leadT1ad

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য যেভাবে ঝুঁকির মধ্যে

দুনিয়াজুড়ে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে বসবাস করছে কোটি কোটি মানুষ। ফলে প্রতিনিয়ত অসংখ্য দুর্যোগ আর জরুরি অবস্থার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এই দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থাগুলো কীভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে?

ফারজানা ইয়াসমিন
ফারজানা ইয়াসমিন
স্ট্রিম গ্রাফিক

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাজনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক অস্থিরতা কিংবা জরুরি পরিস্থিতি যেভাবে চলমান, তাতে মানুষের ঘরবাড়ি বা জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও গভীর আঘাত লাগে। মানসিক স্বাস্থ্যের এই আঘাত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতির থেকেও বেশি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট সংকট মানুষের মানসিক সুস্থতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

তাই এবারের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের যে প্রতিপাদ্য, ‘সেবার সুযোগ— দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য’, বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতাও খুবই প্রাসঙ্গিক। কথাগুলো বললাম বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় বিগত সরকার যে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার প্রত্যক্ষদর্শী আমরা সবাই। এ সময় এক হাজারের ওপরে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর আহত হয়ে, অন্ধ হয়ে ঘরবন্দী হয়েছেন অগণন মানুষ। অনেকে আবার চোখের সামনে মানুষকে মরতে দেখেছেন। এ ঘটনাগুলো তাদের মধ্যে নীরবে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার শুশ্রূষা কি হয়েছে?

একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। এক্ষেত্রে আহতদের শারীরিক স্বাস্থ্যেরর ব্যাপারে আমরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছি, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখনো সেভাবে নজর পায়নি। কথাটি অপ্রিয় হলেও সত্য।

তাঁদের মধ্যে ৮১ শতাংশ এখন ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, ৫৯ শতাংশ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন, ৭২ শতাংশের তীব্র মানসিক ট্রমা হয়; আর ৮১ শতাংশ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বারবার ফিরে আসে ভয়ংকর ট্রমার স্মৃতিগুলো। ফলে বেশির ভাগ সময় তাঁরা যেমন জুলাই আন্দোলনের ঘটনাসংশ্লিষ্ট চিন্তা করেন, তেমনি সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন না। উল্টো এসব নিয়ে ক্রমাগত তাঁরা দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন।

অন্যদিকে, দুনিয়াজুড়ে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে বসবাস করছে কোটি কোটি মানুষ। ফলে প্রতিনিয়ত অসংখ্য দুর্যোগ আর জরুরি অবস্থার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এই দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থাগুলো কীভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে? মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা, এমনকি উন্নত করার জন্য পর্যাপ্ত সেবার সুযোগ কি রয়েছে? আজকের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নগুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি।

যখনোই কোনো যুদ্ধ, ভূমিকম্প, বন্যা, সহিংসতা বা জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটে, তখন শুধু মানুষ শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ে। ঘর হারানো, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—এসব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে তাদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানবিক বিপর্যয়ের সময় প্রতি পাঁচজনের একজন মানুষ এমন মানসিক সমস্যা অনুভব করেন, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে।

যেকোনো বিপর্যয়ের সময় আমরা সাধারণত খাদ্য, পানি, ওষুধ, আশ্রয়—এসবকেই অগ্রাধিকার দিই। আবারও বলছি, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া হয় না সেভাবে। অথচ স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বলছে, মানুষের ভেতরকার নানান রকম ভাঙন কখনো কখনো বাহ্যিক ক্ষতির চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। ট্রমা, হতাশা, উদ্বেগ, পিটিএসডি—এসব সমস্যায় আক্রান্ত অনেকেই আসলে প্রয়োজন সঠিক সহায়তার। তাই ২০২৫ সালের এই প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, সেবা দেরিতে নয়, বরং পৌঁছতে হবে জরুরি সময়েই।

জুলাই আন্দোলনের এই আইকনিক ছবিটি আলোকচিত্রী জীবন আহমেদের তোলা।
জুলাই আন্দোলনের এই আইকনিক ছবিটি আলোকচিত্রী জীবন আহমেদের তোলা।

মানসিক স্বাস্থ্যের জরুরত অনুভব করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এর মধ্যেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে।

আর ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর আমরা তো নিজেরাই অনুভব করতে পারছি, যেকোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা জরুরি পরিস্থিতি শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যকে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এখানে এ-ও বলা দরকার, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন সেবাপ্রদানকারী ও সেবাদানকারী সংস্থাকে নানান রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ সময় জরুরি ওষধ বা সরঞ্জাম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় বাধাগ্রস্ত হয় সেবা প্রাপ্তির সুযোগ। ফলে সরাসরি মৃত্যুর প্রভাব ছাড়াও এমন পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে বিচিত্রধর্মী মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। যেমন করেছে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে। সে সময়ের বিভিন্ন ঘটনা মানুষের মনে এক ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব আমাদের সমাজে বড় আকারেই বিদ্যমান।

হিউম্যান রাইটস ডেভলপমেন্ট সেন্টার (এইচআরডিসি) চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের বেশ কয়েকজনের পরিবারের সদস্য এবং আহত ২৩ ব্যক্তির ওপর সম্প্রতি এক সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। সেই সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাঁদের প্রত্যেকেই মৃদু থেকে তীব্র মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এঁদের মধ্যে ৮১ শতাংশ এখন ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, ৫৯ শতাংশ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন, ৭২ শতাংশের তীব্র মানসিক ট্রমা হয়; আর ৮১ শতাংশ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বারবার ফিরে আসে ভয়ংকর ট্রমার স্মৃতিগুলো। ফলে বেশির ভাগ সময় তাঁরা যেমন জুলাই আন্দোলনের ঘটনাসংশ্লিষ্ট চিন্তা করেন, তেমনি সেই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন না। উল্টো এসব নিয়ে ক্রমাগত তাঁরা দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন।

হিউম্যান রাইটস ডেভলপমেন্ট সেন্টারের এই সমীক্ষা কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর করা হলেও এ থেকে অন্তত আঁচ পাওয়া সম্ভব যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বস্তুত মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয়—মানবাধিকার। মানবিক বিপর্যয়ের সময় একজন মানুষের শরীরের পাশাপাশি তার মন যেন সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করাও একটি বড় দায়িত্ব। ফলে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবসে ২০২৫ সালের যে প্রতিপাদ্য, তা আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু সাহায্য নয়, সহানুভূতিও প্রয়োজন। শুধু ত্রাণ নয়, মানসিক প্রশান্তিও জরুরি। আসুন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় যাঁরা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন, আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াই। তাঁদের মন বোঝার চেষ্টা করি।

লেখক: মনোচিকিৎসক

Ad 300x250

সম্পর্কিত