leadT1ad

গুলিস্তানের গড়ে ওঠার কাহিনি

ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোতে গুলিস্তান নামে কিছু নেই!

গতকাল ২ আগস্ট ঢাকার গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। এতে দেশের সব সংবাদমাধ্যমের খবরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই গুলিস্তান নামটি লেখা হয়েছে। অজস্র মার্কেট, দোকানপাট, লোকজন—সব মিলিয়ে পুরোনো আর নতুন ঢাকার সেতুবন্ধ এ এলাকাটি এখন রাজধানীবাসীর জীবনধারার অংশ। কিন্তু ঢাকায় গুলিস্তান নামে আদৌ কি কোনো স্থানের অস্তিত্ব আছে?

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১২: ৫০
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ৫৩
ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোয় গুলিস্তান নামে কিছু নেই! স্ট্রিম গ্রাফিক

‘গুলিস্তান’ নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দোকানপাট, ফুটপাতজোড়া হকারের হাঁকডাক, রিকশা ও বাসের হর্ন, কন্ডাক্টরের চিৎকার আর চেনা কোলাহল। কিন্তু যদি বলা হয়, রাজধানী ঢাকায় সিটি করপোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় ‘গুলিস্তান’ নামে কোনো জায়গায় অস্তিত্ব নেই! বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি।

এখন আমরা যে স্থানকে গুলিস্তান বলি, সেটা ছিল একসময় জিন্নাহ অ্যাভিনিউ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জায়গাটির নাম হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। আর ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর এ বছরের মার্চ মাসে এই শোরগোলপূর্ণ স্থানটির নাম দেওয়া হয় নতুন করে—শহীদ আবরার ফাহাদ অ্যাভিনিউ।

কেন জায়গার নাম গুলিস্তান?

ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক বইপত্র থেকে জানা যায়, এখন যে জায়গা গুলিস্তান নামে পরিচিত, ১৯৫৩ সালে এখানে চালু হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল ‘গুলিস্তান’। পরে মানুষের মুখে মুখে ফিরে সিনেমা হলের নামেই জায়গাটির নামই হয়ে যায় গুলিস্তান।

এই সময়ের কর্মব্যস্ত গুলিস্তান। ছবি: এফই
এই সময়ের কর্মব্যস্ত গুলিস্তান। ছবি: এফই

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গুলিস্তান ছিল ঢাকার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রধান গন্তব্য। আর তখনকার সিনেমা হল, আশপাশের আড্ডাস্থল ও শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশ এ স্থানকে পরিণত করেছিল শহরের অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে।

ফুলবাগান থেকে শুরু

‘গুলিস্তান’ মানে ফুলের বাগান। এ এলাকায় আগে ফুলের বাগানও ছিল। পরে হলো সিনেমা হল। তবে স্থানটি মোঘল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবি মরিয়ম কামানের জন্যও ছিল বিশেষভাবে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে চকবাজার থেকে কামানটি সরিয়ে আনা হয় সদরঘাটে। এরপর পাকিস্তান জামানায় সদরঘাট থেকে স্থানান্তর করে রাখা হয় ঠিক গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে। ১৯৮৩ সালে তা স্থান পায় ওসমানী উদ্যানে। সবশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কামানটি রাখা হয়েছে ঢাকা গেটের সামনে।

তবে একসময়ের সেই জাঁকজমক গুলিস্তান সিনেমা হল এখন আর নেই। ২০০৫ সালেই এ প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে। তবু মানুষ এখনো গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সকে ডাকে ‘হল মার্কেট’ নামে। বাসের কন্ডাক্টরের চিৎকারে প্রতিদিনিই কানে ভেসে আসে, ‘এ্যই নামেন, হল মার্কেট’। মানে সিনেমা হলটি না থেকেও তার স্মৃতি রেখে গেছে। বর্তমানের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে রয়ে গেছে অতীত।

১৯৫৩ সালের ৬ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় গুলিস্তান সিনেমা হলের উদ্বোধনী উপলক্ষে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন। ছবি: সংগ্রামের নোটবুক
১৯৫৩ সালের ৬ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় গুলিস্তান সিনেমা হলের উদ্বোধনী উপলক্ষে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন। ছবি: সংগ্রামের নোটবুক

গুলিস্তান সিনেমা হলের ইতিবৃত্ত

১৯৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি। সেদিন চালু হলো ঢাকার প্রথম আধুনিক সিনেমা হল গুলিস্তান। দৈনিক ‘আজাদ’-এ ছাপা হয়েছিল তার উদ্বোধনী বিজ্ঞাপন। তাতে লেখা ছিল, ‘গুলিস্তান সিনেমা হলে দেখানো হবে রাজকাপুর ও নার্গিস অভিনীত হিন্দি ছবি “অম্বর”।’ এ সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল তার আগের বছর, ১৯৫২ সালে।

‘গুলিস্তান’ মানে ফুলের বাগান। এ এলাকায় আগে ফুলের বাগানও ছিল। পরে হলো সিনেমা হল। তবে স্থানটি মোঘল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবি মরিয়ম কামানের জন্যও ছিল বিশেষভাবে পরিচিত।

প্রথমদিকে প্রতিদিন গুলিস্তান হলে চলত তিনটি করে শো। সে সময়ের অত্যাধুনিক আরসিএপি জি-২৪০ ওয়াই মেশিনে করা হতো সিনেমার প্রজেকশন। শুরুতে কেউ কেউ এ হলকে ‘লিবার্টি সিনেমা হল’ নামে ডাকতেন। কারণ, হলটি যে ভবনে ছিল, তার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল লিবার্টি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘ঢাকাকোষ’ আর চলচ্চিত্রগবেষক অনুপম হায়াৎ এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তাঁদের লেখা থেকে জানা যায়, গুলিস্তান হল নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজল আহমেদ দোসানি। কলকাতায় তিনি আগে থেকেই চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৬০ সালের ছবি। দূরে দেখা যাচ্ছে গুলিস্তান সিনেমা হল ভবন। তখন এর আশেপাশ ছিল ফাঁকা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া/মৃদুল সুদীপ্ত
১৯৬০ সালের ছবি। দূরে দেখা যাচ্ছে গুলিস্তান সিনেমা হল ভবন। তখন এর আশেপাশ ছিল ফাঁকা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া/মৃদুল সুদীপ্ত

১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন কলকাতার সিনেমা ব্যবসাটিও। নতুন শহর হিসেবে গড়ে উঠছে ঢাকা। এখানে তাই সিনেমা ব্যবসাও দ্রুতই জমবে, এমন ভাবনা থেকেই মূলত গুলিস্তান হল গড়ে তুলেছিলেন ফজল আহমেদ দোসানি।

তিনি শুধু গুলিস্তান সিনেমা হল বানিয়েই থেমে থাকেননি। এ হলের ওপরের তিনতলায় বানিয়েছেন আরেকটি ছোট হল—নাজ সিনেমা। প্রথম দিকে এখানে শুধু ইংরেজি ছবিই দেখানো হতো।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক পাকিস্তানে চলে যান। তাঁর ফেলে যাওয়া এই সম্পত্তিকে ঘোষণা করা হয় পরিত্যক্ত সম্পদ হিসেবে।

১৯৭২ সালে এই সম্পত্তির দায়িত্ব পায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। তখন থেকে ট্রাস্টই এ জায়গার মালিক।

এখন যে জায়গা গুলিস্তান নামে পরিচিত, ১৯৫৩ সালে এখানে চালু হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল ‘গুলিস্তান’। পরে মানুষের মুখে মুখে ফিরে সিনেমা হলের নামেই জায়গাটির নামই হয়ে যায় গুলিস্তান।

২০০৫ সালে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ সিনেমা হলটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা ছিল বিশাল ২০তলা শপিং কমপ্লেক্স বানানোর। যার সর্বোচ্চ তলায় থাকার কথা ছিল নতুন একটি সিনেমা হল। কিন্তু ১০তলা পর্যন্ত উঠেই ভবনটির নির্মাণ থেমে যায়। এরপর নির্মাণকাজ আর এগোয়নি।

গুলিস্তান সিনেমা হলের সেকাল

গুলিস্তান সিনেমা হলে তখন দেশি-বিদেশি নানা ধরনের ছবি দেখানো হতো। ইংরেজি ও বলিউডের ভালো মানের সিনেমাগুলোর চাহিদা ছিল শুরু থেকেই। যেমন ১৯৫৩-৫৫ সালের দিকের জনপ্রিয় ‘দ্য ফ্লোটিং ডাচম্যান’, ‘বাবলা’, ‘রাজরানি’, ‘দি এনসার’, ‘কুইন অফ শিবা’, ‘অন্নদাতা’, ‘অপবাদ’—এসব ছবি চলেছে হলটিতে।

১৯৫৭ সালে গুলিস্তান সিনেমা হলের একটি টিকেট। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এরিয়ায় সিট, ২ টাকা ৮০ পয়সা। ছবি: ফেসবুকে বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র গ্রুপ থেকে নেওয়া
১৯৫৭ সালে গুলিস্তান সিনেমা হলের একটি টিকেট। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এরিয়ায় সিট, ২ টাকা ৮০ পয়সা। ছবি: ফেসবুকে বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র গ্রুপ থেকে নেওয়া

ভারতীয় জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবিও চলত এখানে। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার এক বছরের মাথায় ১৯৫৬ সালে এ হলেই মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের জগৎবিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’। আর ১৯৫৯ সালে এফডিসির সহযোগিতায় নির্মিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র প্রিমিয়ারও হয়েছিল এখানে।

১৯৫৬ সালের ৬ জানুয়ারি। গুলিস্তান সিনেমা হলের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায়, গোটা পাকিস্তানে এ প্রেক্ষাগৃহই সে সময় ছিল একমাত্র ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) ছবি দেখানোর উপযোগী। তা ছাড়া গুলিস্তান হল ছিল ঢাকার একমাত্র সিনেমাস্কোপ প্রযুক্তির ওয়াইডস্ক্রিনের সুবিধাসম্পন্ন। আবার পঞ্চাশের দশকের অত্যাধুনিক স্টেরিওফোনিক সাউন্ড সিস্টেমও এখানে ছিল। বিশাল লবি আর আরামদায়ক ডানপিলো চেয়ার। পাশাপাশি নারীদের জন্য ছিল আলাদা লেডিস পাউডার রুম। বাদ পড়েনি শিশুরাও—তাঁদের জন্য এতে ছিল নার্সারির ব্যবস্থা।

সব মিলিয়ে সদরঘাট থেকে খানিক দূরে দারুণ ফিটফাট এই সিনেমা হল আসলেই হয়ে উঠেছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকের ছবি। সিনেমা হলে সেই সময় ভাইয়া (১৯৬১) সিনেমার শো চলছিল। ছবি: ফোর হানড্রেড ইয়ার্স হিস্ট্রি ইন ফটোগ্রাফ ফেসবুক গ্রুপ থেকে নেওয়া
১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকের ছবি। সিনেমা হলে সেই সময় ভাইয়া (১৯৬১) সিনেমার শো চলছিল। ছবি: ফোর হানড্রেড ইয়ার্স হিস্ট্রি ইন ফটোগ্রাফ ফেসবুক গ্রুপ থেকে নেওয়া

একসময় ‘দ্য আরব টাইমস’-এর ফিচার সম্পাদক ছিলেন গাজালা আকবর। পঞ্চাশের দশকে তিনি ঢাকায় থাকতেন। এ শহর নিয়ে তাঁর রয়েছে চমৎকার স্মৃতিচারণামূলক লেখা। সেখানেও আছে এ প্রেক্ষাগৃহের প্রসঙ্গ। গাজালা আকবরের লেখা থেকে জানা যায়, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গুলিস্তান হল ছিল ঢাকার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রধান কেন্দ্র। দর্শকেরা সিনেমা দেখার আগে কাছাকাছি বাজার থেকে চকলেট, চানাচুর কিনে হলে ঢুকতেন। আর সিনেমার অনেক শো-ই হয়ে যেত হাউসফুল। তাই আগেই ফোনে বা সরাসরি গিয়ে টিকিট কেটে রাখতেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।

গুলিস্তান সিনেমা হলে দিনে তিনটি শো চলত। রোববার তখন ছিল সরকারি ছুটি। এ কারণে এ দিন সকাল ১১টায় থাকত বিশেষ মর্নিং শো। সাধারণত এই শো দেখতে ভীড় জমাতেন যেখানে শিক্ষিত মানুষজন আর উচ্চবিত্ত দর্শকেরা। পরে নাজ সিনেমা হল জনপ্রিয় হয়ে উঠলে গুলিস্তানের এই মর্নিং শো বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রেক্ষাগৃহটিতে বিদেশি ছবির চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে বেলা দেড়টায় আলাদা একটি বিশেষ শো চালু হয়েছিল।

বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দর্শকেরা সেকালে গুলিস্তানে হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করতেন বটে, কিন্তু কেমন ছিল তাঁদের পোশাক আর উপভোগের ধরন? এ বিষয়ে কোথাও বিশদ বিবরণ হাজির নেই। বিভিন্নজনের টুকরো টুকরো যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, ধনী দর্শকেরা তখন সাজগোজ করে আসতেন। তাঁদের হাতে থাকত ব্যালকনির টিকেট। অন্যদিকে, সাধারণ দর্শকেরা নিচের সিটে বসে চানাচুর খেতে খেতে সিনেমা উপভোগ করতেন।

১৯৭৩ সালের গুলিস্তান। সিনেমা হলে চলছে রাজ্জাক অভিনীত সিনেমা স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা। সিনেমাটি সেই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল। ছবি: ঢাকা-ফোর হানড্রেড ইয়ার্স হিস্ট্রি ইন ফটোগ্রাফ ফেসবুক গ্রুপ থেকে নেওয়া/ দুলক আহমেদ
১৯৭৩ সালের গুলিস্তান। সিনেমা হলে চলছে রাজ্জাক অভিনীত সিনেমা স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা। সিনেমাটি সেই বছরেই মুক্তি পেয়েছিল। ছবি: ঢাকা-ফোর হানড্রেড ইয়ার্স হিস্ট্রি ইন ফটোগ্রাফ ফেসবুক গ্রুপ থেকে নেওয়া/ দুলক আহমেদ

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে এ হলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে একটি টিকেটের দাম ছিল ২ টাকা ৮০ পয়সা।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে গুলিস্তান সিনেমা হলের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাঙন ধরে। কেননা, ততদিনে ঢাকা ধীরে ধীরে যেমন নগর হয়ে উঠছে, তেমনি এ শহরের বেশকিছু স্থানে চালু হয়েছে আরও কিছু সিনেমা হল। তবু প্রথম আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ বলে কথা—তাই গুলিস্তান সিনেমা হলের সেই রাজকীয় সৌন্দর্য আর অভিজাত পরিবেশ অনেকের কাছে আজও তুলনাহীন।

যতটা প্রভাব সংস্কৃতিতে

একসময় ঢাকাবাসীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সিনেমা। তবে তা কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার গল্প হিসেবেও। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া, টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গল্প করা, ‘হাউসফুল’ বিজ্ঞপ্তি দেখে মন খারাপ করা আর ছবি শেষে কাছের কোনো রেস্তোরাঁয় খাওয়া। সব মিলিয়ে পুরোটা ছিল একধরনের উৎসবের মতো ব্যাপার। পাকিস্তান হওয়ার পাঁচ বছরের ভেতরে গুলিস্তান নামে যে সিনেমা হলটি তৈরি হলো এবং পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় টিকে থাকল, ঢাকার নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর অবদান কম নয়।

গাজালা আকবরের লেখা থেকে জানা যায়, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গুলিস্তান হল ছিল ঢাকার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রধান কেন্দ্র। দর্শকেরা সিনেমা দেখার আগে কাছাকাছি বাজার থেকে চকলেট, চানাচুর কিনে হলে ঢুকতেন। আর সিনেমার অনেক শো-ই হয়ে যেত হাউসফুল।

সে সময় শহরের মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির মানসিক গঠনে সিনেমার ছিল এক গভীর প্রভাব। মূলত ছায়াছবির মধ্য দিয়ে মানুষেরা প্রেম, বিরহ, লড়াই সংগ্রাম, জীবনযাপন ইত্যাদি নতুনভাবে শিখতেন। সংগত কারণে একেকটি সিনেমা হয়ে উঠত একেকটি সময়ের স্মারক। সামাজিক বয়ান রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। চলচ্চিত্র যদিও পশ্চিমের আবিষ্কার, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এটি দ্রুতই একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল। এই মাধ্যমের সংস্পর্শে এসে দেশীয় বিনোদনের ধারা নতুন রূপ পায়। যার প্রভাবে সাধারণ মানুষের রুচি, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় মনস্তত্ত্বে ঘটে পরিবর্তন।

১৯৮০-এর দশকের গুলিস্তান। তখনও গুলিস্তানে বাস-রিকশা-মানুষের ভিড় লাগতো। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
১৯৮০-এর দশকের গুলিস্তান। তখনও গুলিস্তানে বাস-রিকশা-মানুষের ভিড় লাগতো। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এই অভিজ্ঞতার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক গুলিস্তান সিনেমা হল। হলটি ছিল একাধারে সিনেমাপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, আবার নগর সংস্কৃতিরও কেন্দ্র। সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে ভিড় জমাতেন।

আসলে তখন গুলিস্তানকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটি সম্পূর্ণ জীবনযাপন কাঠামো। রেস্তোরাঁর গড়ে ওঠার ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যাবে, ঢাকার প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট চৌ চিন চাও, রেক্স বা লা সানি রেস্তোরাঁ কিংবা বেবি আইসক্রিম—এসবও গুলিস্তান এলাকা এবং এখানকার হলটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি আর সিনেমা—এ এক প্যাকেজ অভিজ্ঞতা ছিল গুলিস্তানে যাওয়ার।

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে চলচ্চিত্রশিল্পের সূচনা ঘটে ১৯৫৬ সালে, আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মাধ্যমে। আর আগেই বলা হয়েছে যে গুলিস্তান সিনেমা হলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৩-তে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার প্রথম সিনেমা থেকে ঢাকায় প্রথম আধুনিক সিনেমা হলের সূচনা—এর মধ্যে সময়য়ের ব্যবধান তিন বছর। কিছু বাংলা সিনেমা দেখানো হলেও হলে সে সময় মূলত ইংরেজি, হিন্দি আর উর্দু ভাষার সিনেমার প্রভাব ছিল বেশি।

২ আগস্ট গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে আগুন লাগায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে স্থানটি। ছবি: ফায়ার সার্ভিসের সৌজন্যে
২ আগস্ট গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে আগুন লাগায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে স্থানটি। ছবি: ফায়ার সার্ভিসের সৌজন্যে

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানে ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তার নিজস্ব ভিত্তি গড়ে তুলতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ছবির সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় নামে। আর এসব ইতিহাসের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে গুলিস্তান সিনেমা হলের নাম।

গুলিস্তান তো গুলিস্তানই

ফজল আহমেদ দোসানি একদিন যখন গুলিস্তান সিনেমা হল তৈরি করেছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই জানতেন না, এ হলকে কেন্দ্র করে একদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে এ এলাকার নাম। গুলিস্তান হয়ে উঠবে বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলির ঢাকার অন্যতম এক জনবহুল স্থান। কিন্তু ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামো তথা ঢাকা সিটি করপোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় ‘গুলিস্তান’ নামে যে কোনো জায়গার অস্তিত্ব থাকবে না, তা কে কবে ভেবেছিল! তবে হোল্ডিং তালিকায় গুলিস্তান নামের কিছু থাকুক বা না থাকুক, গুলিস্তান তো গুলিস্তানই। নিজের নামের মান রাখতেই যেন ফুলের বাগানের মতোই এ স্থান এখনো গন্ধ ছড়িয়ে, কখনোবা চিৎকার ও হাহাকার তুলে মিশে আছে ঢাকাবাসীর জীবনধারায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত