leadT1ad

ভারতের মাটিতে তালেবান, এই সফর নিয়ে কেন এত শোরগোল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ৫৬
আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ভারতে পৌঁছেছেন। ২০২১ সালে তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর দেশটির কোনো শীর্ষ নেতার এটি প্রথম ভারত সফর।

কিছুদিন আগেও এই দৃশ্য অকল্পনীয় ছিল। আট দিনের এই সফরে মুত্তাকি ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন বলে কথা রয়েছে।

এই সফরকে ভারতের আফগান নীতির এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) আমির খান মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করার পর দিল্লি ঘোষণা করেছে, চার বছর আগে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ করে দেওয়া কাবুল দূতাবাস পুনরায় খুলবে ভারত।

ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা পাকিস্তান নিবিড়ভাবে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থেকে সাময়িক ছাড় পাওয়া মুত্তাকি রাশিয়া থেকে দিল্লি সফরে এসেছেন। তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ রাশিয়া।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ইসলামাবাদ, দিল্লি কিংবা তালেবান— কেউই কল্পনা করতে পারেনি এত অল্প সময়ের মধ্যেই তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এত খারাপ হয়ে যাবে এবং একই সময়ে আফগানিস্তানের নতুন সরকারের সঙ্গে ভারত বহুপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে।

দিল্লি একসময় পশ্চিমা-সমর্থিত আফগান সরকারকে সমর্থন করত। এই সরকার তালেবানের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। এই সফর উভয় পক্ষের বাস্তববাদ (প্র্যাগম্যাটিজম) এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক দারুণ দৃষ্টান্ত। যা প্রমাণ করে দুই দেশই কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে কতটা আন্তরিক।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) দিল্লিতে আফগান বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মুত্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আপনাদের জাতীয় উন্নয়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতায় অবদান রাখবে।’ আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতার প্রতি ভারতের পূর্ণ প্রতিশ্রুতির কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

অন্যদিকে, মুত্তাকি ভারতকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তার এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে।

আফগান প্রতিনিধি দল ভারতের ব্যবসায়িক মহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে।

অসম্ভাব্য মিত্রদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি

যদিও ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও অন্যান্য কয়েকটি দেশের মতো ভারতও তালেবানের সঙ্গে কিছু কূটনৈতিক বা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বর্তমানে কাবুলে ভারতের একটি কূটনৈতিক দপ্তর (স্মল মিশন) রয়েছে এবং বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে তারা মানবিক সহায়তা পাঠিয়ে থাকে।

২০২১ সালে তালেবানের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফেরার পরপরই ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার এবং ইসলামপন্থী তালেবানের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক শুরু হয়েছিল।

এই সফর এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারত-পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-তালেবান—উভয় সম্পর্কই অবনতির দিকে।

ভারত-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর বিশেষজ্ঞ ভি পন্ত ও শিবম শেখাওয়াত বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় তালেবান এখন দেখাতে চায় যে তারা ইসলামাবাদের ওপর নির্ভরশীল নয় এবং একটি স্বাধীন পরিচয় তৈরি করতে চায়।’

পন্ত ও শেখাওয়াতের মতে, ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তালেবান নিজেদের অভ্যন্তরীণ জনগণের কাছে এই বার্তা দিয়ে চায় যে, তাঁদের নেতৃত্বে আফগানিস্তান একটি স্থিতিশীল, কার্যকর এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম।

কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক ব্রহ্মা চেলানি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, এই সফর ‘পাকিস্তানের জন্য একটি বড় ধাক্কা’ এবং এটি তালেবান শাসনের কার্যত স্বীকৃতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ব্রহ্মা চেলানি আরও বলেন, এই সফর ‘ভারত-তালেবান সম্পর্কের সতর্ক পুনর্গঠন’ যেখানে উভয় পক্ষই তাদের কৌশলগত স্বার্থকে এগিয়ে নিতে বাস্তবসম্মত সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চেলানির মতে, এই সফর আফগানিস্তানের আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিচ্ছে।

মাত্র চার বছর আগেও এই পরিস্থিতি অবিশ্বাস্য মনে হতো।

আফগান প্রতিনিধি দল ভারতের ব্যবসায়িক মহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে। ছবি: সংগৃহীত
আফগান প্রতিনিধি দল ভারতের ব্যবসায়িক মহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে। ছবি: সংগৃহীত

অতীত থেকে বর্তমানের দিকে পরিবর্তন

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় যখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর প্রত্যাহারের সময়সূচি ঘোষণা হয়, তখন ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলে আতঙ্ক দেখা দেয়। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখল করার সঙ্গে সঙ্গে ভারত আফগানিস্তানে তাদের দূতাবাস এবং চারটি কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। আফগান শিক্ষার্থী, রোগী, ব্যবসায়ী ও প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তাসহ সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ভিসা প্রদানও বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে, এক ক্লিকেই হাজার হাজার আফগানকে ইতিমধ্যে দেওয়া প্রায় সমস্ত ভিসা বাতিল করে ভারত।

কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ভারত তার কূটনৈতিক উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ২০২২ সালের জুনে মানবিক সহায়তা বিতরণ তদারকির জন্য একটি ‘কারিগরি দল’ আফগানিস্তানে পাঠায়।

এরপর ভারত ধীরে ধীরে তালেবান সরকারের প্রভাবশালী সদস্য, কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়া শুরু করে। এই সফরগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা না হলেও, তা আস্থা ও বোঝাপড়া তৈরিতে সাহায্য করেছিল। গত নভেম্বরে, ভারত তালেবানকে দিল্লিতে একজন দূত নিয়োগ করার এবং প্রথমে মুম্বাই ও কয়েক মাস পরে হায়দ্রাবাদে কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দেয়।

গত তিন বছরে দুই দেশ ধীরে ধীরে সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুবাইয়ে মুত্তাকি এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরির বৈঠকসহ ভারতীয় কর্মকর্তা এবং কূটনীতিকরা তালেবান সরকারের সঙ্গে বিদেশে বেশ কয়েকটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

প্রভাব বিস্তারের লড়াই

ভারত ও পাকিস্তান বহু বছর ধরে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতায় এক পক্ষের সাফল্য মানে অন্য পক্ষের ক্ষতি (জিরো-সাম গেম)।

তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ভারতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক মহল দীর্ঘদিন ধরে তালেবানকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি মনে করত। ভারত মনে করত, তালেবানদের উদ্দেশ্য হল আফগানিস্তান থেকে ভারতকে সরিয়ে দেওয়া।

২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে মিলে আফগানিস্তানে তালেবান-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করেছিল।

পরবর্তী ২০ বছর ধরে ভারত মার্কিন-সমর্থিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফগান সরকারের একটি প্রধান সমর্থক ছিল। এই দীর্ঘ সময় ধরে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে তালেবান বিদ্রোহীরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।

তালেবানের প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) এবং তাদের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও, এখন সেই সম্পর্ক অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে।

পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আফগানিস্তানকে ‘শত্রু দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, তালেবান সরকার পাকিস্তানি তালেবানকে (টিটিপি) আফগান মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালাতে সাহায্য করছে। এমনকি টিটিপি-র আস্তানা আখ্যা দিয়ে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলাও চালিয়েছে পাকিস্তান।

তালেবান বারবার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, পাকিস্তানের ভেতরের কিছু মহল আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চায়।

ভারতের স্বার্থ

তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বজায় রাখার প্রধান কারণ হলো নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা।

দিল্লির সবচেয়ে বড় উদ্বেগ নিরাপত্তা, বিশেষ করে ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল-কায়েদা ও ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয় অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রম। তালেবান দিল্লিকে আশ্বস্ত করেছে যে তারা আফগান ভূখণ্ডকে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেবে না। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) মুত্তাকি আবারও এই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের জন্য ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ গভীর করার সুযোগও তৈরি করেছে, যা এই অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

ভারত ও তালেবান সরকারের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হলেও উভয় পক্ষই সতর্ক। অতীতে যা ঘটেছে, তার পাশাপাশি বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিবেচনা এবং সম্ভাব্য বৈদেশিক প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের সম্পর্ক এখনও কৌশলগত পর্যায়েই রয়ে গেছে।

এই কৌশলগত সম্পর্ক কি ভবিষ্যতে আরও গভীর হবে, নাকি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা সীমাবদ্ধই থেকে যাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ভবিষ্যতের হাতেই তোলা রইল।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত