leadT1ad

৬৩৪ বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো

কিউবার আইকনিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো সিআইএর কাছে প্রায় পৌরাণিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা উঠে-পড়ে লেগেছিল। তাঁকে হত্যার জন্য এমন কোনো হীন প্রচেষ্টা নেই যা তারা করেনি। মৃত্যুবার্ষিকীতে কাস্ত্রোর প্রতি শ্রদ্ধা।

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

কিউবার সাবেক সিক্রেট সার্ভিস প্রধানের ভাষ্যমতে, ফিদেল কাস্ত্রো অন্তত ৬৩৪ বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন।

পরিসংখ্যানটি পুরোপুরি নির্ভুল নাও হতে পারে। কিউবার এই আইকনিক নেতা সিআইএ-র কাছে প্রায় পৌরাণিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা উঠে-পড়ে লেগেছিল। তাঁকে হত্যার জন্য এমন কোনো হীন প্রচেষ্টা নেই যা তারা করেনি।

কাস্ত্রোকে হত্যার এই প্রচেষ্টাগুলো কখনও ছিল ভয়ংকর, আবার কখনো বা নিছক হাস্যকর। ১৯৭৫ সালে ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের নেতৃত্বে গঠিত সিনেটের বিশেষ উপকমিটি, যা ‘চার্চ কমিটি’ নামে পরিচিত, তাদের প্রতিবেদনে এর অনেকগুলোর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে।

কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর, সেই সব প্রচেষ্টার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাতটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো।

ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি
ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি

১. বিস্ফোরক চুরুট

১৯৬০ সালে কাস্ত্রোর প্রিয় চুরুটের বাক্সে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টাটি সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা। ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছর পরেই, সিআইএ চুরুটগুলোতে এমন শক্তিশালী ‘বটুলিনাম টক্সিন’ মিশিয়েছিল যা মুখে দিলেই যে কোনো মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত।

কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৬১ সালে এক ‘অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি’র কাছে চুরুটগুলো পৌঁছে দেওয়া হলেও এরপর সেগুলোর কী পরিণতি হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। তবে বলা বাহুল্য, ‘এল কমান্দান্তে’ সেই চুরুটগুলোতে কখনো সুখটান দেননি।

২. অনিচ্ছুক কিউবান

প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের মেয়াদের শেষদিকে, কাস্ত্রোকে সরানোর জন্য মাফিয়া জগত বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করে সিআইএ। চার্চ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, সংস্থাটি এর জন্য দেড় লাখ ডলার (আজকের দিনে প্রায় ১২ লাখ ডলার) দিতেও প্রস্তুত ছিল।

এই কাজের জন্য শিকাগো মাফিয়া বস স্যাম জিয়ানকানা এবং কিউবায় মাফিয়া সিন্ডিকেটের প্রধান সান্তোস ট্রাফিক্যান্ট—যারা এফবিআই-এর 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় ছিলেন—তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। জিয়ানকানা পরামর্শ দেন, বন্দুকের চেয়ে বিষাক্ত বড়ি বেশি কার্যকর। ফলে সিআইএ কাস্ত্রোর কাছাকাছি থাকা এক অভাবী কিউবান কর্মকর্তাকে ছয়টি অতি-বিষাক্ত বড়ি সরবরাহ করে। কিন্তু কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর সেই কর্মকর্তা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান এবং শেষমেশ পরিকল্পনাটি পরিত্যক্ত হয়।

সিআইএ কাস্ত্রোর একটি ডাইভিং স্যুটে এমন এক ফাঙ্গাস বা ছত্রাক মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে, যা ভয়াবহ চর্মরোগ সৃষ্টি করবে। আর তাই, কাস্ত্রোকে উপহার হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল এই স্যুট ও একটি সংক্রামিত শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র। পৌঁছে দেওয়ার লোকের কথা ভাবা হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমেরিকান আইনজীবী জেমস ডনোভান। তখন তিনি কিউবান নেতার সঙ্গে জিম্মি সংকটের আলোচনায় যুক্ত ছিলেন।

৩. রঙিন ঝিনুক

দমে না গিয়ে ১৯৬৩ সালে সিআইএ আরও অদ্ভুত এক ফন্দি আঁটে। কাস্ত্রোর স্কুবা-ডাইভিংয়ের প্রতি ভালোবাসাকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে হত্যার ছক কষা হয়। পরিকল্পনা ছিল, একটি বড় ঝিনুকের ভেতরে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা হবে এবং সমুদ্রপ্রেমী এই কমিউনিস্ট নেতাকে আকৃষ্ট করতে ঝিনুকটিকে বিচিত্র ও উজ্জ্বল রঙে রাঙানো হবে।

কিন্তু কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্য অনেক পরিকল্পনার মতো এটিও ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়।

৪. দূষিত ডাইভিং স্যুট

একই বছর, সিআইএ কাস্ত্রোর একটি ডাইভিং স্যুটে এমন এক ফাঙ্গাস বা ছত্রাক মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে, যা ভয়াবহ চর্মরোগ সৃষ্টি করবে। আর তাই, কাস্ত্রোকে উপহার হিসেবে দেওয়ার কথা ছিল এই স্যুট ও একটি সংক্রামিত শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র। পৌঁছে দেওয়ার লোকের কথা ভাবা হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমেরিকান আইনজীবী জেমস ডনোভান। তখন তিনি কিউবান নেতার সঙ্গে জিম্মি সংকটের আলোচনায় যুক্ত ছিলেন।

কিন্তু ডনোভান কাস্ত্রোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি নিরাপদ স্যুট উপহার দিলে এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তী সময়ে সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস এই পরিকল্পনাকে ‘উদ্ভট’ বলে অভিহিত করেন এবং জানান যে ওই স্যুট ল্যাবরেটরির বাইরেই যায়নি।

ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি
ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি

৫. হানিট্র্যাপ

অনেকটা জেমস বন্ডের সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো শোনালেও, মারিতা লরেঞ্জ ছিলেন কাস্ত্রোর জীবনের সেই ‘ফেম ফাতাল’ বা প্রাণঘাতী নারী—আজকের দিনে একে হানিট্র্যাপও বলা হয়। ১৯৯৩ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লরেঞ্জ জানান, ১৯৫৯ সালের শেষদিকে তিনি যখন কাস্ত্রোর প্রেমিকা ছিলেন, তখন সিআইএ তাঁকে রিক্রুট করে এবং কিউবান নেতাকে হত্যার দায়িত্ব দেয়।

তাঁকে দুটি 'বটুলিজম-টক্সিন' বড়ি দেওয়া হয়েছিল কাস্ত্রোর পানীয়তে মেশানোর জন্য। এর একটিই ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু লরেঞ্জ শেষ মুহূর্তে ভয় পেয়ে যান। তিনি বলেন, ‘হাভানার রূপরেখা দেখা মাত্রই আমি বুঝতে পারলাম, এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।’

তাছাড়া তিনি কাজটি করতে চাইলেও তা ভণ্ডুল করে ফেলেছিলেন। তিনি বড়িগুলো কোল্ড-ক্রিমের কৌটায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, ফলে সেগুলো গলে নষ্ট হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, কাস্ত্রো বিষয়টি ধরে ফেলেছিলেন। লরেঞ্জ স্মৃতিচারণ করেন, ‘তিনি ঝুঁকে নিজের .৪৫ পিস্তলটি বের করে আমার হাতে দিলেন। চোখের পলকও ফেললেন না। বললেন, ‘তুমি আমাকে মারতে পারবে না। কেউ আমাকে মারতে পারবে না।’ তারপর তিনি হাসলেন এবং চুরুট চিবুতে লাগলেন... আমি নিজেকে অসহায় অনুভব করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আমরা ভালোবাসায় মগ্ন হলাম।’

চার্চ কমিটির তথ্যের মতো এই গল্পটি অতটা দালিলিক নয়, তবুও সিআইএ-র অতীত রেকর্ড বিবেচনায় এটি অবিশ্বাস্য মনে হয় না।

সব চেষ্টাই যে কাস্ত্রোর প্রাণনাশের জন্য ছিল, তা নয়। মার্কিন গোয়েন্দারা প্রথমে তাঁর ‘ক্যারিশম্যাটিক’ জননেতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টাও করেছিল। ১৯৬০ সালে সিআইএ পরিকল্পনা করে, কাস্ত্রোর ব্রডকাস্টিং স্টুডিওতে এমন রাসায়নিক স্প্রে করা হবে যা এলএসডি-র মতো হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করবে, যাতে তিনি বক্তৃতার সময় মতিভ্রমের শিকার হন।

৬. বিষাক্ত কলম

জেমস বন্ডের সিনেমা থেকে উঠে আসা সিআইএ-র আরেকটি পরিকল্পনা ছিল কলমের ভেতরে লুকানো হাইপোডার্মিক সুঁচ দিয়ে কাস্ত্রোকে হত্যা করা। সুঁচটি এতটাই সূক্ষ্ম হওয়ার কথা ছিল যে, শরীরে প্রবেশের সময় শিকার টেরও পেতেন না।

চার্চ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বিষাক্ত সুঁচটি কাস্ত্রোর শরীরে পুশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিআইএ-র সঙ্গে আলোচনায় থাকা এক উচ্চপদস্থ কিউবান কর্মকর্তাকে। কিন্তু সেই কর্মকর্তা যন্ত্রটি দেখে হতাশ হন এবং অভিযোগ করেন যে সিআইএ কি এর চেয়ে অত্যাধুনিক কিছু তৈরি করতে পারত না?

আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর তাঁকে এই কলমটি দেওয়া হয়—ঠিক যেদিন জন এফ কেনেডি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। কেনেডির মৃত্যুর পর সিআইএ কাস্ত্রোকে হত্যার এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। সেই কলম আর কিউবায় পৌঁছায়নি।

ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি
ফিদেল কাস্ত্রো। সংগৃহীত ছবি

৭. রাসায়নিক উপাদান

সব চেষ্টাই যে কাস্ত্রোর প্রাণনাশের জন্য ছিল, তা নয়। মার্কিন গোয়েন্দারা প্রথমে তাঁর ‘ক্যারিশম্যাটিক’ জননেতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টাও করেছিল। ১৯৬০ সালে সিআইএ পরিকল্পনা করে, কাস্ত্রোর ব্রডকাস্টিং স্টুডিওতে এমন রাসায়নিক স্প্রে করা হবে যা এলএসডি-র মতো হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করবে, যাতে তিনি বক্তৃতার সময় মতিভ্রমের শিকার হন।

এছাড়া তাঁর চুরুটে এমন রাসায়নিক মেশানোর চিন্তা ছিল যা তাঁকে দিশেহারা করে দেবে, বিশেষ করে তাঁর ম্যারাথন বক্তৃতার আগে। এমনকি তাঁর জুতোর ভেতরে থ্যালিয়াম লবণ ছিটিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবা হয়েছিল, যাতে কাস্ত্রোর বিখ্যাত দাড়ি ঝরে পড়ে।

কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে করা শত শত ষড়যন্ত্রের মতো এগুলোও ব্যর্থ হয়। এলএসডি জাতীয় পদার্থটি খুব অস্থিতিশীল হওয়ায় বাদ দেওয়া হয়, চুরুটগুলো কখনো খাওয়া হয়নি এবং কাস্ত্রো তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করায় জুতোর মধ্যে পাউডার ছিটানোর সুযোগও গোয়েন্দারা পাননি।

তথ্যসূত্র: এনবিএস নিউজ, ভাইস ডট কম

Ad 300x250

সম্পর্কিত