leadT1ad

লালমনিরহাট নিয়ে কেন এতো আলোচনা

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ০৩
শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে ভারত ৩টি নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

রংপুর বিভাগের সীমান্ত জেলা লালমনিরহাট দীর্ঘদিন শান্ত একটি সীমান্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তবে সম্প্রতি সীমান্তের কাছে ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি ও সীমান্ত উত্তেজনার খবরে এটি আবারও আলোচনায় এসেছে। ঢাকা থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ জেলার সঙ্গে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৮২ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে।

শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে ভারত ৩টি নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তিনটি ঘাঁটিই বাংলাদেশ সীমান্তলাগোয়া। এর একটি আসামের ধুবরির বামুনিতে, যা লালমনিরহাট কাছে। আরেকটি বিহারের কিষাণগঞ্জে। এটি ঠাকুরগাঁওয়ের কাছে। তৃতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়, যা বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের পাশে।

বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারতের এই সামরিক তৎপরতা নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন লালমনিরহাটে সীমান্তের ৬২ কিলোমিটার ভারতের দখলে চলে গেছে বলে একটি গুজবও ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সীমান্তবর্তী অবস্থান, পুরোনো অবকাঠামো ও স্বাভাবিক ভূপ্রকৃতি মিলিয়ে অঞ্চলটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিমানঘাঁটি সম্প্রসারণ, জমি দখল নিয়ে গুঞ্জন এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য—এসব বিষয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আধুনিক লালমনিরহাটের ইতিহাস ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। তৎকালীন পশ্চিম রেলওয়ের সদর দপ্তর ছিল এখানে, যা অবিভক্ত বাংলায় বাণিজ্য ও যাতায়াতের বড় কেন্দ্র ছিল। জেলার নামটি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি লালমনির নাম থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, যদিও লোককথায় ভিন্নতা আছে।

প্রশাসনিকভাবে ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর রংপুর জেলার অংশ থেকে নতুন জেলা হিসেবে গঠিত হয়। এতে পাঁচটি উপজেলা, দুটি পৌরসভা এবং অসংখ্য গ্রাম রয়েছে। ধান, পাট ও তামাক এখানকার প্রধান কৃষিপণ্য।

এ জেলার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো লালমনিরহাট এয়ারড্রোম। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশরা ১ হাজার একরেরও বেশি এলাকায় একে একটি সামরিক বিমানঘাঁটি হিসেবে নির্মাণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯–১৯৪৫) মিত্রবাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানবিরোধী অভিযানে এ ঘাঁটি ব্যবহার করে। মিয়ানমারে পণ্য পরিবহন এবং নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগেও এটি ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঘাঁটিটি অচল হয়ে পড়ে এবং বর্তমানে এটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও এই সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছিল। পরবর্তী দশকে অঞ্চলটি মূলত কৃষি ও পরিবহননির্ভর এলাকাতেই সীমিত থাকে।

ঐতিহাসিক ও কৌশলগত গুরুত্ব

অতীতে লালমনিরহাটের গুরুত্ব ছিল যোগাযোগব্যবস্থা ও সীমান্ত অঞ্চল হিসেবে ভূমিকার জন্য। জেলাটি উত্তরাঞ্চলকে দেশের অন্যান্য অংশ ও ভারতের সঙ্গে রেলপথে যুক্ত করত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমানঘাঁটি প্রমাণ করে যে এখানকার সমতল ভূমি বিমানচালনার জন্য অনুকূল। অঞ্চলটি হিমালয়ের পাদদেশ ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মধ্যে অবস্থিত।

কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও অঞ্চলটির অবস্থান গুরুত্ববহ। লালমনিরহাট ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ১২-১৫ কিলোমিটার দূরে। এর সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে ৩৪৫ কিলোমিটার।

লালমনিরহাটের অবস্থান ভারতের ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোরের দিকে মুখোমুখি। শিলিগুড়ি করিডর পশ্চিমবঙ্গের একটি সরু ভূখণ্ড। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২২ থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এর সবচেয়ে সরু অংশের প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার। এই ভূখণ্ডটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে এবং এর আকৃতি মুরগির ঘাড়ের মতো।

এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আটটি রাজ্যের একমাত্র স্থলপথ সংযোগ। রাজ্যগুলোতে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ বাস করে এবং বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। করিডরটি নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও চীনের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এটি ভারতের জন্য একটি ‘জগ্যুলার ভেইন’ বা নাজুক শিরা হিসেবে বিবেচিত।

করিডোরটি বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, ফলে আশপাশের যে কোনো সামরিক স্থাপনা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদী—যা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী—কৃষি, পানি প্রবাহ, বন্যা ও জলবিদ্যুৎসহ নানা বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা, চোরাচালান বা অনুপ্রবেশের ঝুঁকিও বাড়ায়।

বাংলাদেশের জন্য এ জেলা উত্তরাঞ্চলের প্রতিরক্ষা লাইন। বন্যা মোকাবিলা ও সীমান্তবর্তী এলাকায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতেও এটি সহায়ক।

বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত হলে তা বেসামরিক বিমান চলাচল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বা সামরিক টহলে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত এমন অঞ্চলে যেখানে জাতিগত উত্তেজনা বা সীমান্তপারের অস্থিরতা দেখা যায়।

বর্তমান আলোচনার কেন্দ্র: বিমানঘাঁটি, জমি দখল ও আঞ্চলিক প্রস্তুতি

সাম্প্রতিক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে নিষ্ক্রিয় লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি পুনর্বাসনের পরিকল্পনা থেকে। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম একে দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাব্য ‘সবচেয়ে বড় ঘাঁটি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটিটির উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা স্বীকার করেছে। সেখানে নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারও স্থাপন করা হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও সংযোগ উন্নয়নের জন্য দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য অবকাঠামো, আক্রমণাত্মক নয়।

লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু করলে ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ হিসেবে ভারত তাদের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহরের তিন দশকের পুরোনো বিমানঘাঁটি চালু করবে বলে গত মে মাসে জানায় ভারতীয় গণমাধ্যম।

ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে এ ঘাঁটির অবস্থান শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি হওয়ায়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ভারত এটিকে কৌশলগত দৃষ্টিতে দেখছে।

জবাবে ভারত আসামের ধুবড়িতে লাচিত বরফুকান মিলিটারি স্টেশন চালু করেছে। এখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ সেনা মোতায়েন রয়েছে। স্টেশনটি তাদের চতুর্থ কোরের অধীনে সীমান্ত নজরদারি ও গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড শক্তিশালী করে। ঘাঁটিটি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে সামগ্রিক প্রতিরক্ষা জোরদারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এ ছাড়া বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততাও ভারতের উদ্বেগের কারণ। বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে চীনকে পুরো তিস্তা প্রকল্প দেওয়ার চিন্তা করছে। শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চীনের এই সম্ভাব্য অবস্থানকে ভারত এক ধরনের হুমিক হিসেবেই দেখছে। এটাও সীমান্তে তাদের সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর একটা কারণ হতে পারে।

এ সময় সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্যও ছড়িয়েছে। ভারত নাকি লালমনিরহাটে ৬২ কিলোমিটার এলাকা ‘দখল করেছ’—এমন ভুয়া খবর ছড়ানো হয়। রাজনৈতিক পরিবর্তন ও আঞ্চলিক উত্তেজনার সময় এমন ভুল তথ্য আরও দ্রুত ছড়ায়।

বিজিবি এই দাবিকে সরাসরি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক বলে নাকচ করেছে। ঘটনা কী তা জানতে লালমনিরহাট বিজিবির কর্মকর্তারা সরেজমিনে সীমান্তে পরিদর্শনও করেন। লালমনিরহাটের ৭৮ কিলোমিটার এবং কুড়িগ্রামে কিছু অংশ নিয়ে বিজিবি ব্যাটালিয়ন ১৫ এর আওতায় রয়েছে। তারা জানায় ভারতের জমি দখলের খবর পুরোপুরি গুজব।

সীমান্ত এলাকার গ্রামবাসীরাও জানান, ভারতের সৈন্য সমাবেশ বা অনুপ্রবেশের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে সীমান্তের কাছে যাদের বাড়িঘর ও জমিজমা আছে এবং মাঠে চাষাবাদ ও কাজকর্মে নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাদের অভিজ্ঞতা হলো ভারতীয় বিএসএফ বেশ কড়া পাহারা দিচ্ছে।

গত বছরের ৫ই আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএএসফের বাড়তি সতর্কতা দেখা গেছে। সীমান্তে বিএসএফএর টহল এবং জনবল বাড়ানো হয়েছে।

কেন এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে

একদিকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক সক্ষমতা জোরদারে করা বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চাপ, যা আবার চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে লালমনিরহাটে বিমানঘাঁটির সম্ভাব্য পুনরুজ্জীবনকে ভারত বাংলাদেশের নতুন অংশীদার খোঁজার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানি বিরোধ, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও পুরোনো ভূরাজনৈতিক স্মৃতি। ফলে স্বাভাবিক অবকাঠামো উন্নয়নও বড় ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়। এত ভারতীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা হয়।

তবে বাংলাদেশের কাছে এটি আত্মরক্ষার সক্ষমতা তৈরির পদক্ষেপ। আর পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সবমিলিয়ে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে লালমনিরহাট সবসময়ই ভারতের নজরদারির কেন্দ্রে থাকবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত