মুজিব শতবর্ষ
একাডেমির এক পরিচালক স্ট্রিমকে জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একাডেমি থেকে যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ১০ শতাংশও পড়ার মতো না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার জন্যই তখন বইগুলো প্রকাশ করা হয়।
হুমায়ূন শফিক
২০২০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ দেশব্যাপী সাড়ম্বরে পালন করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি নানা আয়োজন করেছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে শেখ মুজিবের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়িয়ে মোট ১০২টি বই বের করেছিল তারা। কয়েকটি বই ছিল শেখ মুজিবের সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়েও। তবে এসব বইয়ের বিষয়, লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও মান নিয়ে শুরু থেকেই পাঠক সমাজে প্রশ্ন ছিল। আবার এসব বইয়ের মাধ্যমে ‘আওয়ামী লীগের বয়ান তৈরি করা হচ্ছে’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন এমন মন্তব্যও করেছিলেন কেউ কেউ।
সব মিলিয়ে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি থেকে যে বইগুলো বেরিয়েছিল, স্ট্রিমের অনুসন্ধানে তার মধ্যে অনেক অস্বচ্ছতার প্রমাণ মিলেছে।
বাংলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে একাডেমির সে সময়ের মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী ১০০টি বইয়ের পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি বাজেট দিয়েছিলেন তিনি। চমকপ্রদ বিষয় হলো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তখন কোনো টাকা না দেওয়ার পরেও একাডেমি নিজস্ব বরাদ্দ থেকে বইগুলো বের করা হয়। বর্তমানে বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানার পরিচালক তপন কুমার বাগচী এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি নিজে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এভাবে অন্য খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে বইগুলো প্রকাশের ফলে অন্যান্য বিভাগের কাজেও তার প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন একাডেমির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
লেখক নির্বাচন ও মান নিয়ে প্রশ্ন
বাংলা একাডেমি থেকে মুজিব শতবর্ষে যে ১০২টি বই বের হয়েছিল, সেগুলোর লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। আর প্রকাশের পর বইগুলোর মান নিয়েও কথা উঠেছে। যদিও তখন কেউ সরাসরি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলা নিরাপদ মনে করেননি, তবে ২০২৪ সালে ২৩ জুন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু গবেষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বইগুলোর বেশ কয়েকটি আমি দেখেছি। বইগুলো খুবই উন্নত মানের। তবে বইগুলো আরও সম্পাদনা করা দরকার ছিল।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাডেমির এক পরিচালক স্ট্রিমকে জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একাডেমি থেকে যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ১০ শতাংশও পড়ার মতো না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার জন্যই তখন বইগুলো প্রকাশ করা হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যাঁরা বইগুলো লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই-ই কাজটি করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। তাঁর মতে, এখানে মূলত তিন ধরনের লেখক ও সম্পাদক ছিলেন। এক দল হলেন যাঁরা আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণে আগ্রহী; বই লিখে সরকার থেকে কোনো প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন আরেক দল; আর কিছুসংখ্যক ছিলেন, যাঁরা শুধু টাকার জন্যই লিখেছিলেন।
বইগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন করলে ওই কর্মকর্তা জানান, বইগুলোর বেশির ভাগই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা ও স্তুতিতে ভরা। সে তুলনায় এখানে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তথা ক্রিটিক্যাল অবজারভেশন কম। ভালো কাজ খুব কমই আছে।
আর এ প্রসঙ্গে প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত থাকা তপন বাগচীর কথা হলো, ‘১০২টি বই বের হলে ২০টির মানে একটু ঘাটতি থাকতে পারে। এখন ধরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটা লেখা দিলেন। সেটা করতে হয়। অথবা অন্য কোনো বিশিষ্ট কেউ দিলেন, সেটাও তো আমাদের করতে হয়।’
বিষয় নিয়েও আছে কথা
শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যেসব বই বেরিয়েছে, তার বিষয় নির্বাচন নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। গ্রন্থমালায় শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে এমন কিছু বিষয় যুক্ত করে বই প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তাঁর জীবন ও কর্মের সংযোগ তৈরি করা কষ্টকর। অনেক ক্ষেত্রে সংযোগটি ঘটেওনি। এক্ষেত্রে সাইমন জাকারিয়ার লেখা ‘সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি’ এবং আবুল কাসেমের ‘বঙ্গবন্ধু ও চা শিল্প’ বই দুটির উদাহরণ দেওয়া যায়। ইতিহাসের বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন, এমন এক পাঠক মুনিম রাব্বী। তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থমালার অধীনে এমন কিছু বই বের করা হয়েছে, যা না করলেও চলত।’
বইগুলোর লেখক কারা
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ক্যাটালগ থেকে বইগুলোর সম্পূর্ণ তালিকা পেয়েছে স্ট্রিম। তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্পে মোট ৬৯ জন লেখক ও সম্পাদকের মধ্যে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত বা কর্মরত ১৫ জন, বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে আমলা ১৩ জন, শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ২০ জন, সাংবাদিক আছেন পাঁচজন, কবি ও লেখক ছয়জন এবং রাজনীতিবিদ ও সংগঠক রয়েছেন কয়েকজন। এর মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আর এখানে লেখক ও সম্পাদক হিসেবে যেসব বিদ্যায়তনের শিক্ষকেরা ছিলেন, তাঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
লেখক তালিকার প্রায় সবাই-ই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। তবে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত আছেন, এমন লেখকদের সংখ্যাই এখানে বেশি। এমনকি লেখালেখির পাশাপাশি যাঁরা অন্য পেশায় যুক্ত, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে একাডেমির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তাই এর লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে, এমন বলেছেন বইপত্র সংশ্লিষ্টজনেরা।
বাজেট না থাকার পরেও বই
২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ পালনের সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ২০২১ সালের ২৪ মে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে মুজিব শতবর্ষ-এ বই প্রকাশের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার একটি বাজেট দেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, সে সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ বাজেট অনুমোদন করেনি। তারা বলেছিল, একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নেই বইগুলো বের করতে হবে। তখন বাংলা একাডেমির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল, এত টাকা কি একাডেমি বইগুলো থেকে তুলে আনতে পারবে?
প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত তপন কুমার বাগচী সে সময়ের ঘটনাবলি তুলে ধরে স্ট্রিমকে বলেন, ‘হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্যার থাকার সময় প্রথমে ১০০টি বইয়ের পরিকল্পনা করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ১০২টি বই বের হয়। প্রতি বইয়ে দুই লাখ টাকার হিসাব দিয়ে মোট ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার একটা প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় বই প্রকাশের জন্য এক টাকাও দেয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, কীভাবে আমরা এখান থেকে লাভ করব। তারা আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে বলেছিল, আমরাও তা-ই করেছিলাম।
এ প্রসঙ্গে তপন বাগচী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে যে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল, তার থেকে বাংলা একাডেমি টাকা পায়নি, পেয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি। তারা প্রতি জেলায় নাটক করেছে।’
এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রক্রিয়াটির সঙ্গে আমি ছিলাম তো… এক টাকাও দেয়নি। তখন প্রাথমিকভাবে দশটি বই বের হলো। দেখলাম, সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর আরও পাণ্ডুলিপি আসা শুরু হলো। সেগুলোও করা হলো। মানে কোনো প্রকল্প অনুযায়ী কোনো কিছু করা হয়নি। আর কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ যেহেতু শেষ গিয়েছিল, সেজন্য মন্ত্রণালয়ও আর টাকা দেয়নি।’
বইগুলো বিক্রি করে লাভ হয়েছিল কিনা, একাডেমির অন্য কাজ ব্যহত হয়েছিল কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তপন বাগচী বলেন, ‘বইগুলো প্রকাশের কারণে একাডেমির মারাত্মক কোনো হ্যাম্পার হয়নি। যে বিভাগ থেকে এগুলো বের হয়েছিল, সে বিভাগে অন্যান্য বই কিছু কম বেরিয়েছে।’
বাংলা একাডেমি থেকে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত এসব বই বের হয়েছিল গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের আওতায়। তখন বিভাগটির পরিচালক ছিলেন মোবারক হোসেন। কিছুদিন হলো অবসরে গেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সে সময় বেশকিছু বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল। আর একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নেই বইগুলো ছাপা হয়েছিল।
কত কপি ছাপা হয়েছিল, কে পেয়েছিলেন কত টাকা
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০২টি বইয়ের সবগুলোই ১ হাজার ২৫০ কপি করে ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। লেখক ও সম্পাদকদের রয়্যালটি দেওয়া হয়েছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। আর সম্পাদকেরা পেয়েছিলেন এককালীন ২০ হাজার টাকা। তবে কোনো বইয়ের ক্ষেত্রে একাধিক সম্পাদক থাকলে এই ২০ হাজার টাকাই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তপন বাগচীর মতে, ‘এটা স্পেশাল কিছু ছিল না। নরমাল যেভাবে বই বের হয়, সেভাবেই করা হয়েছে। শুধু বঙ্গবন্ধুর লোগোটাই স্পেশাল ছিল। এর থেকে বেশি কিছু না।’
বইগুলো পড়ে আছে স্টোরে, এখন কী হবে
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বেরোনো এসব বইয়ের অনেকগুলোয় এখন বাংলা একাডেমির স্টোরে পড়ে আছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে বইগুলো বাংলা একাডেমি এখন আর বিক্রি করছে না। বন্ধ রেখেছে বইয়ের প্রদর্শনীও। এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে এসব বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘বইগুলো স্টোর করা হয়েছে। ছাপা হয়েছে যেহেতু, সেজন্যই এ ব্যবস্থা।’
বইগুলো আর বিক্রয়কেন্দ্র বা প্রদর্শন কেন্দ্রে দেওয়া হবে কিনা, প্রশ্নের উত্তরে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘এখনও বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
প্রকাশিত বইগুলোর মান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মহাপরিচালক জানান, ‘মান নিয়ে আমি বলতে পারব না। কারণ, বইগুলো তো আমি পড়িনি। তবে ব্যাপারটি আসলে মান নিয়ে নয়, এটি ছিল একটি পলিটিক্যাল ইন্টারভেনশন। এ পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পরেই এসব বইয়ের কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখা হয়েছে।’
২০২০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ দেশব্যাপী সাড়ম্বরে পালন করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি নানা আয়োজন করেছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে শেখ মুজিবের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়িয়ে মোট ১০২টি বই বের করেছিল তারা। কয়েকটি বই ছিল শেখ মুজিবের সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়েও। তবে এসব বইয়ের বিষয়, লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও মান নিয়ে শুরু থেকেই পাঠক সমাজে প্রশ্ন ছিল। আবার এসব বইয়ের মাধ্যমে ‘আওয়ামী লীগের বয়ান তৈরি করা হচ্ছে’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন এমন মন্তব্যও করেছিলেন কেউ কেউ।
সব মিলিয়ে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি থেকে যে বইগুলো বেরিয়েছিল, স্ট্রিমের অনুসন্ধানে তার মধ্যে অনেক অস্বচ্ছতার প্রমাণ মিলেছে।
বাংলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে একাডেমির সে সময়ের মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী ১০০টি বইয়ের পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি বাজেট দিয়েছিলেন তিনি। চমকপ্রদ বিষয় হলো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তখন কোনো টাকা না দেওয়ার পরেও একাডেমি নিজস্ব বরাদ্দ থেকে বইগুলো বের করা হয়। বর্তমানে বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানার পরিচালক তপন কুমার বাগচী এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি নিজে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এভাবে অন্য খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে বইগুলো প্রকাশের ফলে অন্যান্য বিভাগের কাজেও তার প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন একাডেমির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
লেখক নির্বাচন ও মান নিয়ে প্রশ্ন
বাংলা একাডেমি থেকে মুজিব শতবর্ষে যে ১০২টি বই বের হয়েছিল, সেগুলোর লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। আর প্রকাশের পর বইগুলোর মান নিয়েও কথা উঠেছে। যদিও তখন কেউ সরাসরি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলা নিরাপদ মনে করেননি, তবে ২০২৪ সালে ২৩ জুন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু গবেষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বইগুলোর বেশ কয়েকটি আমি দেখেছি। বইগুলো খুবই উন্নত মানের। তবে বইগুলো আরও সম্পাদনা করা দরকার ছিল।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাডেমির এক পরিচালক স্ট্রিমকে জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একাডেমি থেকে যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ১০ শতাংশও পড়ার মতো না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার জন্যই তখন বইগুলো প্রকাশ করা হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যাঁরা বইগুলো লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই-ই কাজটি করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। তাঁর মতে, এখানে মূলত তিন ধরনের লেখক ও সম্পাদক ছিলেন। এক দল হলেন যাঁরা আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণে আগ্রহী; বই লিখে সরকার থেকে কোনো প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন আরেক দল; আর কিছুসংখ্যক ছিলেন, যাঁরা শুধু টাকার জন্যই লিখেছিলেন।
বইগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন করলে ওই কর্মকর্তা জানান, বইগুলোর বেশির ভাগই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা ও স্তুতিতে ভরা। সে তুলনায় এখানে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তথা ক্রিটিক্যাল অবজারভেশন কম। ভালো কাজ খুব কমই আছে।
আর এ প্রসঙ্গে প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত থাকা তপন বাগচীর কথা হলো, ‘১০২টি বই বের হলে ২০টির মানে একটু ঘাটতি থাকতে পারে। এখন ধরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটা লেখা দিলেন। সেটা করতে হয়। অথবা অন্য কোনো বিশিষ্ট কেউ দিলেন, সেটাও তো আমাদের করতে হয়।’
বিষয় নিয়েও আছে কথা
শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যেসব বই বেরিয়েছে, তার বিষয় নির্বাচন নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। গ্রন্থমালায় শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে এমন কিছু বিষয় যুক্ত করে বই প্রকাশিত হয়েছে, যার সঙ্গে তাঁর জীবন ও কর্মের সংযোগ তৈরি করা কষ্টকর। অনেক ক্ষেত্রে সংযোগটি ঘটেওনি। এক্ষেত্রে সাইমন জাকারিয়ার লেখা ‘সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি’ এবং আবুল কাসেমের ‘বঙ্গবন্ধু ও চা শিল্প’ বই দুটির উদাহরণ দেওয়া যায়। ইতিহাসের বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন, এমন এক পাঠক মুনিম রাব্বী। তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থমালার অধীনে এমন কিছু বই বের করা হয়েছে, যা না করলেও চলত।’
বইগুলোর লেখক কারা
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ক্যাটালগ থেকে বইগুলোর সম্পূর্ণ তালিকা পেয়েছে স্ট্রিম। তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্পে মোট ৬৯ জন লেখক ও সম্পাদকের মধ্যে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত বা কর্মরত ১৫ জন, বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে আমলা ১৩ জন, শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ২০ জন, সাংবাদিক আছেন পাঁচজন, কবি ও লেখক ছয়জন এবং রাজনীতিবিদ ও সংগঠক রয়েছেন কয়েকজন। এর মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আর এখানে লেখক ও সম্পাদক হিসেবে যেসব বিদ্যায়তনের শিক্ষকেরা ছিলেন, তাঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
লেখক তালিকার প্রায় সবাই-ই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। তবে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত আছেন, এমন লেখকদের সংখ্যাই এখানে বেশি। এমনকি লেখালেখির পাশাপাশি যাঁরা অন্য পেশায় যুক্ত, তাঁরাও কোনো না কোনোভাবে একাডেমির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তাই এর লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে, এমন বলেছেন বইপত্র সংশ্লিষ্টজনেরা।
বাজেট না থাকার পরেও বই
২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ পালনের সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ২০২১ সালের ২৪ মে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে মুজিব শতবর্ষ-এ বই প্রকাশের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার একটি বাজেট দেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, সে সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ বাজেট অনুমোদন করেনি। তারা বলেছিল, একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নেই বইগুলো বের করতে হবে। তখন বাংলা একাডেমির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল, এত টাকা কি একাডেমি বইগুলো থেকে তুলে আনতে পারবে?
প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত তপন কুমার বাগচী সে সময়ের ঘটনাবলি তুলে ধরে স্ট্রিমকে বলেন, ‘হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্যার থাকার সময় প্রথমে ১০০টি বইয়ের পরিকল্পনা করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ১০২টি বই বের হয়। প্রতি বইয়ে দুই লাখ টাকার হিসাব দিয়ে মোট ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার একটা প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় বই প্রকাশের জন্য এক টাকাও দেয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, কীভাবে আমরা এখান থেকে লাভ করব। তারা আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে বলেছিল, আমরাও তা-ই করেছিলাম।
এ প্রসঙ্গে তপন বাগচী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষে যে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল, তার থেকে বাংলা একাডেমি টাকা পায়নি, পেয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি। তারা প্রতি জেলায় নাটক করেছে।’
এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রক্রিয়াটির সঙ্গে আমি ছিলাম তো… এক টাকাও দেয়নি। তখন প্রাথমিকভাবে দশটি বই বের হলো। দেখলাম, সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর আরও পাণ্ডুলিপি আসা শুরু হলো। সেগুলোও করা হলো। মানে কোনো প্রকল্প অনুযায়ী কোনো কিছু করা হয়নি। আর কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ যেহেতু শেষ গিয়েছিল, সেজন্য মন্ত্রণালয়ও আর টাকা দেয়নি।’
বইগুলো বিক্রি করে লাভ হয়েছিল কিনা, একাডেমির অন্য কাজ ব্যহত হয়েছিল কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তপন বাগচী বলেন, ‘বইগুলো প্রকাশের কারণে একাডেমির মারাত্মক কোনো হ্যাম্পার হয়নি। যে বিভাগ থেকে এগুলো বের হয়েছিল, সে বিভাগে অন্যান্য বই কিছু কম বেরিয়েছে।’
বাংলা একাডেমি থেকে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত এসব বই বের হয়েছিল গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের আওতায়। তখন বিভাগটির পরিচালক ছিলেন মোবারক হোসেন। কিছুদিন হলো অবসরে গেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সে সময় বেশকিছু বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল। আর একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নেই বইগুলো ছাপা হয়েছিল।
কত কপি ছাপা হয়েছিল, কে পেয়েছিলেন কত টাকা
বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০২টি বইয়ের সবগুলোই ১ হাজার ২৫০ কপি করে ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। লেখক ও সম্পাদকদের রয়্যালটি দেওয়া হয়েছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। আর সম্পাদকেরা পেয়েছিলেন এককালীন ২০ হাজার টাকা। তবে কোনো বইয়ের ক্ষেত্রে একাধিক সম্পাদক থাকলে এই ২০ হাজার টাকাই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তপন বাগচীর মতে, ‘এটা স্পেশাল কিছু ছিল না। নরমাল যেভাবে বই বের হয়, সেভাবেই করা হয়েছে। শুধু বঙ্গবন্ধুর লোগোটাই স্পেশাল ছিল। এর থেকে বেশি কিছু না।’
বইগুলো পড়ে আছে স্টোরে, এখন কী হবে
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বেরোনো এসব বইয়ের অনেকগুলোয় এখন বাংলা একাডেমির স্টোরে পড়ে আছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে বইগুলো বাংলা একাডেমি এখন আর বিক্রি করছে না। বন্ধ রেখেছে বইয়ের প্রদর্শনীও। এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে এসব বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘বইগুলো স্টোর করা হয়েছে। ছাপা হয়েছে যেহেতু, সেজন্যই এ ব্যবস্থা।’
বইগুলো আর বিক্রয়কেন্দ্র বা প্রদর্শন কেন্দ্রে দেওয়া হবে কিনা, প্রশ্নের উত্তরে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘এখনও বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
প্রকাশিত বইগুলোর মান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মহাপরিচালক জানান, ‘মান নিয়ে আমি বলতে পারব না। কারণ, বইগুলো তো আমি পড়িনি। তবে ব্যাপারটি আসলে মান নিয়ে নয়, এটি ছিল একটি পলিটিক্যাল ইন্টারভেনশন। এ পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পরেই এসব বইয়ের কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখা হয়েছে।’
আট বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর কোনও সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এই সংকট এখন কার্যত ‘স্থবির অবস্থায়’ রয়েছে। কারণ সমাধান শুধু বাংলাদেশ–মিয়ানমারের উপর নির্ভর করছে না। বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সক্রিয় ভূমিকাও জরুরি।
১ দিন আগেকক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পর তাদের জীবন ও প্রকৃতির ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে এবং এই সংকটের ভবিষ্যৎ কী—এসব বিষয় নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষক ও গবেষক জাভেদ কায়সার।
১ দিন আগেআজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আসার আট বছর। এদিনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের ইতিহাস, তাদের ফেরত পাঠানোর জটিলতা, আরাকান আর্মি, চীন ও ভারতের প্রভাব—এসব নিয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা বলেছেন লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ
১ দিন আগেবাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুজিবপিডিয়া’। প্রকাশের পরপরই বইটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দুই খণ্ডে লেখা এই বইকে ‘জ্ঞানকোষ’ হিসেবে দাবি করে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের...
৪ দিন আগে