leadT1ad

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাকসু নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি, ‘ক্ষমতার লাগাম’ উপাচার্যের হাতে

আবাসন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন বা খাবারের ভর্তুকির মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মূল দাবি। প্রার্থীরাও এগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু গঠনতন্ত্রে এগুলো করবার এখতিয়ার রাকসু প্রতিনিধিদের হাতে রাখা হয়নি।

Multiple Authors
স্ট্রিম প্রতিবেদক ও স্ট্রিম সংবাদদাতা
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২০: ৪৩
প্রার্থীরা ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতির কথা বললেও প্রকৃত বাস্তবায়নকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। স্ট্রিম গ্রাফিক

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করছেন নানা প্রতিশ্রুতি। ইশতেহারে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ, আবাসন সংকট নিরসন, খাবারের মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংস্কার—বাদ যায়নি কিছুই।

কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ির বিপরীতে রাকসুর গঠনতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। গঠনতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রার্থীদের ইশতেহারের অনেকখানিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে সিদ্ধান্তই নিক, শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাত ধরে।

ইশতেহারে কী বলছেন প্রার্থীরা

এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্যানেলগুলোর ইশতেহার বেশ উচ্চাভিলাষী। ১০ বছরের অ্যাকাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে প্রশাসনকে বাধ্য করা এবং অ্যালামনাইদের সহায়তায় হল নির্মাণে তহবিল গঠনের কথা বলছে ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ ১২ মাসে ২৪টি সংস্কারের কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে শতভাগ আবাসিক করার রোডম্যাপ, আবাসন ভর্তুকি এবং শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা।

অন্যদিকে বামপন্থী ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী ফুয়াদ রাতুল তাঁর ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১০ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা এবং ক্যাম্পাস শাটল সার্ভিস চালুর মতো দাবিগুলো সামনে এনেছেন।

এদিকে ছাত্রদল-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার প্রকাশ করেনি। তবে প্যানেলটির ভিপিপ্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর স্ট্রিমকে জানান, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে ইশতেহার প্রকাশ করবেন তাঁরা।

এর বাইরে প্রায় সব প্যানেল ও প্রার্থীই নিয়মিত রাকসু নির্বাচন এবং উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার মতো মৌলিক সংস্কারের কথা বলছে।

‘ক্ষমতার লাগাম’ গঠনতন্ত্রের হাতে

প্রার্থীরা সংস্কারের আলাপ তুললেও, রাকসুর গঠনতন্ত্র ভিন্ন কথা বলছে। গঠনতন্ত্রে মূলত প্রশাসনের হাতেই ক্ষমতা রাখা হয়েছে, বিশেষ করে উপাচার্যের। পদাধিকারবলে রাকসুর সভাপতি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

গঠনতন্ত্রের ৭ (১)(ই) ধারা অনুযায়ী, সভাপতির (উপাচার্য) অনুমোদন ছাড়া নির্বাহী কমিটির কোনো সিদ্ধান্তই বৈধ হবে না। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করবে, তাদের নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ছাড়পত্র আসতে হবে উপাচার্যের দপ্তর থেকে।

এর চেয়েও শক্তিশালী ধারা হলো ৭(১)(সি)। এই ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য সংসদের ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ যেকোনো সময় যেকোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতে পারেন। এমনকি তিনি পুরো নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনেরও ডাক দিতে পারেন। এখানে ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ কী, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং, প্রশাসনের সঙ্গে মতের অমিল হলে পুরো ছাত্র সংসদই ভেঙে দেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে রয়েছে।

যেখানে রাকসুর আসল শক্তি

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাকসুর ক্ষমতা বেশ সীমিত হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এর কাজ করার সুযোগ রয়েছে। গঠনতন্ত্র মোতাবেক, রাকসুর মূল কাজের ক্ষেত্র হলো সহশিক্ষা কার্যক্রম। ধারা ২ এবং ৭ অনুযায়ী, রাকসুর বিভিন্ন সম্পাদক, যেমন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, বিতর্ক ও সাহিত্য—নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম আয়োজন করতে পারেন।

সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের ‘হামদ, নাত, কাওয়ালি’ আয়োজনের প্রতিশ্রুতি কিংবা অন্যান্য প্যানেলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক উৎসবের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নযোগ্য। কারণ, এসব কাজের জন্য বাজেট প্রণয়ন করে নির্বাহী কমিটির মাধ্যমে তা সহজেই অনুমোদন করানো সম্ভব। প্রকাশনা সম্পাদকের আওতায় ম্যাগাজিন বা জার্নাল প্রকাশ করাও রাকসুর ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে সেমিনার বা কর্মশালা আয়োজনের ক্ষমতাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদকের রয়েছে। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন জোরদার করতে রাকসু গঠনতন্ত্র অধিক জোর দিয়েছে।

বাস্তবায়নকারী নাকি চাপ প্রয়োগকারী

আবাসন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন বা খাবারের ভর্তুকির মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মূল দাবি। প্রার্থীরাও এগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু গঠনতন্ত্রে এগুলো করবার এখতিয়ার রাকসু প্রতিনিধিদের হাতে রাখা হয়নি। অনেকেই তাই রাকসু প্রতিনিধিদের বাস্তবায়নকারী নয়, বরং চাপ প্রয়োগকারী হিসেবে দেখছেন।

যেমন, সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ইশতেহারের শুরুতেই লেখা ছিল, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্র প্রতিনিধিদের মেয়াদকাল এবং কর্মপরিসর খুবই স্বল্প। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনে শুধু অবকাঠামোকেই উন্নয়ন হিসেবে হাজির করা হয়েছিল। এই সময়েও আমরা দেখেছি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অনেক মুখরোচক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেখা যাচ্ছে, যা ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।’

প্যানেলটি তাই নিজেদের ইশতেহারে অনেকক্ষেত্রেই সরাসরি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে চাপ প্রয়োগের কথা বলেছে।

রাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রার্থীদের অভিযোগ বিষয়ে স্ট্রিমের সঙ্গে কথা হয় সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ভিপিপ্রার্থী তাসিন খানের। তিনি বলেন, ‘রাকসু আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু এর গঠনতন্ত্র আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। আমরা যখন রাকসুকে শিক্ষার্থীদের সংগঠন হিসেবে কল্পনা করি, তখন দেখি এই গঠনতন্ত্রে নেতৃত্বের অধিকার সম্পূর্ণ ছাত্রদের হাতে নেই। উপাচার্য পদাধিকার বলে সভাপতি হন, অথচ আমাদের কণ্ঠ, আমাদের প্রতিনিধি সেখানে অনুপস্থিত। এটা আমাদের কাছে বেশ অগণতান্ত্রিক মনে হয়।’

তাসিন অভিযোগ করেন, ‘নির্বাচনের কোনো স্থায়ী সময়সূচি নেই। ফলে প্রশাসন যখন ইচ্ছা, তখন নির্বাচন স্থগিত করতে পারে। ছাত্রদের অধিকার যেন এক অনিশ্চয়তার খাঁচায় বন্দি। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ, নির্ধারিত নির্বাচনকাল, যেখানে ছাত্ররা জানবে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন কবে হবে।’

তাসিনের মতে, গঠনতন্ত্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলো শুধরে না নিলে, রাকসু কখনোই প্রকৃত শিক্ষার্থীদের জায়গা হবে না। তাই তাঁরা এই গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন।

গঠনতন্ত্র বদলাতে কী করতে হবে

প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হলো গঠনতন্ত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলো। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করার পথটা বেশ জটিল।

গঠনতন্ত্রের ধারা ১৬ অনুযায়ী, এটি সংশোধন করতে হলে রাকসুর মোট সদস্যের অর্ধেকের স্বাক্ষরসহ প্রস্তাব জমা দিতে হবে। এরপর সাধারণ সভায় মোট সদস্যের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা পাস করাতে হবে।

রাকসুর গঠনতন্ত্রে প্রশাসনের সর্বময় ক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এফ নজরুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে কথা বলি। প্রার্থীদের যদি গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্যা হয়, তাহলে তাঁরা নির্বাচিত হওয়ার পর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে পারবে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত