মাছুম বিল্লাহ
মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তরের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী শ্রেণি হচেছ উচচ-মাধ্যমিক। সেই পরীক্ষার ফল বের হলো আজ ১৬ অক্টোবর। এবার পাসের হার ৫৮দশমিক ৮৩শতাংশ। গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। সম্ভবত শিক্ষা উপদেষ্টার পদক্ষেপে ফল কিছুটা হয়েছে। তবে পুন:নিরীক্ষনে আবার অনেকেই পাস করে যান যা পাসের হারের উপর প্রভাব ফেলে।
এবার ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১জন শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। গতবার পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবার পাস কমেছে ১৮ দশমিক ৪৪শতাংশ এবং জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬হাজার ৮১৪। এবার জিপিএ-৫ ৬৯ হাজার ৯৭জন। গতবার ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১জন। এখানে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় ঘটে যেজন্য পরীক্ষক অর্থাৎ শিক্ষকরাই দায়ী। তারা অসাবধানতাবসত উত্তরপত্রের উপর নম্বর বসানোর সময় ভুল করেন যা নিরীক্ষনে বের হয়। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে।
৩৪৫ প্রতিষ্ঠান থেকে সবাই পাস করেছেন। ২০২টি থেকে কেউই পাস করেননি। এও পুরনো খেলা। ঢাকা মহানগরীতে ফেলের হার ১৬শতাংশ, এটি একটি সূচক। এখানকার প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক সব অংশই সচেতন এবং সমাজের অগ্রগামী। ঢাকাবোর্ডে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২শতাংশ আর কুমিল্লায় ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এবার বেশি ফেল করেছে হিসাব বিজ্ঞান, আইসিটি,উচচতর গণিত ও ইংরেজিতে।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ২৬জুন। শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৩ আগস্ট। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করে আবার সূচি প্রকাশ করে পরীক্ষা নেওয়ায় তা শেষ হয় ১৯ আগষ্ট। ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১২ লাখ ৫১হাজার ১১১জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫জন ছেলে ও ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬জন মেয়ে। সারা দেশে ২ হাজার ৭৯৭টি কেন্দ্রে পরীক্ষায় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৩১ হাজার শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। বিগত এক দুই বছরের একটি ভয়ানক চিত্র এটি। বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে দেখা যাচেছ।
সোয়া ১২ লাখ শিক্ষার্থী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন চূড়ান্ত ফলের। এই ফল বলে দেবে তাঁরা উচচশিক্ষার কোন ডিসিপ্লিনে ভর্তির চেষ্টা করবেন, কারা কর্মসংস্থান খুঁজবেন ইত্যাদি।
আমাদের পাবলিক পরীক্ষার ফল বহু বছর যাবতই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক কোন বার্তা বহন করে না। বহু কারণের মধ্যে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সময়ের অপচয়, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতি, ধরাবাঁধা ও পরীক্ষায় পাস করানোর উদ্দেশ্যেই তৈরি একই নিয়মের প্রশ্নপত্র যা শিক্ষার্থীদের প্রকতৃজ্ঞান যাচাইয়ের জন্য সহায়ক নয়, উদারভাবে উত্তরপত্র মুল্যায়ন ও পাসের জন্য আবার খয়রাতির নম্বর প্রদান। এ যেন কোনরকমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সিঁড়ি পার করিয়ে দেয়া! বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা খয়রাতির নম্বর প্রদান না করার জন্য শিক্ষাবোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা এত বছরের অভ্যাসে কতটা পরিবর্তন আনতে পারবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
গত সপ্তাহে ঢাকার বাইরের একটি সরকারি কলেজের এক শিক্ষকের সাথে কথা হলো। তাদের কলেজ উচচ মাধ্যমিকে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী। প্রশ্ন করলাম, আপনার দুই-তিন জন ইংরেজি বা বাংলা শিক্ষক এত শিক্ষার্থীদের কিভাবে ম্যানেজ করেন। তিনি উত্তর দিলেন শিক্ষার্থীরা তো ক্লাসে আসে না। মাত্র ছয় থেকে বারজন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকে। তাও আজ যাদের দেখা যায় আগামীকাল আবার নুতন মুখ। আমি বললাম এ নিয়ে তো আপনারা কোন কথা বলেন না? উত্তরে বললেন ‘আমাদের কথা বলে লাভ কি?’ ক্লাসে না এসেও যখন ফেল করছেনা তখন ক্লাসে কেন আসবে?
আমাদের দেশে উচচ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা একটি অদ্ভূত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়! এর ব্যাপ্তি মাত্র দুই বছর অথচ তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের নতুন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয়। এই ভর্তি প্রক্রিয়া এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু সময় অপচয় হয়। অথচ মাধ্যমিকের চেয়ে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাপ্তি এবং সিলেবাস বেশ কয়েকগুণ বেশি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের প্রথম বর্ষ পরীক্ষার সময় এসে যায় তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের লেজেগোবর অবস্থা হয়ে যায়। কারণ তারা পড়ার টেবিলে ঠিকমতো বসতেই পারেননি। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে তখনও তেমন গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যা আনন্দদায়ক শিক্ষার জন্য অপরিহার্য। সিলেবাস পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি অথচ পরীক্ষা এসে গেছে। শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অর্থাৎ যারা প্রথম থেকেই সিরিয়াস তারা ছাড়া বাকিদের অথৈ জলে পড়তে হয়। তখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর বা বন্ধের বিভিন্ন ছল-ছাতুরী খোঁজেন এবং বলপ্রয়োগ অর্থাৎ আন্দোলনে নেমে যান। তাদের ধারণা, বাকী যে একবছর আছে ঐ সময়ের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের সব সিলেবাস শেষ করে ফেলবেন। সেটি আসলে হয় আরও বিপদ ডেকে আনার মতো অবস্থা।
বরিশাল সরকারি বি এম কলেজে উচচ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েছি আমি। পরীক্ষার সময় মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা কলেজের বিভিন্ন ভবনে তালা দিয়ে হাতে হকি স্টিক, পিস্তল নিয়ে মহড়া দিচিছলো। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আমরা পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে হলের দিকে যাওয়ামাত্র আমাদের ক’জন সহপাঠীর উপর আন্দোলনকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা অনেকে এখন দেশের নামকরা ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, সেনাবাহিনীতে জেনারেল পর্যায়ে চাকরিরত। কলেজের অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র শিক্ষকগন উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কাছে এস বহু অনুরোধ করে বলেছিলেন, তোমাদের প্রশ্নপত্র বহু কষ্ট করে ঢাকার বিজি প্রেস থেকে আনতে হয়, তোমাদের একটি ভবিষ্যত আছে, আমাদেরকেও ডিপিইতে জবাবদিহি করতে হয়, তোমরা যা পার পরীক্ষায় বসো। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই পরীক্ষায় বসবেন না। বহু অনুরোধের পর পরিবর্তিত ও পেছানো একটি তারিখে কোন রকম পরীক্ষা গ্রহন করা হয়েছিল।
এখানে আর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মতো কলেজে উচচ মাধ্যমিক পড়ার সুবিধা আছে। সেখানে বিশাল ক্যাম্পাস, হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, চলাফেরা, উঠাবসা যা এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। সেখানে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক! কিন্তু সমস্যা হচেছ খাপ খাওয়াতে সময় লেগে যায়। দ্বিতীয়ত, জৈষ্ঠ শিক্ষকরা ডিগ্রী ও অনার্সের শিক্ষার্থীদের বেশি গুরুত্ব দেন। যদিও উচচ মাধ্যমিকেই এই সব কলেজে তুখোড় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। ডিগ্রি বা অনার্স পর্যায়ে ভাল শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। অথচ সব বিষয়ের শিক্ষকরা তাদের অনার্স শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। যেসব বিষয়ে অনার্স নেই সেসব বিভাগের শিক্ষকরা উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেন সাধারণত।
এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষা বিভাগকে একটি ব্যাপার বিবেচনা করতে পারে। প্রতিষ্ঠান একটু বড় হলে দশম শ্রেণির সাথে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি খুলে ফেলার চিন্তা করা উচিত। এখন মাধ্যমিকে অনেক মাস্টার্স পাস শিক্ষকরা যোগ দিয়েছেন। তারা সেখানে পড়াতে পারবেন। তাতে শিক্ষার্থীদের এসএসসি-র পর অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আলাদা দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবেনা, সময় নষ্ট হবেনা, খাপখাওয়ানোর সমস্যা কমে যাবে। আর ওপরে যে সমস্যাগুলোর কথা বললাম সেগুলোও তরুণ শিক্ষার্থীদের জীবনে ঘটবে না।
এবার এইচ এস সি পরীক্ষায় পাসের হাসের নিম্নগামিতার বিষয়ে আন্ত:শিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচচমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই বিমুখ। তারা অনেকটাই পড়ার টেবিলে থেকে দূরে ছিলো বলে আমাদের ধারণা। এই ফল নিয়ে আমাদের চর্চা করতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের সাথে বসতে হবে, বোর্ডগুলোকে বসতে হবে। শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মোটিভেট করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্দীপনা একটি কার্যকরী বিষয়। তবে এর প্রচলন আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন একটা নেই। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান তাই যথার্থই বলেছেন যে, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে একেবারেই পাস করেনি তাদের মোটিভেশন দেয়া হবে।
যথাযথ মুল্যায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বার্ষিক পরীক্ষা, টেস্ট পরীক্ষা এবং বোর্ড পরীক্ষায় কড়াকড়িভাবে দেখতে হবে। প্রতিটি স্তরে মুল্যায়ণ সঠিক হতে হবে। বর্তমান মূল্যায়নে অভিভাবকরা বুঝতে পরেন না তাদের সন্তানদের অবস্থা, শিক্ষার্থীরা নিজেরাও বুঝতে পারেনা তারা কোন অবস্থায় আছেন। এর কারণ হচেছ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বস্তরেই চলে সহানভূতি আর খয়রাতির পাস। ফলে শিক্ষার্থীও বোঝে না কেন তাকে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত আসতে হবে। শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার হার ভয়ানকভাবে কমে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক এবং রাষ্ট্রকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করতে হবে। মূল্যায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পেলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও বাড়বে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকতে হবে। এখানে প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদেরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব), সাবেক অধ্যাপক ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ- ব্র্যাক শিক্ষা, কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ।
মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তরের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী শ্রেণি হচেছ উচচ-মাধ্যমিক। সেই পরীক্ষার ফল বের হলো আজ ১৬ অক্টোবর। এবার পাসের হার ৫৮দশমিক ৮৩শতাংশ। গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। সম্ভবত শিক্ষা উপদেষ্টার পদক্ষেপে ফল কিছুটা হয়েছে। তবে পুন:নিরীক্ষনে আবার অনেকেই পাস করে যান যা পাসের হারের উপর প্রভাব ফেলে।
এবার ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১জন শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। গতবার পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবার পাস কমেছে ১৮ দশমিক ৪৪শতাংশ এবং জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬হাজার ৮১৪। এবার জিপিএ-৫ ৬৯ হাজার ৯৭জন। গতবার ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১জন। এখানে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় ঘটে যেজন্য পরীক্ষক অর্থাৎ শিক্ষকরাই দায়ী। তারা অসাবধানতাবসত উত্তরপত্রের উপর নম্বর বসানোর সময় ভুল করেন যা নিরীক্ষনে বের হয়। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে।
৩৪৫ প্রতিষ্ঠান থেকে সবাই পাস করেছেন। ২০২টি থেকে কেউই পাস করেননি। এও পুরনো খেলা। ঢাকা মহানগরীতে ফেলের হার ১৬শতাংশ, এটি একটি সূচক। এখানকার প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক সব অংশই সচেতন এবং সমাজের অগ্রগামী। ঢাকাবোর্ডে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২শতাংশ আর কুমিল্লায় ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এবার বেশি ফেল করেছে হিসাব বিজ্ঞান, আইসিটি,উচচতর গণিত ও ইংরেজিতে।
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ২৬জুন। শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৩ আগস্ট। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করে আবার সূচি প্রকাশ করে পরীক্ষা নেওয়ায় তা শেষ হয় ১৯ আগষ্ট। ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১২ লাখ ৫১হাজার ১১১জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫জন ছেলে ও ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬জন মেয়ে। সারা দেশে ২ হাজার ৭৯৭টি কেন্দ্রে পরীক্ষায় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৩১ হাজার শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। বিগত এক দুই বছরের একটি ভয়ানক চিত্র এটি। বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে দেখা যাচেছ।
সোয়া ১২ লাখ শিক্ষার্থী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন চূড়ান্ত ফলের। এই ফল বলে দেবে তাঁরা উচচশিক্ষার কোন ডিসিপ্লিনে ভর্তির চেষ্টা করবেন, কারা কর্মসংস্থান খুঁজবেন ইত্যাদি।
আমাদের পাবলিক পরীক্ষার ফল বহু বছর যাবতই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক কোন বার্তা বহন করে না। বহু কারণের মধ্যে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সময়ের অপচয়, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতি, ধরাবাঁধা ও পরীক্ষায় পাস করানোর উদ্দেশ্যেই তৈরি একই নিয়মের প্রশ্নপত্র যা শিক্ষার্থীদের প্রকতৃজ্ঞান যাচাইয়ের জন্য সহায়ক নয়, উদারভাবে উত্তরপত্র মুল্যায়ন ও পাসের জন্য আবার খয়রাতির নম্বর প্রদান। এ যেন কোনরকমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সিঁড়ি পার করিয়ে দেয়া! বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা খয়রাতির নম্বর প্রদান না করার জন্য শিক্ষাবোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা এত বছরের অভ্যাসে কতটা পরিবর্তন আনতে পারবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।
গত সপ্তাহে ঢাকার বাইরের একটি সরকারি কলেজের এক শিক্ষকের সাথে কথা হলো। তাদের কলেজ উচচ মাধ্যমিকে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী। প্রশ্ন করলাম, আপনার দুই-তিন জন ইংরেজি বা বাংলা শিক্ষক এত শিক্ষার্থীদের কিভাবে ম্যানেজ করেন। তিনি উত্তর দিলেন শিক্ষার্থীরা তো ক্লাসে আসে না। মাত্র ছয় থেকে বারজন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকে। তাও আজ যাদের দেখা যায় আগামীকাল আবার নুতন মুখ। আমি বললাম এ নিয়ে তো আপনারা কোন কথা বলেন না? উত্তরে বললেন ‘আমাদের কথা বলে লাভ কি?’ ক্লাসে না এসেও যখন ফেল করছেনা তখন ক্লাসে কেন আসবে?
আমাদের দেশে উচচ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা একটি অদ্ভূত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়! এর ব্যাপ্তি মাত্র দুই বছর অথচ তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের নতুন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয়। এই ভর্তি প্রক্রিয়া এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু সময় অপচয় হয়। অথচ মাধ্যমিকের চেয়ে প্রতিটি বিষয়ের ব্যাপ্তি এবং সিলেবাস বেশ কয়েকগুণ বেশি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের প্রথম বর্ষ পরীক্ষার সময় এসে যায় তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের লেজেগোবর অবস্থা হয়ে যায়। কারণ তারা পড়ার টেবিলে ঠিকমতো বসতেই পারেননি। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সাথে তখনও তেমন গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যা আনন্দদায়ক শিক্ষার জন্য অপরিহার্য। সিলেবাস পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি অথচ পরীক্ষা এসে গেছে। শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অর্থাৎ যারা প্রথম থেকেই সিরিয়াস তারা ছাড়া বাকিদের অথৈ জলে পড়তে হয়। তখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর বা বন্ধের বিভিন্ন ছল-ছাতুরী খোঁজেন এবং বলপ্রয়োগ অর্থাৎ আন্দোলনে নেমে যান। তাদের ধারণা, বাকী যে একবছর আছে ঐ সময়ের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের সব সিলেবাস শেষ করে ফেলবেন। সেটি আসলে হয় আরও বিপদ ডেকে আনার মতো অবস্থা।
বরিশাল সরকারি বি এম কলেজে উচচ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েছি আমি। পরীক্ষার সময় মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা কলেজের বিভিন্ন ভবনে তালা দিয়ে হাতে হকি স্টিক, পিস্তল নিয়ে মহড়া দিচিছলো। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আমরা পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে হলের দিকে যাওয়ামাত্র আমাদের ক’জন সহপাঠীর উপর আন্দোলনকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা অনেকে এখন দেশের নামকরা ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, সেনাবাহিনীতে জেনারেল পর্যায়ে চাকরিরত। কলেজের অধ্যক্ষ এবং সিনিয়র শিক্ষকগন উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কাছে এস বহু অনুরোধ করে বলেছিলেন, তোমাদের প্রশ্নপত্র বহু কষ্ট করে ঢাকার বিজি প্রেস থেকে আনতে হয়, তোমাদের একটি ভবিষ্যত আছে, আমাদেরকেও ডিপিইতে জবাবদিহি করতে হয়, তোমরা যা পার পরীক্ষায় বসো। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই পরীক্ষায় বসবেন না। বহু অনুরোধের পর পরিবর্তিত ও পেছানো একটি তারিখে কোন রকম পরীক্ষা গ্রহন করা হয়েছিল।
এখানে আর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মতো কলেজে উচচ মাধ্যমিক পড়ার সুবিধা আছে। সেখানে বিশাল ক্যাম্পাস, হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, চলাফেরা, উঠাবসা যা এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। সেখানে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক! কিন্তু সমস্যা হচেছ খাপ খাওয়াতে সময় লেগে যায়। দ্বিতীয়ত, জৈষ্ঠ শিক্ষকরা ডিগ্রী ও অনার্সের শিক্ষার্থীদের বেশি গুরুত্ব দেন। যদিও উচচ মাধ্যমিকেই এই সব কলেজে তুখোড় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। ডিগ্রি বা অনার্স পর্যায়ে ভাল শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। অথচ সব বিষয়ের শিক্ষকরা তাদের অনার্স শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন। যেসব বিষয়ে অনার্স নেই সেসব বিভাগের শিক্ষকরা উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেন সাধারণত।
এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষা বিভাগকে একটি ব্যাপার বিবেচনা করতে পারে। প্রতিষ্ঠান একটু বড় হলে দশম শ্রেণির সাথে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি খুলে ফেলার চিন্তা করা উচিত। এখন মাধ্যমিকে অনেক মাস্টার্স পাস শিক্ষকরা যোগ দিয়েছেন। তারা সেখানে পড়াতে পারবেন। তাতে শিক্ষার্থীদের এসএসসি-র পর অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আলাদা দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবেনা, সময় নষ্ট হবেনা, খাপখাওয়ানোর সমস্যা কমে যাবে। আর ওপরে যে সমস্যাগুলোর কথা বললাম সেগুলোও তরুণ শিক্ষার্থীদের জীবনে ঘটবে না।
এবার এইচ এস সি পরীক্ষায় পাসের হাসের নিম্নগামিতার বিষয়ে আন্ত:শিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচচমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই বিমুখ। তারা অনেকটাই পড়ার টেবিলে থেকে দূরে ছিলো বলে আমাদের ধারণা। এই ফল নিয়ে আমাদের চর্চা করতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের সাথে বসতে হবে, বোর্ডগুলোকে বসতে হবে। শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মোটিভেট করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্দীপনা একটি কার্যকরী বিষয়। তবে এর প্রচলন আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন একটা নেই। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান তাই যথার্থই বলেছেন যে, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে একেবারেই পাস করেনি তাদের মোটিভেশন দেয়া হবে।
যথাযথ মুল্যায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বার্ষিক পরীক্ষা, টেস্ট পরীক্ষা এবং বোর্ড পরীক্ষায় কড়াকড়িভাবে দেখতে হবে। প্রতিটি স্তরে মুল্যায়ণ সঠিক হতে হবে। বর্তমান মূল্যায়নে অভিভাবকরা বুঝতে পরেন না তাদের সন্তানদের অবস্থা, শিক্ষার্থীরা নিজেরাও বুঝতে পারেনা তারা কোন অবস্থায় আছেন। এর কারণ হচেছ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বস্তরেই চলে সহানভূতি আর খয়রাতির পাস। ফলে শিক্ষার্থীও বোঝে না কেন তাকে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত আসতে হবে। শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকার হার ভয়ানকভাবে কমে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক এবং রাষ্ট্রকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করতে হবে। মূল্যায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পেলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও বাড়বে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকতে হবে। এখানে প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদেরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ইট্যাব), সাবেক অধ্যাপক ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ- ব্র্যাক শিক্ষা, কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ।
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, মাত্র ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় এই হার অনেক কম। ফলে অনেকেই বলছেন, পাসের হারে যেন ধস নেমেছে।
৩ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি গাজার ভবিষ্যৎকে আমূল পুনর্গঠনের প্রস্তাব। ট্রাম্প তাঁর প্রস্তাবকে অভিহিত করেছেন ‘একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি’ হিসেবে। তাঁর ভাষায়, ‘এই অগ্রগতি তিন হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে পারে।’
৬ ঘণ্টা আগেক্যাপশন পড়ে চোখ উলটে ফেলার কোনো কারণ নেই। আমার বয়সে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায় না বা দেইনি—এটা সবাই জানেন। কিন্তু আজকে যে ফল প্রকাশ হয়েছে, তাতে যারা ফেল করেছে, সে তালিকায় আমার এবং আপনাদের নামও আছে।
৮ ঘণ্টা আগেসামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তারে বিশ্ব আজ তথ্যের এক অভূতপূর্ব যুগে প্রবেশ করেছে। এই মাধ্যম একদিকে যেমন জ্ঞান, শিক্ষা ও যোগাযোগের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে নৈতিক অবক্ষয়ের এক বড় উৎস। বিশেষ করে অশ্লীল কনটেন্টের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের যে প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তা সমাজব্যবস্থা ও মানব
১১ ঘণ্টা আগে