.png)

সুমন সুবহান

লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত জলপথ, যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুদান লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায়, তার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সরাসরি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত লোহিত সাগরে প্রভাব বিস্তার করে বৈশ্বিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান হামলা মোকাবিলা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের ভূ-কৌশলগত অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে। কেন না হুতিদের হামলা লোহিত সাগরকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক শিপিং রুটে পরিণত করেছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য সরাসরি হুমকি। আর এই কারণে লোহিত সাগরের রাজনীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সুদানের সংকটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলে বন্দর ও সামরিক ঘাঁটির নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য রুটে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। এজন্য আমিরাতের যা দরকার:
লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত সুদানের পোর্ট সুদান অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। কারণ সুয়েজ খাল ও বাব এল মান্দেব (লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্ত) প্রণালির মধ্যে এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইচ্ছে এই এলাকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। এই লক্ষ্যে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একটি আমিরাতি কনসোর্টিয়াম লোহিত সাগরে আবু আমামা বন্দর উন্নয়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই অঞ্চলে সোমালীয় জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি সুরক্ষিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের লোহিত সাগর অঞ্চলে সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যাওয়ার গভীর লক্ষ্য রয়েছে। অতীতে কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে সুদানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য উদ্বেগের কারণ। তবে সুদানের ইসলামপন্থি শাসন অবসানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত তার প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে ইয়েমেন ও হর্ন অব আফ্রিকার উপকূলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখে আমিরাত তার প্রভাব বলয় প্রসারিত করতে চাচ্ছে। এজন্য সুদানে সংঘাতের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ('হেমেতি' নামে বেশি পরিচিত) এর র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সমর্থন দিয়ে এ অঞ্চলে তার পছন্দসই রাজনৈতিক গতিপথ তৈরির চেষ্টা করছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের লক্ষ্য লোহিত সাগর অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও জলদস্যুতা মোকাবেলার অজুহাতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি সুরক্ষিত করা। সুদানের সংঘাত তাদেরকে এই অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে। যেমন :
১. আরএসএফ-কে সমর্থন ও অর্থনৈতিক স্বার্থ: সুদানের সেনাবাহিনী সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফ-কে অস্ত্র সরবরাহ ও সামরিক সহায়তার অভিযোগ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের রিপোর্ট ও স্বাধীন তদন্তে তাদের অস্ত্র ও সামরিক সহায়তার ‘বিশ্বাসযোগ্য’প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২. সোনার খনি ও চোরাচালান: আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নিয়ন্ত্রণে থাকা সুদানের পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে দারফুর ও করডোফানের সোনার খনিগুলির মাধ্যমে উৎপন্ন সোনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সুদানের সোনার প্রবেশাধিকার আরব আমিরাতের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক আগ্রহের কারণ। সুদান আফ্রিকায় তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এবং সুদানের সেনা-সমর্থিত সরকার ২০২৩ সালে ৬৪ টন সোনা উৎপাদনের ঘোষণা করেছিল, যা ছিল একটি রেকর্ড। এটি বৈধভাবে উৎপাদিত ও রপ্তানি করা স্বর্ণ। তবে আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থাগুলোর অনুমান অনুযায়ী, সুদানের বার্ষিক প্রকৃত সোনা উৎপাদন ৮০ টন পর্যন্ত হতে পারে। সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি সংস্থা সুদানিজ মিনারেল রিসোর্সেস কোম্পানির তথ্যমতে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সুদানের সোনা উৎপাদনের পরিমাণ ৫৩ টন। তবে এটি মাত্র সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে উত্তোলন করা সোনার পরিমাণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যা নথিভুক্ত হয়েছে। দারফুর ও করডোফান প্রদেশের মতো র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের নিয়ন্ত্রণে থাকা খনিগুলোর উৎপাদন এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়, যার কারণে সুদানের মোট সোনা উৎপাদন এর চেয়েও বেশি বলে অনুমান করা হয়।
৩. ভাড়াটে সেনা : সংযুক্ত আরব আমিরাতের আঞ্চলিক সংঘাতে ভাড়াটে সেনা ব্যবহারের নজির রয়েছে (যেমন: ইয়েমেন)। সুদানের সংঘাতেও আরএসএফ-কে কলম্বিয়ান সহ অন্যান্য দেশের ভাড়াটে সেনা দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
৪. মানবিক বিপর্যয় ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল: সুদানের সংঘাত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি অজুহাত তৈরি করেছে। এই সংঘাত সুদানের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে এবং এটিকে আঞ্চলিক প্রভাবের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের লক্ষ্য হলো : সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এমন শক্তিকে সমর্থন করা, যা আরব আমিরাতের আঞ্চলিক স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। লোহিত সাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ (বিশেষত সোনা), আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা— এই সবকিছুই আরব আমিরাতকে সুদানের সংঘাতে আরএসএফ-কে সমর্থন দিতে চালিত করছে বলে ধারণা করা হয়।
সুদানের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূ-কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। যেমন :
১. সোনার খনি ও মুদ্রা : সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর (হেমেতি) প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার বলে অভিযুক্ত। আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রিত সোনার খনি থেকে সোনা পাচার হয় আরব আমিরাতে। এই অর্থ আরএসএফ-কে সামরিক শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা সুদানের অস্থিরতাকে দীর্ঘায়িত করছে।
২. অর্থনৈতিক সুবিধা : আরএসএফ দুর্বল হলে সুদানের কেন্দ্রীয় সরকার লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত বন্দরগুলোতে আরব আমিরাতের প্রবেশাধিকার বা বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করতে পারে। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর আরএসএফ-কে সমর্থন দিয়ে সুদানের রাজনীতিতে নিজেদের অনুকূলে থাকা পক্ষকে শক্তিশালী করেছে।
সুদানের জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার ও সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বর্তমানে লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত পোর্ট সুদান শহরটিকে তার সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু আরএসএফ ওই অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালিয়ে লোহিত সাগরের তীরেও সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরোক্ষ সমর্থন এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে সুদান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আরব আমিরাতকে দর কষাকষির মাধ্যমে নিজেদের বন্দর ও সামরিক সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দিতে পারে।
সুদানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা খুবই জটিল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যদিও তারা একত্রে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে, কিন্তু গোপনে তাদের লক্ষ্য ভিন্ন। সুদানের সংঘাতটি দুই প্রধান জেনারেলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হলেও এটি উপসাগরীয় শক্তিগুলোর 'ছায়াযুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বে থাকা আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সহায়তার মাধ্যমে সুদানের লাভজনক সোনার খনি ও এর বাণিজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আরএসএফ-কে সামরিক সরঞ্জাম (যেমন: ড্রোন) ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে সৌদি আরব সুদানের সশস্ত্র বাহিনী এবং এর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানকে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিজের প্রভাবকে ধরে রাখতে সচেষ্ট। উভয় দেশই একসময় সুদানের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় যৌথভাবে জড়িত থাকলেও সংঘাত শুরু হওয়ার পর তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে লোহিত সাগর এবং হর্ন অব আফ্রিকায় তাদের আধিপত্যের লড়াই, যেমন :
১. লোহিত সাগরে কৌশলগত প্রতিযোগিতা : সুদানকে কেন্দ্র করে সৌদি-আরব আমিরাত প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান কারণ হলো লোহিত সাগর এবং এর উপকূলবর্তী হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এই অঞ্চলটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের প্রবেশদ্বার (বাব-এল-মানদেব প্রণালি)। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলে বন্দর ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে অনেক আগে থেকেই বিনিয়োগ করে আসছে। তাদের লক্ষ্য সুদানে আরএসএফ-এর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে লোহিত সাগরের উপকূলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য রুটে তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াবে। অপরদিকে আরব আমিরাতের এই আগ্রাসী আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সৌদি আরবকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সৌদি আরব চায় না আরব আমিরাত বা তার প্রধান উপসাগরীয় প্রতিদ্বন্দ্বী লোহিত সাগরের অন্য পাড়ে এত বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠুক। সুদানে বুরহানকে সমর্থন দিয়ে সৌদি আরব তার সামরিক প্রভাব এবং বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে চায়।
২. ইয়েমেন ও সোমালিল্যান্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা : একসময় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রধান শরিক ছিল। কিন্তু পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে তার নিজস্ব প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে কৌশলগত বন্দরগুলো (এডেন ও সোকোত্রা দ্বীপ) নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে হুতিদের বিরুদ্ধে ওই যুদ্ধ থেকে সরে আসে। এটি সৌদি আরবের লক্ষ্য থেকে ভিন্ন। এই বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে স্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও সোমালিয়ার স্ব-শাসিত অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের বারবেরা বন্দরে আরব আমিরাত বিপুল বিনিয়োগ করে সেটিকে কৌশলগত সামরিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। এর ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এলাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়েছে।
সোমালিল্যান্ড ও ইয়েমেনের বন্দরগুলো উভয় দেশকেই লোহিত সাগরের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। আরব আমিরাত বন্দর উন্নয়ন ও সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চায়, যা ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরবের 'উঠোন' হিসেবে পরিচিত। সুদানে আরএসএফ-কে সমর্থন করে সংযুক্ত আমিরাত এই আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সুদানের সংঘাত আসলে উপসাগরীয় রাজনীতিতে 'ঘরে ঐক্য, বাইরে দ্বন্দ্ব' নীতিকে তুলে ধরে। যদিও রিয়াদে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একসঙ্গে কাজ করে, কিন্তু গোপনে তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক সম্পদ (যেমন : সোনা) এবং গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটগুলোর (লোহিত সাগর) উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপরীত শক্তিকে সমর্থন করে চলছে।
হুতিদের রুখতে এবং লোহিত সাগরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি সমন্বিত সামরিক ও অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে :
লোহিত সাগরের প্রবেশপথ বাব এল মান্দেব প্রণালির কাছাকাছি থাকা দেশগুলোতে আমিরাত বন্দর ও সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে। যেমন:
১. সোমালিয়া (বোসাসো): সংযুক্ত আরব আমিরাত সোমালিয়ার বোসাসো উপকূলে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপন বা সম্প্রসারণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। এখানে ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করা হয়েছে। এই ঘাঁটি লোহিত সাগরের দক্ষিণাঞ্চলে নজরদারি ও সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২. ইরিত্রিয়া (আসাব): অতীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরিত্রিয়ার আসাব বন্দরে একটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতো, যা ইয়েমেন যুদ্ধে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপে সহায়তা করেছিল। পরে সেই ঘাঁটি বন্ধ করে দিলেও কৌশলগত প্রয়োজনে লোহিত সাগরের উপকূলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার গুরুত্ব আরব আমিরাতের কাছে এখনও অনস্বীকার্য।
৩. ইয়েমেন: ইয়েমেন যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে সক্রিয় ছিল এবং ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোচা বন্দরসহ বেশ কিছু দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এটি বাব এল মান্দেব প্রণালির উপর তাদের প্রভাব বাড়ায়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে গাজার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে হুতিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি-সম্পর্কিত বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করে। এই হামলাগুলো আরব আমিরাতের বাণিজ্য ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা ও সামরিক উপস্থিতি হুতিদের বিরুদ্ধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা। এই ঘাঁটিগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং প্রয়োজনে দ্রুত সামরিক প্রতিক্রিয়ার জন্য মঞ্চ হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও আরব আমিরাত যদিও 'অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান'-এর (হুতিদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোট) সদস্য নয়, কিন্তু তার এই সামরিক উপস্থিতি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় রাখতেও সহায়ক।
লোহিত সাগরে সামরিক ঘাঁটি গড়ার মূল কারণ কেবল হুতিদের রুখতে নয়, বরং আমিরাতের বৃহত্তর ভূ-কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কেননা সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বৈশ্বিক লজিস্টিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। লোহিত সাগর যদি নিরাপদ না থাকে, তবে তা দুবাইয়ের মতো বন্দরের কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে তার জন্য জলপথগুলো খোলা থাকবে। এছাড়াও এই অঞ্চলগুলোতে সামরিক সুবিধা স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরব ও ইরানের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে গিয়ে লোহিত সাগর-হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হুতিদের হামলা লোহিত সাগরে আমিরাতের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও জরুরি করে তুলেছে। এই সামরিক ঘাঁটিগুলো আমিরাতকে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের রাজনীতি ও নিরাপত্তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সাহায্য করবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত লোহিত সাগরকে ঘিরে ইয়েমেন, ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ড ও সুদানে বন্দর উন্নয়ন, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বা স্থানীয় মিত্রদের সমর্থন করার মাধ্যমে একটি সামরিক ও অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমিরাতকে তার পছন্দের পক্ষকে শক্তিশালী করে এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিশ্চিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
লেখক : সামরিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত জলপথ, যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুদান লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায়, তার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সরাসরি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত লোহিত সাগরে প্রভাব বিস্তার করে বৈশ্বিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ক্রমবর্ধমান হামলা মোকাবিলা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের ভূ-কৌশলগত অবস্থান আরও শক্তিশালী করছে। কেন না হুতিদের হামলা লোহিত সাগরকে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক শিপিং রুটে পরিণত করেছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য সরাসরি হুমকি। আর এই কারণে লোহিত সাগরের রাজনীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সুদানের সংকটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলে বন্দর ও সামরিক ঘাঁটির নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য রুটে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। এজন্য আমিরাতের যা দরকার:
লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত সুদানের পোর্ট সুদান অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। কারণ সুয়েজ খাল ও বাব এল মান্দেব (লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্ত) প্রণালির মধ্যে এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইচ্ছে এই এলাকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যে প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। এই লক্ষ্যে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একটি আমিরাতি কনসোর্টিয়াম লোহিত সাগরে আবু আমামা বন্দর উন্নয়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই অঞ্চলে সোমালীয় জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি সুরক্ষিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের লোহিত সাগর অঞ্চলে সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যাওয়ার গভীর লক্ষ্য রয়েছে। অতীতে কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে সুদানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য উদ্বেগের কারণ। তবে সুদানের ইসলামপন্থি শাসন অবসানের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত তার প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে ইয়েমেন ও হর্ন অব আফ্রিকার উপকূলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখে আমিরাত তার প্রভাব বলয় প্রসারিত করতে চাচ্ছে। এজন্য সুদানে সংঘাতের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ('হেমেতি' নামে বেশি পরিচিত) এর র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সমর্থন দিয়ে এ অঞ্চলে তার পছন্দসই রাজনৈতিক গতিপথ তৈরির চেষ্টা করছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের লক্ষ্য লোহিত সাগর অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও জলদস্যুতা মোকাবেলার অজুহাতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি সুরক্ষিত করা। সুদানের সংঘাত তাদেরকে এই অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে। যেমন :
১. আরএসএফ-কে সমর্থন ও অর্থনৈতিক স্বার্থ: সুদানের সেনাবাহিনী সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফ-কে অস্ত্র সরবরাহ ও সামরিক সহায়তার অভিযোগ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের রিপোর্ট ও স্বাধীন তদন্তে তাদের অস্ত্র ও সামরিক সহায়তার ‘বিশ্বাসযোগ্য’প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২. সোনার খনি ও চোরাচালান: আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নিয়ন্ত্রণে থাকা সুদানের পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে দারফুর ও করডোফানের সোনার খনিগুলির মাধ্যমে উৎপন্ন সোনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সুদানের সোনার প্রবেশাধিকার আরব আমিরাতের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক আগ্রহের কারণ। সুদান আফ্রিকায় তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এবং সুদানের সেনা-সমর্থিত সরকার ২০২৩ সালে ৬৪ টন সোনা উৎপাদনের ঘোষণা করেছিল, যা ছিল একটি রেকর্ড। এটি বৈধভাবে উৎপাদিত ও রপ্তানি করা স্বর্ণ। তবে আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থাগুলোর অনুমান অনুযায়ী, সুদানের বার্ষিক প্রকৃত সোনা উৎপাদন ৮০ টন পর্যন্ত হতে পারে। সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সরকারি সংস্থা সুদানিজ মিনারেল রিসোর্সেস কোম্পানির তথ্যমতে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সুদানের সোনা উৎপাদনের পরিমাণ ৫৩ টন। তবে এটি মাত্র সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে উত্তোলন করা সোনার পরিমাণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যা নথিভুক্ত হয়েছে। দারফুর ও করডোফান প্রদেশের মতো র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের নিয়ন্ত্রণে থাকা খনিগুলোর উৎপাদন এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়, যার কারণে সুদানের মোট সোনা উৎপাদন এর চেয়েও বেশি বলে অনুমান করা হয়।
৩. ভাড়াটে সেনা : সংযুক্ত আরব আমিরাতের আঞ্চলিক সংঘাতে ভাড়াটে সেনা ব্যবহারের নজির রয়েছে (যেমন: ইয়েমেন)। সুদানের সংঘাতেও আরএসএফ-কে কলম্বিয়ান সহ অন্যান্য দেশের ভাড়াটে সেনা দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
৪. মানবিক বিপর্যয় ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল: সুদানের সংঘাত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি অজুহাত তৈরি করেছে। এই সংঘাত সুদানের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে এবং এটিকে আঞ্চলিক প্রভাবের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের লক্ষ্য হলো : সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এমন শক্তিকে সমর্থন করা, যা আরব আমিরাতের আঞ্চলিক স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। লোহিত সাগরের কৌশলগত গুরুত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ (বিশেষত সোনা), আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা— এই সবকিছুই আরব আমিরাতকে সুদানের সংঘাতে আরএসএফ-কে সমর্থন দিতে চালিত করছে বলে ধারণা করা হয়।
সুদানের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূ-কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। যেমন :
১. সোনার খনি ও মুদ্রা : সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর (হেমেতি) প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার বলে অভিযুক্ত। আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রিত সোনার খনি থেকে সোনা পাচার হয় আরব আমিরাতে। এই অর্থ আরএসএফ-কে সামরিক শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা সুদানের অস্থিরতাকে দীর্ঘায়িত করছে।
২. অর্থনৈতিক সুবিধা : আরএসএফ দুর্বল হলে সুদানের কেন্দ্রীয় সরকার লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত বন্দরগুলোতে আরব আমিরাতের প্রবেশাধিকার বা বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করতে পারে। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর আরএসএফ-কে সমর্থন দিয়ে সুদানের রাজনীতিতে নিজেদের অনুকূলে থাকা পক্ষকে শক্তিশালী করেছে।
সুদানের জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার ও সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বর্তমানে লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত পোর্ট সুদান শহরটিকে তার সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু আরএসএফ ওই অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালিয়ে লোহিত সাগরের তীরেও সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরোক্ষ সমর্থন এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে সুদান একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আরব আমিরাতকে দর কষাকষির মাধ্যমে নিজেদের বন্দর ও সামরিক সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দিতে পারে।
সুদানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূমিকা খুবই জটিল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যদিও তারা একত্রে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে, কিন্তু গোপনে তাদের লক্ষ্য ভিন্ন। সুদানের সংঘাতটি দুই প্রধান জেনারেলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হলেও এটি উপসাগরীয় শক্তিগুলোর 'ছায়াযুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বে থাকা আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সহায়তার মাধ্যমে সুদানের লাভজনক সোনার খনি ও এর বাণিজ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আরএসএফ-কে সামরিক সরঞ্জাম (যেমন: ড্রোন) ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে সৌদি আরব সুদানের সশস্ত্র বাহিনী এবং এর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানকে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিজের প্রভাবকে ধরে রাখতে সচেষ্ট। উভয় দেশই একসময় সুদানের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় যৌথভাবে জড়িত থাকলেও সংঘাত শুরু হওয়ার পর তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে লোহিত সাগর এবং হর্ন অব আফ্রিকায় তাদের আধিপত্যের লড়াই, যেমন :
১. লোহিত সাগরে কৌশলগত প্রতিযোগিতা : সুদানকে কেন্দ্র করে সৌদি-আরব আমিরাত প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রধান কারণ হলো লোহিত সাগর এবং এর উপকূলবর্তী হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এই অঞ্চলটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং রুটের প্রবেশদ্বার (বাব-এল-মানদেব প্রণালি)। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলে বন্দর ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনে অনেক আগে থেকেই বিনিয়োগ করে আসছে। তাদের লক্ষ্য সুদানে আরএসএফ-এর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে লোহিত সাগরের উপকূলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য রুটে তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াবে। অপরদিকে আরব আমিরাতের এই আগ্রাসী আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সৌদি আরবকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সৌদি আরব চায় না আরব আমিরাত বা তার প্রধান উপসাগরীয় প্রতিদ্বন্দ্বী লোহিত সাগরের অন্য পাড়ে এত বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠুক। সুদানে বুরহানকে সমর্থন দিয়ে সৌদি আরব তার সামরিক প্রভাব এবং বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে চায়।
২. ইয়েমেন ও সোমালিল্যান্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা : একসময় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রধান শরিক ছিল। কিন্তু পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে তার নিজস্ব প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে কৌশলগত বন্দরগুলো (এডেন ও সোকোত্রা দ্বীপ) নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে হুতিদের বিরুদ্ধে ওই যুদ্ধ থেকে সরে আসে। এটি সৌদি আরবের লক্ষ্য থেকে ভিন্ন। এই বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে স্পষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও সোমালিয়ার স্ব-শাসিত অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের বারবেরা বন্দরে আরব আমিরাত বিপুল বিনিয়োগ করে সেটিকে কৌশলগত সামরিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। এর ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এলাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়েছে।
সোমালিল্যান্ড ও ইয়েমেনের বন্দরগুলো উভয় দেশকেই লোহিত সাগরের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। আরব আমিরাত বন্দর উন্নয়ন ও সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চায়, যা ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরবের 'উঠোন' হিসেবে পরিচিত। সুদানে আরএসএফ-কে সমর্থন করে সংযুক্ত আমিরাত এই আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সুদানের সংঘাত আসলে উপসাগরীয় রাজনীতিতে 'ঘরে ঐক্য, বাইরে দ্বন্দ্ব' নীতিকে তুলে ধরে। যদিও রিয়াদে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একসঙ্গে কাজ করে, কিন্তু গোপনে তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক সম্পদ (যেমন : সোনা) এবং গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটগুলোর (লোহিত সাগর) উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপরীত শক্তিকে সমর্থন করে চলছে।
হুতিদের রুখতে এবং লোহিত সাগরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি সমন্বিত সামরিক ও অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে :
লোহিত সাগরের প্রবেশপথ বাব এল মান্দেব প্রণালির কাছাকাছি থাকা দেশগুলোতে আমিরাত বন্দর ও সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে। যেমন:
১. সোমালিয়া (বোসাসো): সংযুক্ত আরব আমিরাত সোমালিয়ার বোসাসো উপকূলে একটি বিমানঘাঁটি স্থাপন বা সম্প্রসারণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। এখানে ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করা হয়েছে। এই ঘাঁটি লোহিত সাগরের দক্ষিণাঞ্চলে নজরদারি ও সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২. ইরিত্রিয়া (আসাব): অতীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইরিত্রিয়ার আসাব বন্দরে একটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতো, যা ইয়েমেন যুদ্ধে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপে সহায়তা করেছিল। পরে সেই ঘাঁটি বন্ধ করে দিলেও কৌশলগত প্রয়োজনে লোহিত সাগরের উপকূলে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার গুরুত্ব আরব আমিরাতের কাছে এখনও অনস্বীকার্য।
৩. ইয়েমেন: ইয়েমেন যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে সক্রিয় ছিল এবং ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোচা বন্দরসহ বেশ কিছু দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এটি বাব এল মান্দেব প্রণালির উপর তাদের প্রভাব বাড়ায়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে গাজার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে হুতিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি-সম্পর্কিত বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করে। এই হামলাগুলো আরব আমিরাতের বাণিজ্য ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা ও সামরিক উপস্থিতি হুতিদের বিরুদ্ধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা। এই ঘাঁটিগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং প্রয়োজনে দ্রুত সামরিক প্রতিক্রিয়ার জন্য মঞ্চ হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও আরব আমিরাত যদিও 'অপারেশন প্রসপারিটি গার্ডিয়ান'-এর (হুতিদের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোট) সদস্য নয়, কিন্তু তার এই সামরিক উপস্থিতি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় রাখতেও সহায়ক।
লোহিত সাগরে সামরিক ঘাঁটি গড়ার মূল কারণ কেবল হুতিদের রুখতে নয়, বরং আমিরাতের বৃহত্তর ভূ-কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কেননা সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বৈশ্বিক লজিস্টিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। লোহিত সাগর যদি নিরাপদ না থাকে, তবে তা দুবাইয়ের মতো বন্দরের কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে তার জন্য জলপথগুলো খোলা থাকবে। এছাড়াও এই অঞ্চলগুলোতে সামরিক সুবিধা স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরব ও ইরানের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে গিয়ে লোহিত সাগর-হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হুতিদের হামলা লোহিত সাগরে আমিরাতের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও জরুরি করে তুলেছে। এই সামরিক ঘাঁটিগুলো আমিরাতকে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের রাজনীতি ও নিরাপত্তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সাহায্য করবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত লোহিত সাগরকে ঘিরে ইয়েমেন, ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ড ও সুদানে বন্দর উন্নয়ন, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বা স্থানীয় মিত্রদের সমর্থন করার মাধ্যমে একটি সামরিক ও অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমিরাতকে তার পছন্দের পক্ষকে শক্তিশালী করে এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিশ্চিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
লেখক : সামরিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
.png)

ট্রাম্প মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি জয়ী হলে নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল কমিয়ে দেওয়া হবে। ফলে এই নির্বাচন এখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রাজনীতির প্রতীকী সংঘাতে পরিণত হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগে
গ্যাবার্ডের এই বক্তব্য এমন এক সময় (৩১ অক্টোবর ২০২৫) আসে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে গাজা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, এই নীতি পরিবর্তন কোনো কৌশলগত বিচ্যুতি নয়, বরং গত কয়েক দশকের হস্তক্ষেপমূলক নীতির বিপরীতে এক সচেতন সিদ্ধান্ত।
১৪ ঘণ্টা আগে
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর মধ্য দিয়ে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন ও তীব্রতর অধ্যায়ের সূচনা হয়।
১ দিন আগে
সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধ দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে ইতিমধ্যে এক কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
২ দিন আগে