ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তারে বিশ্ব আজ তথ্যের এক অভূতপূর্ব যুগে প্রবেশ করেছে। এই মাধ্যম একদিকে যেমন জ্ঞান, শিক্ষা ও যোগাযোগের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে নৈতিক অবক্ষয়ের এক বড় উৎস। বিশেষ করে অশ্লীল কনটেন্টের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের যে প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তা সমাজব্যবস্থা ও মানবসভ্যতার জন্য ভয়াবহ সংকেত বহন করছে।
আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, কনটেন্ট যত অশ্লীল, যত বেহায়াপনা ও প্ররোচনামূলক, সেটিই তত দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে, তত বেশি ভিউ ও অনুসারী পাচ্ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ফলে, মানুষ এখন অর্থের মোহে ও জনপ্রিয়তার লোভে এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছে যা সমাজের শালীনতা ও পারিবারিক বন্ধনের মূলভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই বিকৃত অর্থনীতি মানুষের বিবেক, লজ্জাবোধ, আত্মসংযম ও নৈতিকতার শিকড়কে ক্রমশ ধ্বংস করছে। অশ্লীলতা এখন শুধু বিনোদনের নামে উপস্থাপিত হচ্ছে না, হয়ে উঠেছে এক প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত ‘শিল্পখাত’-এর রূপ। কেউ এটি ব্যবহার করছে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে, কেউ বা জনপ্রিয়তা অর্জনের সিঁড়ি হিসেবে। কিন্তু এর মূল্য দিতে হচ্ছে পুরো সমাজকে, বিশেষ করে সেই শিশু-কিশোর প্রজন্মকে, যারা এখনো পরিপূর্ণ মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পথে। তারা এই কনটেন্ট দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছে, বিকৃত যৌন মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, এবং লজ্জা ও নৈতিকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।
যুবসমাজও এর বড় শিকার। তারা ভাবছে অশালীনতাই আধুনিকতা, উন্মুক্ততাই স্বাধীনতা। কিন্তু এই মিথ্যা ধারণা তাদের নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর আত্মবিনাশের পথে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে, বিবাহ ও ভালোবাসার পবিত্র ধারণা বিকৃত হচ্ছে, বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমাজে বাড়ছে অপরাধ, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল ও মানসিক অস্থিরতা।
অশ্লীলতার এই দুনিয়াব্যাপী আগুন এক অদৃশ্য মহামারীর মতো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যার প্রভাব ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের শান্তি ও সম্পর্কের উষ্ণতা নষ্ট হচ্ছে, শিশুদের শৈশব কলুষিত হচ্ছে এবং সমাজের ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন এক যৌথ সামাজিক জাগরণ। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ভেতরে নৈতিক সংযম গড়ে তোলা, নিজের আচরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দায়িত্বশীল হওয়া। পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার, কী দেখা যায়, কেন দেখা হয় এবং তার প্রভাব কী হতে পারে, তা বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি। সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও নৈতিকতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সৃজনশীল ও শিক্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি, অনুপযুক্ত বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং ইতিবাচক অনলাইন সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হতে পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ।
তবে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই রাষ্ট্রের উচিত কার্যকর নীতিমালা তৈরি করা, যাতে অশ্লীল কনটেন্টের বিস্তার ও আর্থিক সুবিধা বন্ধ করা যায়। বিশ্বের বহু দেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল, পর্নোগ্রাফিক বা অনৈতিক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন ও নীতি গ্রহণ করেছে। যেমন—জার্মানির নেটওয়ার্ক এনফোর্সমেন্ট আইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবৈধ বা আপত্তিকর কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে বাধ্য করে। ইন্দোনেশিয়ার পর্নোগ্রাফি আইন অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীলতা এবং শিশু-সংশ্লিষ্ট যৌন কনটেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয় দেশেই অশ্লীল উপাদান প্রচার আইনত নিষিদ্ধ এবং নিয়মিত নজরদারির আওতায় থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল সার্ভিসেস আইন অনুযায়ী, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অবৈধ ও ক্ষতিকর কনটেন্ট দ্রুত অপসারণ ও রিপোর্ট প্রদানে বাধ্য। সিঙ্গাপুর সম্প্রতি অনলাইন ক্রিমিনাল হার্মস আইন এবং একটি অনলাইন নিরাপত্তা কমিশন গঠন করেছে, যা ক্ষতিকর অনলাইন কনটেন্ট সীমাবদ্ধ করতে সরাসরি ক্ষমতা রাখে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানে ইলেকট্রনিক অপরাধ প্রতিরোধ আইন, ২০১৬ অনুযায়ী, অনলাইন ‘অশালীন বা অনৈতিক’ কনটেন্ট প্রচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মালয়েশিয়ার কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া আইন, ১৯৯৮ ও মালয়েশিয়ান কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া কমিশন -এর নির্দেশনা অনুসারে অশালীন কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মালদ্বীপে পর্নোগ্রাফি-সম্পর্কিত কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ ও বিতরণ আইনত নিষিদ্ধ এবং সরকার নিয়মিতভাবে আপত্তিকর ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট ব্লক করে থাকে।
সব মিলিয়ে, এসব দেশের আইন ও নীতিমালা কেবল প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা, অনলাইন নৈতিকতা এবং কনটেন্ট-নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার একটি কার্যকর কাঠামো তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ রহিত করে ২০২৫ সালে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট প্রতিরোধে কোনো নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধারা এতে সংযুক্ত হয়নি। অধ্যাদেশটির তৃতীয় অধ্যায়ের ধারা ৮(২) অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি মনে করে যে কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বা জনশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে, কিংবা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে—তাহলে তারা উক্ত তথ্য অপসারণ বা ব্লক করার নির্দেশ দিতে পারে। তবে এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার ওপর কেন্দ্রিত, অশ্লীল বা পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট প্রতিরোধের ওপর নয়।
অন্যদিকে, ষষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা ২৫(১)-এ যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্ন, শিশু যৌন নিপীড়ন বা সেক্সটর্শনের উদ্দেশ্যে অডিও-ভিডিও, ছবি, বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ, প্রকাশ বা প্রচারের বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট প্রচার বা বিস্তার রোধ’ সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট ধারা বা বিধান নেই।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ অনলাইন যৌন অপরাধ ও শিশু যৌন নিপীড়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল বা অনৈতিক কনটেন্ট প্রতিরোধে সরাসরি কোনো ধারা নেই। ফলে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেমন সুনির্দিষ্ট ‘অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ রয়েছে, বাংলাদেশে এখনো তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট করা হয়নি।
তাই, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল বা অনৈতিক কনটেন্ট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট ধারা সংযোজন করতে হবে অথবা এ বিষয়ে নুতন আইন তৈরি করতে হবে এবং সেটির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ডিজিটাল সচেতনতা সংযোজন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণের উপকরণ হিসেবে নয়, বরং উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে।
মানবতার এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবিকতার মূল্যবোধে। যেখানে সম্মান, সংযম, লজ্জা, ও ভালোবাসা একসঙ্গে বেঁচে থাকে। যতদিন মানুষ নিজের অন্তরে নৈতিক আলো জ্বালিয়ে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত এই অশুভ অন্ধকার সমাজকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারবে না।
এই অশুভ প্রবণতা রোধে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এখনই সচেষ্ট হতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে, রাষ্ট্রকেও নৈতিকতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সেইসঙ্গে সমাজকেও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এটা না হলে সময় খুব বেশি দূরে নয়, সেদিন মানুষ হয়তো জীবিতদের নয়, বরং মৃতদেরই সৌভাগ্যবান মনে করবে। কারণ তাদের অন্তত এই ভয়ংকর নৈতিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তারে বিশ্ব আজ তথ্যের এক অভূতপূর্ব যুগে প্রবেশ করেছে। এই মাধ্যম একদিকে যেমন জ্ঞান, শিক্ষা ও যোগাযোগের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে নৈতিক অবক্ষয়ের এক বড় উৎস। বিশেষ করে অশ্লীল কনটেন্টের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের যে প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তা সমাজব্যবস্থা ও মানবসভ্যতার জন্য ভয়াবহ সংকেত বহন করছে।
আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, কনটেন্ট যত অশ্লীল, যত বেহায়াপনা ও প্ররোচনামূলক, সেটিই তত দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে, তত বেশি ভিউ ও অনুসারী পাচ্ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ফলে, মানুষ এখন অর্থের মোহে ও জনপ্রিয়তার লোভে এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছে যা সমাজের শালীনতা ও পারিবারিক বন্ধনের মূলভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই বিকৃত অর্থনীতি মানুষের বিবেক, লজ্জাবোধ, আত্মসংযম ও নৈতিকতার শিকড়কে ক্রমশ ধ্বংস করছে। অশ্লীলতা এখন শুধু বিনোদনের নামে উপস্থাপিত হচ্ছে না, হয়ে উঠেছে এক প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত ‘শিল্পখাত’-এর রূপ। কেউ এটি ব্যবহার করছে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে, কেউ বা জনপ্রিয়তা অর্জনের সিঁড়ি হিসেবে। কিন্তু এর মূল্য দিতে হচ্ছে পুরো সমাজকে, বিশেষ করে সেই শিশু-কিশোর প্রজন্মকে, যারা এখনো পরিপূর্ণ মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পথে। তারা এই কনটেন্ট দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছে, বিকৃত যৌন মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, এবং লজ্জা ও নৈতিকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।
যুবসমাজও এর বড় শিকার। তারা ভাবছে অশালীনতাই আধুনিকতা, উন্মুক্ততাই স্বাধীনতা। কিন্তু এই মিথ্যা ধারণা তাদের নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর আত্মবিনাশের পথে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে, বিবাহ ও ভালোবাসার পবিত্র ধারণা বিকৃত হচ্ছে, বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমাজে বাড়ছে অপরাধ, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল ও মানসিক অস্থিরতা।
অশ্লীলতার এই দুনিয়াব্যাপী আগুন এক অদৃশ্য মহামারীর মতো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যার প্রভাব ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের শান্তি ও সম্পর্কের উষ্ণতা নষ্ট হচ্ছে, শিশুদের শৈশব কলুষিত হচ্ছে এবং সমাজের ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন এক যৌথ সামাজিক জাগরণ। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ভেতরে নৈতিক সংযম গড়ে তোলা, নিজের আচরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দায়িত্বশীল হওয়া। পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার, কী দেখা যায়, কেন দেখা হয় এবং তার প্রভাব কী হতে পারে, তা বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি। সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও নৈতিকতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সৃজনশীল ও শিক্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি, অনুপযুক্ত বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে সচেতনতা এবং ইতিবাচক অনলাইন সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হতে পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ।
তবে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই রাষ্ট্রের উচিত কার্যকর নীতিমালা তৈরি করা, যাতে অশ্লীল কনটেন্টের বিস্তার ও আর্থিক সুবিধা বন্ধ করা যায়। বিশ্বের বহু দেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল, পর্নোগ্রাফিক বা অনৈতিক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন ও নীতি গ্রহণ করেছে। যেমন—জার্মানির নেটওয়ার্ক এনফোর্সমেন্ট আইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবৈধ বা আপত্তিকর কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে বাধ্য করে। ইন্দোনেশিয়ার পর্নোগ্রাফি আইন অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীলতা এবং শিশু-সংশ্লিষ্ট যৌন কনটেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয় দেশেই অশ্লীল উপাদান প্রচার আইনত নিষিদ্ধ এবং নিয়মিত নজরদারির আওতায় থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল সার্ভিসেস আইন অনুযায়ী, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো অবৈধ ও ক্ষতিকর কনটেন্ট দ্রুত অপসারণ ও রিপোর্ট প্রদানে বাধ্য। সিঙ্গাপুর সম্প্রতি অনলাইন ক্রিমিনাল হার্মস আইন এবং একটি অনলাইন নিরাপত্তা কমিশন গঠন করেছে, যা ক্ষতিকর অনলাইন কনটেন্ট সীমাবদ্ধ করতে সরাসরি ক্ষমতা রাখে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানে ইলেকট্রনিক অপরাধ প্রতিরোধ আইন, ২০১৬ অনুযায়ী, অনলাইন ‘অশালীন বা অনৈতিক’ কনটেন্ট প্রচার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মালয়েশিয়ার কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া আইন, ১৯৯৮ ও মালয়েশিয়ান কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া কমিশন -এর নির্দেশনা অনুসারে অশালীন কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মালদ্বীপে পর্নোগ্রাফি-সম্পর্কিত কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ ও বিতরণ আইনত নিষিদ্ধ এবং সরকার নিয়মিতভাবে আপত্তিকর ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট ব্লক করে থাকে।
সব মিলিয়ে, এসব দেশের আইন ও নীতিমালা কেবল প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা, অনলাইন নৈতিকতা এবং কনটেন্ট-নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার একটি কার্যকর কাঠামো তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ রহিত করে ২০২৫ সালে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট প্রতিরোধে কোনো নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধারা এতে সংযুক্ত হয়নি। অধ্যাদেশটির তৃতীয় অধ্যায়ের ধারা ৮(২) অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি মনে করে যে কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বা জনশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে, কিংবা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে—তাহলে তারা উক্ত তথ্য অপসারণ বা ব্লক করার নির্দেশ দিতে পারে। তবে এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার ওপর কেন্দ্রিত, অশ্লীল বা পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট প্রতিরোধের ওপর নয়।
অন্যদিকে, ষষ্ঠ অধ্যায়ের ধারা ২৫(১)-এ যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্ন, শিশু যৌন নিপীড়ন বা সেক্সটর্শনের উদ্দেশ্যে অডিও-ভিডিও, ছবি, বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ, প্রকাশ বা প্রচারের বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট প্রচার বা বিস্তার রোধ’ সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট ধারা বা বিধান নেই।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ অনলাইন যৌন অপরাধ ও শিশু যৌন নিপীড়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল বা অনৈতিক কনটেন্ট প্রতিরোধে সরাসরি কোনো ধারা নেই। ফলে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেমন সুনির্দিষ্ট ‘অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ রয়েছে, বাংলাদেশে এখনো তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট করা হয়নি।
তাই, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল বা অনৈতিক কনটেন্ট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট ধারা সংযোজন করতে হবে অথবা এ বিষয়ে নুতন আইন তৈরি করতে হবে এবং সেটির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ডিজিটাল সচেতনতা সংযোজন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণের উপকরণ হিসেবে নয়, বরং উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে।
মানবতার এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানবিকতার মূল্যবোধে। যেখানে সম্মান, সংযম, লজ্জা, ও ভালোবাসা একসঙ্গে বেঁচে থাকে। যতদিন মানুষ নিজের অন্তরে নৈতিক আলো জ্বালিয়ে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত এই অশুভ অন্ধকার সমাজকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারবে না।
এই অশুভ প্রবণতা রোধে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এখনই সচেষ্ট হতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে, রাষ্ট্রকেও নৈতিকতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সেইসঙ্গে সমাজকেও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এটা না হলে সময় খুব বেশি দূরে নয়, সেদিন মানুষ হয়তো জীবিতদের নয়, বরং মৃতদেরই সৌভাগ্যবান মনে করবে। কারণ তাদের অন্তত এই ভয়ংকর নৈতিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, মাত্র ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় এই হার অনেক কম। ফলে অনেকেই বলছেন, পাসের হারে যেন ধস নেমেছে।
৩ ঘণ্টা আগেট্রাম্পের প্রস্তাবগুলো যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি গাজার ভবিষ্যৎকে আমূল পুনর্গঠনের প্রস্তাব। ট্রাম্প তাঁর প্রস্তাবকে অভিহিত করেছেন ‘একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি’ হিসেবে। তাঁর ভাষায়, ‘এই অগ্রগতি তিন হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে পারে।’
৬ ঘণ্টা আগেক্যাপশন পড়ে চোখ উলটে ফেলার কোনো কারণ নেই। আমার বয়সে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায় না বা দেইনি—এটা সবাই জানেন। কিন্তু আজকে যে ফল প্রকাশ হয়েছে, তাতে যারা ফেল করেছে, সে তালিকায় আমার এবং আপনাদের নামও আছে।
৮ ঘণ্টা আগেমাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তরের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী শ্রেণি হচেছ উচচ-মাধ্যমিক। সেই পরীক্ষার ফল বের হলো আজ ১৬ অক্টোবর। এবার পাসের হার ৫৮দশমিক ৮৩শতাংশ। গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। সম্ভবত শিক্ষা উপদেষ্টার পদক্ষেপে ফল কিছুটা হয়েছে। তবে পুন:নিরীক্ষনে আবার অনেকেই পাস করে যান যা পাসের হারের উ
১০ ঘণ্টা আগে