ভারতীয় উপমহাদেশ: পুরাণ, কচ্ছপ ও বাসুকি
ভারতীয় উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলা ও তার আশপাশের এলাকাগুলো ভৌগোলিকভাবে ভূমিকম্পপ্রবণ। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলে প্লেট টেকটনিক্সের প্রভাব মারাত্মক। তাই এখানকার লোককথাতেও ভূমিকম্পের বেশ প্রভাব রয়েছে।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস
ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হতো পৃথিবী একটি বিশাল কচ্ছপের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে। সেই কচ্ছপটি আবার রয়েছে বহু ফণা-যুক্ত একটি সাপের (যেমন: বাসুকি বা অনন্তনাগ) মাথায়। যখন এই কচ্ছপটি নড়েচড়ে বসে বা সাপটি তার ফণা পরিবর্তন করে, তখনই পৃথিবী কেঁপে ওঠে। অর্থাৎ, ভূমিকম্প মানেই কচ্ছপের আড়মোড়া ভাঙার মুহূর্ত! কচ্ছপটি বিশ্রামের জন্য যখনই একটু নড়াচড়া করে, ঠিক তখনই আমাদের ঘর-বাড়ি কেঁপে ওঠে।
কোথাও কোথাও আবার বিশ্বাস করা হয় যে পৃথিবী আটটি বিশাল হাতির পিঠে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের বলা হয় ‘দিগ্গজ’। এই দিগ্গজেরা যখন স্থান পরিবর্তন করে বা ক্লান্ত হয়ে শরীর ঝাঁকায়, তখনই কম্পন শুরু হয়। হাতিদের সামান্য শরীর ঝাঁকুনির মূল্য দিতে হয় কোটি কোটি মানুষকে!
স্ট্রিম গ্রাফিককোথাও কোথাও বিশ্বাস করা হতো যে পৃথিবীতে পাপ বা অন্যায় বেড়ে গেলে দেবরাজ ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হন। তখন তিনি তাঁর বজ্র দিয়ে পৃথিবীকে আঘাত করেন, আর তাতেই কম্পন শুরু হয়। অর্থাৎ আপনার সামান্য মিথ্যা কথা বা অফিসের আলস্যও পৃথিবীর কম্পনের কারণ হতে পারে—একটু চিন্তার নয় কি? পাপের ভারে পৃথিবী যখন নুয়ে পড়ে, তখন ইন্দ্র সেই ভার কমাতে সজোরে আঘাত হানেন।
বাংলা ও আসাম অঞ্চলের লোককথা
১৮৯৭ সালের ‘গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ বা ১৯৫০ সালের মতো বড় ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করেছিল। আসাম-বাংলা অঞ্চলে একসময় বিশ্বাস করা হতো, জলভাগের গভীরের কোনো অতিপ্রাকৃত প্রাণী বা দেবতা পৃথিবীর ভিত নাড়িয়ে দেয়। নদীমাতৃক অঞ্চলে জলভাগের এই শক্তিকে সম্মান করা হতো। যখন নদীতে মাছ ধরার বা মাছ চাষের নিয়ম ভঙ্গ হতো, তখনই সেই দেবতা ক্ষুব্ধ হয়ে কম্পন সৃষ্টি করতেন।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল: মাছ, শূকর ও দৈত্য
এই অঞ্চলটি ‘প্যাসিফিক রিং অব ফায়ার’-এর অংশ হওয়ায়, ভূমিকম্পের লোককথাগুলোও বেশ নাটকীয়।
জাপান: ক্যাটফিশ বা নামাজুর তাণ্ডব
জাপানের মিথোলজিতে ভূমিকম্পের মূল কারিগর হলো এক বিশাল সামুদ্রিক মাছ, যার নাম ‘নামাজু’। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই বিশাল ক্যাটফিশটি পৃথিবীর গভীরে কাদার নিচে বাস করে। আর দেবতা ‘কাশিমা’ নামের একজন শক্তিশালী দেবতা একটি বিশাল পাথর দিয়ে এই মাছটিকে চেপে ধরে রাখেন। কাশিমা যখন একটু অন্যমনস্ক হন বা পাহারা দিতে ভুলে যান, তখনই সুযোগ বুঝে নামাজু তার লেজ বা শরীর ঝাঁকায়। ব্যস, তখনই জাপানে শুরু হয়ে যায় ভূমিকম্প।
অর্থাৎ যখনই জাপানে কাঁপুনি ওঠে, জাপানিরা বুঝে নেয় দেবতা কাশিমা তাঁর নাইট-ডিউটিটা ঠিকমতো পালন করেননি!
ফিলিপাইন: দৈত্যের নড়াচড়া
ফিলিপাইনের আদিবাসীরা বিশ্বাস করতেন, এক বিশাল দৈত্য তাদের ভূখণ্ডের নিচে শুয়ে আছে। এই দৈত্যটি যখন এক পাশ থেকে অন্য পাশে পাশ ফিরে শোয়, তখনই ফিলিপাইনে ভূমিকম্প শুরু হয়। এটি পৃথিবীর মানুষের কাছে দৈত্যটির ঘুমে আড়মোড়া ভাঙার বার্তা।
মঙ্গোলিয়া: পৃথিবীর রক্ষক
মঙ্গোলিয়ার কিছু অঞ্চলে বিশ্বাস করা হয়, পৃথিবী কোনো দৈত্য বা প্রাণী নয়, বরং বিশাল এক শূকরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই শূকরটি যখন শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, তখনই সামান্য কম্পন অনুভূত হয়। আর যদি শূকরটি কোনো কারণে ভয় পেয়ে যায় বা অস্থির হয়ে ওঠে, তবেই বড় ভূমিকম্প হয়।
ইউরোপ ও আমেরিকা: রাগী দেবতাদের কাণ্ড
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং আমেরিকার কিছু আদিবাসী গোত্রের বিশ্বাসে ভূমিকম্পের কারণ প্রায়ই ছিল দেবতাদের রাগ।
গ্রিস: পসেইডন যখন মেজাজ হারান
গ্রিক পুরাণে ভূমিকম্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন সমুদ্রের দেবতা ‘পসেইডন’। যখন পসেইডনের মেজাজ খুব খারাপ হতো, তিনি প্রচণ্ড রাগে তাঁর ত্রিশূল দিয়ে পৃথিবীকে আঘাত করতেন। আর এই তীব্র আঘাতেই আমাদের ধরিত্রী কাঁপতে শুরু করত। চিন্তা করুন, আপনার বাসার কাচের বাসন ভেঙে গেল, আর আপনি ভাবছেন—দেবতা পসেইডন বোধ হয় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছেন!
উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের ধারণা
আমেরিকার আদিবাসী কুইলেট গোত্রের মানুষদের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবী একটি বিশাল তিমিমাছের পিঠে ভাসছে। তিমি যখন অস্বস্তিবোধ করে, তখনই কম্পন শুরু হয়। অন্যদিকে আমেরিকার আপালেচি পর্বতমালায় বসবাসকারী চেরোকি আদিবাসীরা বিশ্বাস করত, বিশ্বস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিতে কোনো বড় ভুল দেখলে বা পাপ দেখলে পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিয়ে সেই বার্তা দেন।
সাইবেরিয়া ও নিউজিল্যান্ড
ভূমিকম্প নিয়ে এই অঞ্চলগুলোর ব্যাখ্যাগুলো ছিল খুবই অদ্ভুত। এরা প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম অংশকে দায়ী করত।
সাইবেরিয়া: কুকুর স্লেজের গল্প
সাইবেরিয়ার ইভানস আদিবাসীর মানুষজন তাদের পরিবেশের ভিত্তিতে এনেছে এক অভিনব ব্যাখ্যা। তারা বিশ্বাস করত, পৃথিবীর নিচে বহু কুকুর স্লেজ (বরফের ওপর চলাচলের যান) টানছে। সেই কুকুরগুলো যখন তাদের শরীরে বসা মাছি বা পোকামাকড়ের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের গা ঝাঁকাতে শুরু করে, ঠিক তখনই পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে একটি ছোট্ট মাছি—বিজ্ঞানীরা এত বছর ধরে প্লেট টেকটোনিক্স নিয়ে গবেষণা করে যদি এটা জানতেন!
মাওরি লোককথা
মাওরিদের কাছে ভূমিকম্পের দেবতা হলেন ‘রুমাওয়াইরোহা’। তিনি পৃথিবীর অভ্যন্তরে বাস করেন। রুমাওয়াইরোহা ছিলেন পৃথিবীর আদি পিতা-মাতার কনিষ্ঠ পুত্র। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন তিনি মাথা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করলে কম্পন শুরু হয়। আবার কিছু মতে, তিনি আগ্নেয়গিরির ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে বা খেলার ছলে পৃথিবী নাড়িয়ে দেন। মাওরিরা বিশ্বাস করত, এই দেবতা শীতকালে উষ্ণ থাকার জন্য আগুন জ্বালান, আর সেই উষ্ণতার প্রভাবেই পৃথিবী কাঁপে।
কল্পনা যখন জ্ঞান
আজ আমরা জানি ভূমিকম্পের কারণ টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চালন, সাবডাকশন জোন, কনভার্জেন্ট বা ডাইভার্জেন্ট প্লেটের গতি ইত্যাদি। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা, সিসমিক ওয়েভের গতিবিধি ও ‘ফল্ট লাইন’—এগুলোই এখনকার বৈজ্ঞানিক পরিভাষা।
কিন্তু এই লোককথাগুনো নিছক কল্পনাপ্রসূত গল্প নয়। এগুলো প্রকৃতির শক্তিকে ভয় পাওয়ার ও সেই ভয়কে মনের মতো করে ব্যাখ্যা করার মানবিক প্রচেষ্টা। এই মজাদার ও অদ্ভুত আখ্যানগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির সামনে মানুষ সব সময়ই ছিল কৌতূহলী। তারা না জেনেই এক গভীর দার্শনিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর এই রহস্যময় দোলুনির কারণ খুঁজে বের করতে চেয়েছিল।
তাই সামনে যখন আবার ভূমিকম্পে পৃথিবী কাঁপবে, তখন হয়ত বিজ্ঞানীরা প্লেট টেকটোনিক্সের কথা বলবেন। কিন্তু আপনি মনে মনে একবার কচ্ছপটার পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখবেন—বেচারা আরাম করে বসে আছে তো?