leadT1ad

রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা ও আমার ভ্রমণ

জনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখক রকিব হাসান প্রয়াত হয়েছেন। । তাঁর ‘তিন গোয়েন্দা’ এক সময় তুমুল জনপ্রিয় ছিল।

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৯: ৫৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডিতেই আছি তখনো। চোখে-মুখে রঙিন স্বপ্ন। স্কুল নামের যন্ত্রণা ছাড়া সবই পাগলের মতো ভালো লাগে। কার্টুন, ফুটবল, গাছের সবুজ, পাখির উড়াল, পদ্মার চর, শহরের বিদঘুটে চিড়িয়াখানা আর নতুন নেশা—বই । মানে গল্পের বই! ঠাকুরমার ঝুলি, সোনার পাখি, ডালিম কুমারের ঘোড়া দিয়ে সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখনো পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়ে সে দেশ-কাল-সীমানা ছাড়িয়ে নিত্য নতুন রাজ্য দেখার নেশায় পাগলপারা। বাড়িতে রাখা হতো দৈনিক ইত্তেফাক, সেখানে তৃতীয় পাতায় ওপরের বাম কোণাতে অল্প কয়েক ইঞ্চিজুড়ে ছাপা হতো অসাধারণ এক কার্টুন—টারজান! পাশে লেখা থাকত এডগার রাইস বারোজ। তখন কি আর জানতাম ইনিই টারজানের স্রষ্টা!

কে যেন একদিন ক্লাসে কানে জীবনের শ্রেষ্ঠ ফুঁসমন্তরটি দিয়ে বসল—‘আরে ব্যাটা, টারজানের দুই-তিনটা ছবির কমিক্স পড়ে কী সব গল্প ঝাড়িস! পড়তে হলে বই পড়, আসল বই।’ আরেব্বাস, টারজানের বই! কোথায় পাব?

সেই ইঁচড়ে পাকা বন্ধুটিই নিয়ে গেল টিফিনের সময় স্কুলের কাছে ও কাজলার মোড়ে এক দোকানে। দোকানটি অন্য আর সব দোকানের চেয়ে আলাদা। সেখান কয়েক তাকে জুড়ে শুধু রাখা বই আর বই। তাও নিউজপ্রিন্টে ছাপা, একটু ছোট আকারের। জানলাম তাদের আবার গালভরা একটা নাম আছে—পেপারব্যাক! সব বইয়ের পেছনের নাকি লাল-হলুদের একটা প্রজাপতি আছে, যার পায়ের কাছে কায়দা করে লেখা সব, নাকি সেবা! ঢাকার এক প্রকাশনা সংস্থা! তারাই টারজানের বইগুলো প্রকাশ করে। আর এই দোকানে সেগুলো দিনে ১ টাকার বিনিময়ে ভাড়া পাওয়া যাবে! ১ টাকায় দিন, মানে পরের দিনই ফেরৎ দিতে হবে! না দিলেও মুশকিল হবে না, কেবল ভাড়ার অঙ্ক বাড়তে থাকবে।

তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই
তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই

নিয়ে এলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে গেলাম সেই রহস্যময় দোকানে থাকা সবগুলো টারজানের বই। তখন থেকেই মনে হয় পড়ার বই দিয়ে ঢেকে গল্পের বই পড়ার সুঅভ্যাসটি গড়ে উঠেছে। কিন্তু বইগুলো নিজের করতে খুব ইচ্ছে করত। মানে, কিনে ফেলতে পারলে খুব ভাল হতো।

এই হিসেব করেই মায়ের সঙ্গে একদিন রাজশাহীর সাহেব বাজারের ‘বুকস প্যাভিলিয়ন’ নামের এই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম বই কেনার আশায়। কিন্তু টারজান নেই তাদের। এগুলো নাকি বহু আগের বই। এখন আর ছাপা হয় না। তার বদলে লোকটা সেবার অন্য বেশ মোটাসোটা একটা বই ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটিও খুব ভালো লাগবে, তোমাদের জন্যই লেখা!’

এত মোটা বই! ওপরে লেখা তিন গোয়েন্দা—ভলিউম ৩। লেখক রকিব হাসান। বইটির প্রচ্ছদে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি ছবির সমন্বয়ে যেন অনেকগুলো গল্পের ইঙ্গিত আছে। মনে পড়ে স্বর্ণকেশী এক কিশোরীর হাসি ঝলমলে চোখ, নীল সাগর সৈকতের নারকেল গাছ, সোনার মোহর, একটা হলদে কুকুর, জংলি, কিছু চিত্রকর্ম—সব মিলিয়ে একটা টান তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু এত মোটা বই! দোকানি আবার হেসে বলল—ছয়টা বই আছে। ছয়টা আলাদা আলাদা ঘটনা। তাই নাকি? মজা তো! একটা কিনলেই ছয়টা বই। উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসে! টানা কয়েকটা নির্ঘুম রাতের আভাস।

আবার নেড়েচেড়ে দেখি আলগোছে। প্রথম কাহিনীর নাম—হারানো তিমি। প্রথম লাইনে ছিল মনে হয়—‘হুই যে, দেখা যাচ্ছে ফোয়ারা!’

কিসের ফোয়ারা? তিমির! ব্যস, দারুণ মনে হলো ব্যাপারটা অন্য প্রাণী জড়িত থাকায়। সেই শুরু হলো আমার তিন গোয়েন্দার অতল হ্রদে অবগাহন। শেষ হলো একে একে হারানো তিমি, মুক্তো শিকারি, মৃত্যু খনি, কাকাতুয়া রহস্য, ছুটি, ভুতের হাসি।

এভাবেই স্কুল জীবনের তিন গোয়েন্দা আজো ঘিরে থাকে দৈনন্দিন জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে। ক্যারিবীয় সাগরতলে ডুবুরির অভিজ্ঞতা অর্জনের সময় সব কিছু ছাপিয়ে মনের পর্দায় কেবল ভাসতে থাকে অথৈ সাগরে মুসা আমানের অভিজ্ঞতার কথা। ব্রাজিলে বন্ধুর বাড়িতে হ্যামক দেখে, এই চিরচেনা বস্তুটির কথাই তো জেনেছিলাম ভীষণ অরণ্যে, যেমন একই বই থেকে জেনেছিলাম হাওলার বানরের ভয়াবহ চিৎকারের কথা।

দারুণ সব কাহিনি। একটা আরেকটার চেয়ে আলাদা। রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের মিশেল। কত অজানা তথ্যের ভাণ্ডার, উপস্থিত বুদ্ধির ঝলক! তখন আমার সেরা বন্ধু হয়ে গেল কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড। মাঝে মাঝে সেই তালিকায় জিনা পার্কার আর রাফিয়ানও ঢুঁকে পড়ে।

হন্যে হয়ে গেলাম তিন গোয়েন্দার বাকি সব বই জোগাড় করার জন্য। কিছু মেলে, কিছু মেলে না। মনের ভেতরে প্রচণ্ড কৌতূহল এই সিরিজের প্রথম বইটি নিয়ে। তার নামই তিন গোয়েন্দা! হ্যারি প্রাইস, মিস্টার ফিসফিস, পরিচালক ডেভিড ক্রিস্টোফার গেঁথে গেল মাথার কোষে কোষে। প্রচ্ছদটাও ছিল মনকাড়া। এক পাশে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ব্যায়ামবীর মুসা আমান, অন্য পাশে সোনালি চুল আধা আইরিশ রবিন মিলফোর্ড। তাদের পিছনেই কিশোর পাশার একজোড়া স্বপ্নময় চোখ। মুখমণ্ডল দেখা না গেলেও বাঙালি বলে কল্পনা করতে তো সমস্যা নেই।

তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই
তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই

পরের বই কঙ্কাল দ্বীপ। তিন গোয়েন্দার কিছু বন্ধু যে তাদের মতোই মনোযোগ ও ভালোবাসা পাওয়ার দাবি রাখে, তার প্রমাণ পেলাম পাপালো হারকুসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। গ্রিক কিশোর মৎস্যজীবী সে। সোনার মোহর খুঁজে বেড়ায় সাগরে ডুব দিয়ে। এথেন্সের বন্দরে যতজন ঝাঁকড়া চুলো স্থানীয় কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সবার সঙ্গেই মেলানোর চেষ্টা করেছিলাম পুরনো বন্ধু পাপালোর আদল।

ঠিক তেমনি ভাবেই প্রথমবার জার্মানির বাভারিয়া ভ্রমণের সময় কান পেতে শুনছিলাম, সেখানকার স্থানীয়রা কি আসলেই বরিস আর রোভারের মতো ‘ওকে’ না বলে ‘হোকে’ বলে কিনা!

পোচার বইয়ে বলা নিচের লাইনগুলো যেন ফিসফিস করে শুনতে পেলাম যখন নগোরোংগরো জ্বালামুখ দেখলাম তাঞ্জানিয়াতে গত মাসে—‘পৃথিবীর বৃহত্তম জ্বালামুখ দেখালেন ছেলেদেরকে ওয়ারডেন। অদ্ভুত নাম মুখটার, নগোরোংগোরো। বহু দিন আগেই মরে গেছে আগ্নেয়গিরিটা। জ্বালামুখে চারপাশের দেয়াল আড়াই হাজার ফুট উঁচু। দেয়ালের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে ঘন সবুজের রাজত্ব, ছড়িয়ে গেছে দেড় শ বর্গমাইল। ঘন বনের মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, কোথাও বা নীল হ্রদ। জন্তুজানোয়ারে বোঝাই এই এলাকা।’

রকিব হাসান। সংগৃহীত ছবি
রকিব হাসান। সংগৃহীত ছবি

এভাবেই স্কুল জীবনের তিন গোয়েন্দা আজো ঘিরে থাকে দৈনন্দিন জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে। ক্যারিবীয় সাগরতলে ডুবুরির অভিজ্ঞতা অর্জনের সময় সব কিছু ছাপিয়ে মনের পর্দায় কেবল ভাসতে থাকে অথৈ সাগরে মুসা আমানের অভিজ্ঞতার কথা। ব্রাজিলে বন্ধুর বাড়িতে হ্যামক দেখে, এই চিরচেনা বস্তুটির কথাই তো জেনেছিলাম ভীষণ অরণ্যে, যেমন একই বই থেকে জেনেছিলাম হাওলার বানরের ভয়াবহ চিৎকারের কথা। মেক্সিকোর ইয়ূকাটানের গহীন বনে পথ হারিয়ে সেই উদ্বাহু ভয়াবহ চিৎকারে যখন আমার বন্ধু হুয়ান ভিদাল পালানোর জন্য এক পায়ে খাঁড়া, তিন গোয়েন্দা হাতড়ে আমি বললাম, ‘ওরা অতি নিরীহ বানর, কেবল তাদের উৎপন্ন শব্দই ভয়াবহ!’

দেশে ফিরলেই পরম মমতায় তিন গোয়েন্দা সিরিজের প্রথম ৮৮টি বই আবার ধুলো ঝেড়ে, নিম পাতা ছড়িয়ে সাজিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে গভীর আবেগে আঙ্গুল বুলিয়ে যাই দক্ষিণের দ্বীপ, মমি, ঘড়ির গোলমাল, ছিনতাই—আরও কত বইতে; যেখানে আমার স্বপ্নালু কৈশোর আঁটকে আছে আজও।

এখনো শেখার চেষ্টা করি প্রিয় বইগুলো থেকে। এখনো মনে হয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হবে যদি কোনো দিন দক্ষিণের পলিনেশিয়ার প্রবাল দ্বীপে যেতে পারি, নীল ল্যাগুনে পা ডুবিয়ে দেখি সেই অপরূপ সূর্যাস্ত। এমন স্বপ্ন দেখানোর জন্য, জীবনে চলার উৎসাহ দেবার জন্য তিন গোয়েন্দার প্রতি আমার ঋণ প্রতিনিয়তই বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে; যা কোনদিনই শেষ হবার নয়।

তখনো পাখি দেখার নেশা পেয়ে বসেনি। কিন্তু ভূতের হাসি বইতে জানলাম কাকাবুরা নামের সেই পাখি আর তার বিটকেল হাসির কথা (বইটার মন্দলোকটার নাম ছিল ডাংম্যানআনে গোবরমানব, আজো হাসি আসে)। পরে কোকাবুরা নামের ক্রিকেট ব্যাট দেখেছিলাম। সেই বিশাল মাছরাঙা অস্ট্রেলিয়াতে দেখাও হয়েছিল। আর তার ভূতের হাসিও শোনা হয়েছিল।

বাহা ক্যালিফোর্নিয়া যেয়ে আসলেই তিমির খোঁজে বেরিয়েছিলাম নৌকায় চেপে। মেক্সিকোর অ্যাজটেক শহর তিওতিহুয়াকানে পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে ‘প্রাচীন মূর্তি’। আবার কানাডার আদিবাসীদের তৈরি টোটেম পোলের সমাহার দেখে মনে পড়েছে মূর্তির হুঙ্কারের কথা।

আইসল্যান্ডের সদ্য পরিচিত বন্ধুদের যখন তাদের লম্বা পারিবারিক উপাধির পেছনের ইতিহাস বলি। তারা অবাক হয়ে শুধোয়, জানলে কোথায় এতসব! তখন কৃতজ্ঞতা বোধ করি ধূসর মেরু নামের বইটির প্রতি। মেক্সিকোর চলুলা শহরে করটেজের কুৎসিত গির্জা দেখে মনে হয়েছিল ভাঙা ঘোড়ার করটেজের তলোয়ারের কথা।

তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই
তিন গোয়েন্দা সিরিজের কয়েকটি বই

আফ্রিকার বুনো প্রান্তরে বারংবার মনে পড়েছে পোচার, তেপান্তর আর সিংহের গর্জনের কথা। সোনালি ঘাসের বনে রক্তাক্ত মুখে হুমহাম শিকার খেতে থাকা সিংহযুগলকে দেখে মনে হয়েছে অবিকল প্রচ্ছদের সিংহটির মতো। এই বইটি থেকে আমার বিশাল পাওয়া ছিল ড. লুই লিকি সম্পর্কে জানতে পারা। কদিন আগেই তাঞ্জানিয়ায় ওল্ডুভাই গর্জ ঘুরে এসে সেই কথাটা মনে হলো। যেমন সাভো ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এই বইগুলোর কথা।

তবে খেলার নেশার পর থেকে আর তিন গোয়েন্দা পড়া হয়নি। কেন জানি আকর্ষণ কমে যাচ্ছিল প্রতি পর্বেই। তাই পুরনো ভালোবাসা রক্ষার তাগিদে আগেরগুলোই বারবার পড়া শুরু করি। নিজেকে মনে হতো বইয়ের পোকা রবিন। আবার কোনো কোনো সময় জন্তুপ্রেমী মুসা। মাঝেমধ্যে কিশোর পাশা, সবকিছুর পরও বাংলাদেশের বলে তো একটা দাবী থেকেই যায়! চোখ-কান খোলা রাখতাম টুলবেঞ্চির দিনগুলোতে- যদি কোন রহস্যের সন্ধান পেয়ে যায়, পুরনো বইয়ের ফাঁকে গুপ্তধনের নকশা, অমীমাংসিত অপরাধ!

এই বোধগুলো আরও জাগ্রত রাখে তিন গোয়েন্দার নানা অভিযান। ভুতুড়ে সুড়ঙ্গ আর দীঘির দানোর পর থেকে সারা বিশ্বের রহস্যময় জলদানবগুলো নিয়ে যত খবর পাওয়া, সবই সংগ্রহ করে ফেলি। মহাকাশের আগন্তুক থেকে মনে হতে থাকে কোনো দিন যদি আমাদের পাড়ার মাঠটাতে নামত এক ফ্লাইং সসার। ভয়াল গিরির রহস্যময় প্রাণিটার মতো একটা প্রাণি আবিষ্কারের আশা বুকের খাঁচার ডানা ঝাপটে চলে অবিরাম। কিউবার প্লায়া হিরণ নামের এক সৈকতবর্তী শহরে পদার্পণ করেই জানতে পারলাম এক ভয়াবহ জলদস্যু হিরণে নামে এই শহরের নাম। মনে হয়েছিল সেই জলদস্যুর দ্বীপে এলাম। দেখা হবে লুই ডেকেইনির সঙ্গে, নিদেন পক্ষে মরুর বুনো ঘোড়া ওমর শরীফের সঙ্গে।

খোঁড়া গোয়েন্দায় নতুন স্বাদ নিয়ে এলেন ভিক্টর সাইমন। সঙ্গে তার ভিয়েতনামী বাবুর্চি। মনে পড়ে বোম্বেটে বইয়ের টকার নামে ডেঁপো ছোকরার কথা। বোম্বেটে শব্দটির সঙ্গে পরিচয়ও সেই প্রথম। যেহেতু টিনটিন পড়েছি অনেক অনেক পরে। শুঁটকি টেরিয়ার ডয়েলের উপস্থিতিও কাম্য করতাম মনে প্রাণে কাহিনী জমানোর জন্য।

তিন গোয়েন্দা। সংগৃহীত ছবি
তিন গোয়েন্দা। সংগৃহীত ছবি

কিছু কিছু বইয়ের প্রচ্ছদও খুব মন কাড়ত। বার বার উল্টেপাল্টে দেখতাম পড়ার ফাঁকে। বিশেষ করে যেগুলোতে তিন গোয়েন্দার ছবি থাকত, যেমন ছুটি। সেই সঙ্গে কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি যেমন মহাবিপদ, ইন্দ্রজাল, মহাকাশের আগন্তক, রক্তচক্ষু—আরও কত নাম।

সেই সঙ্গে রাশেদ চাচা, মেরী চাচি, শোফার হ্যানসন, দস্যু শপা, মিস্টার পার্কার, কুমালো, রক্তচক্ষুর সেই পুরোহিত—কত আপন করা চরিত্র। হঠাৎ একদিন বুকের রক্ত ছলকে উঠল সদ্য প্রকাশিত তিন গোয়েন্দার বইটির নাম দেখে—ঢাকায় তিন গোয়েন্দা! কি যে ভালো লাগল রকিব হাসান তাদের বঙ্গভূমিতে নিয়ে আসায়।

সেই সঙ্গে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সঙ্গে আমারও উঁকি দেওয়া হয়ে যেত অদ্ভুত সব জগতে। যেমন পশু শিকারিদের চোরাকারবারে (পোচার), বাস্কেটবলের মাঠে (খেলার নেশা), পুরনো কমিক্সের রাজ্যে (অবাক কাণ্ড), গলফের পরিত্যক্ত বলের ব্যবসায় (বানরের মুখোশ), পুরনো মূর্তির সংগ্রহ (মূর্তির হুংকার), প্রজাপতির খামারে প্রজাপতির রঙ ঝিলমিল জগতে। যা কিছুই জানতাম, সবছিল নতুন, আনকোরা।

আফসোস বাড়ে যখন মনে হয়, ৭ম শ্রেণিতে বন্ধুকে ধার দেওয়া নকল কিশোর আজও ফেরত আসেনি (এখানে কিশোরের মতো দেখতে আরেকজন ছিল)। কিন্তু ভালো লাগে অনেক ঝামেলার পর উদ্ধার করতে পারা ওয়ার্নিং বেলের কথা মনে হওয়ায় (এইখানে এক ছেলে ছিল যার কণ্ঠ হুবহু কিশোরের মতো)।

এখনো শেখার চেষ্টা করি প্রিয় বইগুলো থেকে। এখনো মনে হয় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হবে যদি কোনো দিন দক্ষিণের পলিনেশিয়ার প্রবাল দ্বীপে যেতে পারি, নীল ল্যাগুনে পা ডুবিয়ে দেখি সেই অপরূপ সূর্যাস্ত। এমন স্বপ্ন দেখানোর জন্য, জীবনে চলার উৎসাহ দেবার জন্য তিন গোয়েন্দার প্রতি আমার ঋণ প্রতিনিয়তই বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে; যা কোনদিনই শেষ হবার নয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত