যেকোনো দুর্যোগই (বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প) মানুষের জীবনকে সংখ্যায় পর্যবসিত করে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প সেই সংখ্যায়ও যেন এক ভয়ংকর বিভাজন রেখা টেনে দিল। সেই বিভাজনের নাম—প্রাপ্তবয়স্ক বনাম অপ্রাপ্তবয়স্ক, সচেতন বনাম অসহায়, রাজনৈতিক উপযোগিতা বনাম অনুপযোগিতা।
গণমাধ্যমে খবর এলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি একাধিক মেডিকেল কলেজও ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে। কারণ? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতি দরকার। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘ভূমিকম্প অনিশ্চিত, বিদ্যালয় বন্ধের সুযোগ নেই, আতঙ্ক নয়, সতর্কতা ও প্রস্তুতিই গুরুত্বপূর্ণ।’
এই সিদ্ধান্তে এক তীব্র দার্শনিক প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের চোখে জীবনের মূল্য কি কেবল তার সম্ভাব্য উপযোগিতার ওপর নির্ভর করে কি না? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজের ‘ভবিষ্যৎ সম্পদ’, ‘আগামী দিনের নেতা’, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল’। তাই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো দ্রুততম পন্থায়। আর সেই নিষ্পাপ শৈশব, যারা হয়তো ভূমিকম্প কী, কেন হয়—তাও জানে না, তাদের ঠেলে দেওয়া হলো খোলা আকাশের নিচে, জরাজীর্ণ ভবনের সম্ভাব্য ধ্বংসস্তূপের নিচে!
প্রাচীণ পুরাণে আমরা দেখেছি, প্রমিথিউস মানুষের জন্য আগুন এনে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রকে হতে হয় প্রমিথিউসের মতো, যে অন্ধকারে আগুন জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কী করল? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বক্তব্যটিকে যদি রাষ্ট্রের অফিশিয়াল ন্যারেটিভ ধরি, তাহলে এর ভেতরের গভীর বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘ভূমিকম্পের মতো অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। ভূমিকম্প যেকোনো সময় হতে পারে, তাই আতঙ্ক নয়, বরং সতর্কতা ও প্রস্তুতিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
অর্থাৎ ‘সতর্কতা ও প্রস্তুতিই’ এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্র কি এ দুটি কাজ যথাযথভাবে করেছে? রাষ্ট্র বছরের পর বছর ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিশু-শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন বসিয়ে রেখেছে। তাদের জন্য একটিও ‘ডিপ অ্যান্ড কভার ড্রিলের’ আয়োজন করেনি। তাদের হাতে কোনোদিন সচেতনতার লিফলেট ধরিয়ে দেয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ফাটল দেখা যাওয়ার খবর এসেছে (যেমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ফাটল), তবুও তাদের ছুটি মেলেনি।
প্রশ্ন হলো, যে শিশুটির হাত থেকে পেন্সিলটি পড়ে গেলে সে কেঁদে ওঠে, যে শিশুটি তার নিজের বিপদ সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতন নয়, যার মস্তিষ্ক এখনো আতঙ্ক ও বাস্তবের পার্থক্য বুঝতে সক্ষম নয়—সে কীভাবে ‘সতর্কতা ও প্রস্তুতি’ নেবে? যখন ভূমিকম্পের প্রথম আঘাতে মেঝে কেঁপে ওঠে, তখন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা হয়তো দৌড়ে ক্লাসরুম থেকে বা হল ছেড়ে বাইরে আসে। কারণ তারা ঝুঁকিটি বোঝে। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা? তারা নিশ্চিতভাবেই বড়দের তুলনায় অনেক বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হবে এবং তাদের ঝুঁকি সামলানোর ক্ষমতাও অনেক কম।
অথচ দেখুন, প্রাপ্তবয়স্ক, আত্মরক্ষায় সক্ষম, যারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে—সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া এবং আতঙ্ক কাটাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর আতঙ্ক’ গুরুতর, কিন্তু প্রাথমিক স্তরের কোটি শিশুর নীরব, অসহায় আতঙ্ক তুচ্ছ। রাষ্ট্রের এই ডিসকোর্সে একটি জিনিস পরিষ্কার; তা হলো—প্রাপ্তবয়স্কদের নিরাপত্তা তাদের মেধা ও উপযোগিতার কারণে; শিশুদের নিরাপত্তা তাদের সংখ্যাধিক্য ও প্রান্তিকতার কারণে উপেক্ষিত।
এই বৈষম্যের গভীরে প্রোথিত আছে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের এক ঐতিহাসিক শ্রেণিকরণ। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা হলো সাধারণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষা। এর শিক্ষার্থীরা সমাজে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব ফেলছে না। উপরন্তু, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল হওয়ার সক্ষমতা রাখে না। ফলে তাদের ভবনের ফাটল নিয়ে কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
রাষ্ট্র যদি সত্যিই ‘সতর্কতা ও প্রস্তুতি’তে বিশ্বাস করত, তাহলে প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সেগুলোকে সাময়িকভাবে বন্ধ করত। ভূমিকম্পের জন্য বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা মহড়া (ড্রিল) পরিচালনা করত। শিশুদের জন্য সহজ ভাষায় সচেতনতা তৈরি করত।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে জাতীয় সংবাদ তৈরি হয়, রাজনীতি প্রভাবিত হয়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। তাদের অসন্তোষ সরকারকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। রাষ্ট্রের ক্যালকুলাসে একটি শিশু নিহত হওয়ার চেয়ে একজন অসন্তুষ্ট ছাত্র বেশি বিপজ্জনক। কারণ নিহত শিশু কেবল একটি শোকের সংখ্যা, কিন্তু অসন্তুষ্ট ছাত্র একটি বিদ্রোহের বীজ।
সঙ্গতকারণে রাষ্ট্র প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ না করে এক ধরনের প্রতীকী বলিদান নিশ্চিত করল। তারা যেন বলল, ‘ভূমিকম্প এলে তোমরা মরবে, কিন্তু আমরা তোমাদের জন্য একটি অপরিহার্য ‘‘শিক্ষাক্রম’’ বন্ধ করতে পারি না।’ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিদ্যালয়গুলোতে ‘সতর্কতামূলক নির্দেশনা’ পাঠালেন, যার অর্থ সম্ভবত ‘ভূমিকম্পের সময় টেবিলের নিচে যাও’—এমন কিছু। কিন্তু যেসব বিদ্যালয়ের ভবন নিজেই দুর্বল এবং ফাটল ধরা, সেখানে টেবিলের নিচে যাওয়া আর কফিনের ভেতরে যাওয়া কি একই কথা নয়?
এ যেন সেই প্রাচীন মিশরীয় শাসকদের মানসিকতা, যারা মনে করত, পিরামিডের ভিত্তি নির্মিত হবে দাসদের জীবন দিয়ে। এখানে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা যেন সেই দাস। তারা জীবন দিয়ে পিরামিডের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করবে।
রাষ্ট্র যদি সত্যিই ‘সতর্কতা ও প্রস্তুতি’তে বিশ্বাস করত, তাহলে প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সেগুলোকে সাময়িকভাবে বন্ধ করত। ভূমিকম্পের জন্য বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা মহড়া (ড্রিল) পরিচালনা করত। শিশুদের জন্য সহজ ভাষায় সচেতনতা তৈরি করত।
তা না করে ‘ভূমিকম্প অনিশ্চিত’ বলে তাদের ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হলো। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাঠানো হলো নিজ নিজ বাড়িতে, মা বাবার কাছে। এই বৈষম্য প্রমাণ করে, আমাদের রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের মূল্য তাদের সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক উপযোগিতা দিয়ে পরিমাপ করে। যখনই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তখনই সমাজের দুর্বলতম অংশটি রাষ্ট্রের এই নীরব সিদ্ধান্তের কাছে পরাজিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ হলো, হল খালি হলো—কারণ তারা প্রতিবাদ করতে পারে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে জিআই পাইপ চালাতে পারে। কিন্তু শিশুরা তা পারে না। এই রাজনীতির বাজারে তাই তাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক