leadT1ad

শহিদুল আলমকে আটক করে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করা যাবে না

ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহিদুল আলম। এ সংবাদে তাঁর সহকর্মীরাই শুধু নন, উদ্বিগ্ন সমগ্র বাংলাদেশ। শহিদুলের কাজ ও ব্যক্তিত্বের ধরন প্রসঙ্গে লিখেছেন তাঁর সহকর্মী তানভীর মুরাদ তপু

তানভীর মুরাদ তপু
তানভীর মুরাদ তপু
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ১৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, আলোকচিত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল আলমকে আটক করে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্দ করা যাবে না। কারণ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর অবস্থানকে কোনো বিচ্ছিন্ন বা হঠাৎ করেই হওয়া আন্দোলন বলার সুযোগ নেই। তাঁর সঙ্গে আমি কাজ করছি ২০০৩ সাল থেকে। অবশ্য এর আগে থেকেই তাঁকে চিনতাম আমি। শহিদুল আলম সবসময় মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ফিলিস্তিনের পক্ষে তাঁর যে অবস্থান—এটি আসলে শহিদুল আলমের জীবনের ধারাবাহিক রাজনৈতিক পরিচয়ের অংশ। প্রতিবারই তিনি তাঁদের পক্ষে কথা বলেছেন, যাঁদের কণ্ঠস্বর অবহেলায় পতিত হয়; রাষ্ট্র বা পরাশক্তি যাদের অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আসলে প্রতিরোধের পক্ষে কথা বলাই শহিদুলের স্থায়ী চরিত্র। গাজা যাত্রার পথে আজ ইসরায়েলি হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন তিনি। আমি বিশ্বাস করি, এই গ্রেপ্তারি তাঁকে তাঁর লড়াই থেকে টলাতে পারবে না, কোনোভাবেই না।

প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে শহিদুল আলম আলোকচিত্রকে গ্রহণ করেছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি সবসময় এটিও বলেন যে ‘আগামীকাল যদি আলোকচিত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মাধ্যম পাই, যা দিয়ে আরও শক্তিশালীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব, তবে আমি আলোকচিত্র ছেড়ে সেই মাধ্যমকেই ব্যবহার করব।’ তাই শহিদুলের প্রতিরোধ-লড়াইকে বুঝতে হলে আমাদের এই বিষয়ও অনুধাবন করতে হবে। এমনকি তাঁর জীবনের বিভিন্ন ধাপ বিশ্লেষণ করলে আমরা এ-ও দেখতে পাব যে প্রতিরোধের সংগ্রামে তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে, মজলুমের পক্ষে অটল থাকেন।

শহিদুল আলমের কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি শিখেছি তা হলো অধ্যবসায়। তিনি সব সময় বলেন, ‘ভাগ্য তোমার পক্ষে তখনই থাকবে, যখন তুমি পরিশ্রম করবে।’ ফলে তাঁর কাছে প্রতিভার চেয়ে বেশি মূল্যবান হলো চেষ্টা। বলতে পারি, শহিদুলের এই অদম্য পরিশ্রমী মনোভাবই আমাদের প্রেরণা।

একটি কথা শহিদুল প্রায়ই বলেন, ‘অল হিউম্যানস আর পলিটিক্যাল অ্যানিমেল’—প্রতিটি মানুষই রাজনৈতিক প্রাণী। তাই বলতে পারি, ফিলিস্তিনের পক্ষে শহিদুল যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল—বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বিষয়টি বরং তাঁর সারাজীবনের প্রতিরোধেরই ধারাবাহিকতা।

আগেই বলেছি, শহিদুলের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর প্রতিবাদী মনোভাব ও আপসহীনতা। কোনোভাবেই তিনি আপস করেন না। যেমন বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে যখন তাঁকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখনো তিনি ছিলেন অটল ও অবিচল। এ সময় ডিবির হেফাজতে নিয়ে তাঁকে বলা হয়েছিল, একটি কাগজে মুচলেকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কারাগারকেই গ্রহণ করেছিলেন, নির্যাতনকে বরণ করে নিয়েছিলেন। অনেকের মনে থাকতে পারে, তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে আঘাত করা হয়েছে।’ হ্যাঁ, তিনি ‘আঘাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, অন্য কোনো কিছু নয়। এ থেকেও তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা বোঝা সম্ভব। তিনি মৃদুভাষী, কিন্তু নির্দিষ্ট, নিজের লক্ষ্যে অবিচল।

এসব বিষয় বিবেচনা করেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শহিদুল আলমের ফ্লোটিলায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি দেখতে হবে। সমুদ্রযাত্রার এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে তিনি নিয়েছেন, আমার এমন মনে হয় না। এটি হয়তো নিবিড় পরিকল্পনা আর প্রস্তুতির ফল। হয়তো তিনি অনেক দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন, কথা বলেছেন, ফ্লোটিলার আয়োজকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শেষে আমাদের জানিয়েছেন। আর দীর্ঘদিন থেকে তাঁকে চিনি বলে আমরাও বুঝতে পেরেছি যে এ লড়াইয়ে তিনি পিছু হটবেন না।

আমরা যদি শহিদুল আলমের এই প্রতিবাদী-প্রতিরোধী চরিত্রটির উৎস বুঝতে চাই, তবে কী দেখতে পাব? এটি কি তিনি শুধু পরিবার থেকে পেয়েছেন? আমার তা মনে হয় না। পরিবার, সমাজ, নিজের শিক্ষা, লড়াই—সবকিছু মিলিয়েই তিনি আজকের শহিদুল আলম। আসলে প্রকৃত শিল্পী আচার-ব্যবহার সবসময় ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ফল। ফলে শহিদুল আলমের অধ্যবসায় ও প্রতিবাদে অটল থাকার সূত্র শুধু পারিবারিক নয়, বরং তিনি নিজেই তা বেছে নিয়েছেন এবং আপন জীবনে অনবরত তার প্রয়োগ করেছেন।

শহিদুল আলমের কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি শিখেছি তা হলো অধ্যবসায়। তিনি সব সময় বলেন, ‘ভাগ্য তোমার পক্ষে তখনই থাকবে, যখন তুমি পরিশ্রম করবে।’ ফলে তাঁর কাছে প্রতিভার চেয়ে বেশি মূল্যবান হলো চেষ্টা। বলতে পারি, শহিদুলের এই অদম্য পরিশ্রমী মনোভাবই আমাদের প্রেরণা।

ইসরায়েলি হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদুল আলমের আমরা গ্রেপ্তার হওয়ার খবর আমরা প্রথম পাই ফেসবুকে, জাহাজের ট্র্যাকার দেখে। তখনই বুঝতে পারি, এবার কিছু একটা ঘটেছে। যেহেতু শহিদুল এখন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে বন্দি, তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর সহকর্মী হিসেবে আমরাও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। তবে তিনি আটক হয়েছেন বলে যে আমরা উদ্বিগ্ন, বিষয়টি এত সরল নয়। আমরা উদ্বিগ্ন ইসরায়েলি বাহিনী তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করে তা নিয়ে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, পশ্চিমা নাগরিকদের সঙ্গে ইসরায়েল একরকম আচরণ করে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে তাদের আচরণটি হয় অন্য রকম। তা ছাড়া, এখনো তো কেউই জানে না যে শহিদুলকে কতদিন আটকে রাখা হবে বা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তাই আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

তবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের মতো আমাদেরও আশার জায়গা হলো শহিদুল আলমের মানসিক শক্তি ও লড়াই করার সাহস। আমরা তাঁর সাহসের শক্তিতেই বলীয়ান হতে চাই। এক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া হলো, শহিদুল আলমসহ ফ্লোটিলায় আটক সবাইকে নিরাপদে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। গাজার ওপর অবরোধ তুলে দিতে হবে। আর একই সঙ্গে দিতে হবে মানবিক ত্রাণ পৌঁছানোর নিশ্চয়তাও। এক্ষেত্রে আমরা জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

শহিদুল আলম আজ বন্দি। কিন্তু তাঁর প্রতিরোধের কণ্ঠ এখনো ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি আমাদের দেশের এমন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, যার মধ্যে ন্যায়, প্রতিরোধ আর মানবতার আলো একসঙ্গে মিশে আছে। তিনি আমাদের আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকারের ভেতরেও জ্বালিয়ে রাখতে পারেন সাহসী প্রতিরোধ।

লেখক: ‘পাঠশালা’র আলোকচিত্র বিভাগের প্রধান

Ad 300x250

সম্পর্কিত