমি বিশ্বাস করি আমি বাংলাদেশের সকল মানুষের ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। এই সংগ্রামে সকলের আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। আমরা যদি এই সংগ্রামে পরাজিত হই, তবে মানবতাই পরাজিত হবে।’

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার গতিপথ। ছবি: সংগৃহীত।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার গতিপথ। ছবি: সংগৃহীত।

চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি

মিডিয়া ফ্লোটিলা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১০ সালের হামলার পর থেকে অন্তত ২০টিরও বেশি মিশন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান ফ্লোটিলা ইতোমধ্যে দুটি ড্রোন হামলার মুখোমুখি হয়েছে। এতে ইতালি ও স্পেনের নৌবাহিনী এগিয়ে আসে। অংশগ্রহণকারীরা গ্রেফতার, বহিষ্কার বা আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। মিশর ও তিউনিসিয়া নিরাপত্তার অজুহাতে বন্দর প্রবেশে বাধা দেয়।

সমালোচকরা এগুলোকে ‘উসকানি’ বলেন। তবে সমর্থকরা মনে করেন, এটি অবরোধের অবৈধতা প্রকাশ করে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, যেমন থুনবার্গের ভূমিকা নিয়ে বিরোধ, সমন্বয়ের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

২৮ সেপ্টেম্বর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা গাজার উপকূলে ‘উচ্চ ঝুঁকি অঞ্চলে’ অবস্থান করছে। যুদ্ধবিরতি আলোচনার স্থবিরতার মাঝেও মিডিয়া ইউনিট চেষ্টা করছে অবরোধ ভাঙার। এফএফসি ঘোষণা করেছে, অক্টোবরে আরও মিশন হবে। লক্ষ্য শুধু গাজায় পৌঁছানো নয়, বিশ্বে সচেতনতা বাড়ানো।

২০২৫ সালের প্রচেষ্টায়ই তারা সামাজিক মাধ্যমে ১০০ কোটির বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মিডিয়া ফ্লোটিলা সাংবাদিকতা ও আন্দোলনের সমন্বয় ঘটায়। থুনবার্গের আবেদন ও শহিদুল আলমের ছবির মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বার্তা যায়— দৃশ্যমানতাই প্রতিরোধ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত