leadT1ad

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বুদ্ধিজীবীতার জন্য দিশা

সানোয়ার রাসেল
সানোয়ার রাসেল
স্ট্রিম গ্রাফিক

একটা রাষ্ট্রে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকেরা ক্ষমতায় থাকার সময় কী করে? তারা যে সব সময় টাকাপয়সার জোরে কিম্বা অস্ত্রপাতি আর বাহিনীর জোরে টিকে থাকে এমন নয়। বরং তারা শিল্প-সাহিত্য, কবিতা, আর্ট-কালচার, থিয়েটার, সিনেমা, মিডিয়া, ক্রীড়া-বিনোদন ইত্যাদি যত সফট পাওয়ার আছে—তার সব কিছু দিয়ে জনগণ তথা শাসিতদের মনে নিজেদের ভাব, আদর্শ, বিশ্বাস ইত্যাদি ছড়িয়ে দিতে চায়।

এতে হয় কি, জনগণের একটি বড় অংশ ওইসব শাসকদের চিন্তা, বিশ্বাস, ভাবাদর্শ ইত্যাদি অনেকটা ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’-এর মতো মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যেন তাদের এসব নিয়মকানুন, তাদের প্রচার করা মূল্যবোধ, আদর্শ, ইতিহাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক সত্যের মতোই অবধারিত কিছু! এই যে জনগণকে এভাবে মানিয়ে নেওয়া, এই ব্যাপারটাকে চলতি বাংলায় বলে, ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ বিস্তার।

এখন জনগণের বড় অংশের বাইরেও তো একটা ছোট অংশ থাকে। সেই ছোট অংশের অনেকেই এসব বুজরুকি টের পেয়ে যায়। তাঁদের অনেকেই টের পেয়েও মোটামুটি চেপে যায়, কোনো মতে দিন পার করে দেয়। কিন্তু অনেকেই আবার এসব মানতে চান না। তাঁরা ‘ঘাউড়া কিসিমের’। তাঁরা শাসকদের এসব সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পাল্টা আধিপত্য তৈরি করতে চায়। যেটা গণমানুষের সংস্কৃতিরে ধারণ করে, তাঁদের হয়ে বয়ান তৈরি করতে চায়। এই পাল্টা আধিপত্য তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লাগে। এগুলো এক-দুই দিনের কারবার না। আর এই কারবারে সবচে বেশি ভূমিকা রাখেন বুদ্ধিজীবীরা।

দুনিয়ায় দুই কিসিমের বুদ্ধিজীবী আছেন। একদল আজীবনই শাসকের খান, শাসকের পরেন, আর তাদের বুদ্ধির সবটা খরচ করে শাসকের ভাবাদর্শ, চিন্তা-চেতনা আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে। তত্ত্বজীবীরা তাঁদের বলেন ‘ট্র্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবী’। আর এক কিসিমের বুদ্ধিজীবী জনতার ভেতরের একজন হয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-চেতনা, ভাব-আদর্শ—এসবকে তুলে ধরতে নিরন্তর কাজ করে যান। তাঁদের বলা হয় ‘অর্গানিক বুদ্ধিজীবী’। ট্র্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা শাসকদের কাছ থেকে টাকাপয়সা, শাসকদের দেওয়া পুরস্কার ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের কপালে অধিকাংশ সময়ে ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিতিও জোটে না। উলটো অনেক সময় ট্রলও জোটে। কেননা স্টাবলিশড চিন্তা-চেতনা তো ইতিমধ্যেই শাসকেরাই নির্ধারণ করে রেখেছে! তবে দিনেদিনে তাঁদের সেসব প্রচেষ্টা ক্রমপুঞ্জিত হতে থাকে এবং মানুষেরা অবচেতনেই সেসব চিন্তা গ্রহণ করতে থাকেন। মূলত এগুলো জনগণেরই চিন্তা, শাসকেরা যেসব চিন্তা থেকে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে রেখেছিল।

এসব অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টাগুলো তথা পাল্টা সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরির এই প্রচেষ্টা জনগণের মুক্তির জন্য দরকার আছে। প্রশ্ন হলো, জনগণের মুক্তি জিনিসটা আসলে কী? জনগণের মুক্তি হলো আসলে মানুষ হিসেবে তার রাজনৈতিক রূপান্তর।

এসব অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টাগুলো তথা পাল্টা সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরির এই প্রচেষ্টা জনগণের মুক্তির জন্য দরকার আছে। প্রশ্ন হলো, জনগণের মুক্তি জিনিসটা আসলে কী? জনগণের মুক্তি হলো আসলে মানুষ হিসেবে তার রাজনৈতিক রূপান্তর। এই রূপান্তরের মাধ্যমে আদতে সে শাসকের গোলাম হতে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল মানুষ হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন করতে পারেন, কীভাবে এই রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটে? ঘটনা বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যদি একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে পরিবর্তিত হয় কিংবা যদি রাষ্ট্রে কোনো বিপ্লব ঘটে অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতরেই বড় ধরনের কোনো সংস্কার হয় কিংবা যদি দীর্ঘ কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতের পর রাষ্ট্রে নতুন কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এইসবের কোনো একটা বা দুইটা অথবা সব কিংবা এর বাইরেও অন্য কোনো ঘটনা জনগণের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়ে দিতে পারে। মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রে এমন অনেক আপাত বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে, যাতে করে মনে হয়, এই বুঝি জনগণের রাজনৈতিক রূপান্তর হয়ে গেল। কিন্তু কিছুদিন গেলেই দেখা যায় যে যেই লাউ সেই কদু। আদতে হয়তো সেটা কোনো ছদ্ম-বিপ্লব ছিল!

সাইকোলজিতে, বিশেষ করে আচরণবাদে এই ‘রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ বলে একটি মৌলিক ধারণা রয়েছে। সেখানে আপনি দেখবেন, প্রায় সব প্রচলিত ধর্মে স্বর্গ-নরক, জান্নাত-জাহান্নাম, হ্যাভেন-হেল টাইপের ধারণা আছে, যেইগুলা মূলত এই রিওয়ার্ড এন্ড পানিশমেন্টেরই ধারণা। হিন্দু মতে, মানবদেহের মৃত্যুর পর পূন্যবান আত্মারা স্বর্গে আনন্দে দিন কাটাবে, আর পাপী আত্মাগুলা নরকে কষ্টভোগ করবে। এই সুখ আর কষ্ট আবার চিরস্থায়ী নয়, অস্থায়ী। তারা তাদের কর্মফল অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী স্বর্গসুখ কিংবা নরকযন্ত্রণা ভোগ করবার পরে আবার পুনর্জন্ম লাভ করবে। আবার মৃত্যু, আবার কর্মফল অনুযায়ী পুনর্জন্ম। এই চক্র চলতে থাকবে, মোক্ষ লাভ করার আগ পর্যন্ত। তা মোক্ষলাভ আবার সকলের দ্বারা সম্ভব হয় না। ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী জান্নাত-জাহান্নাম। পুণ্যবান মানুষ মৃত্যুর পর জান্নাতে তার পুরস্কার পাবে এবং পাপী বান্দা মৃত্যুর পর জাহান্নামে তার শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। বৌদ্ধ ধর্মমতে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো নির্বাণ লাভ। জগতের এই সব দুঃখ, কষ্ট, মায়া, জরা, রোগ-শোক ইত্যাদি থেকে যে নির্বাণ লাভ করতে পারলো, সেই পুনর্জন্মের কষ্টভোগ থেকে মুক্তি পেলো।

এই পুরষ্কার ও শাস্তি প্রথা করপোরেট-জগতে এবং অন্যান্য পেশাতেও আমরা ক্রিয়াশীল দেখি। একজন কর্মচারী পদোন্নতি, বেতনবৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদির আশায় এবং চাকুরিচ্যুতি, পদাবনতি, ইনক্রিমেন্ট হেল্ডাপ ইত্যাদি শাস্তির ভয়ে ভালো পারফরম্যান্স করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কী হয়? গণতন্ত্রে ভোটের মাধ্যমে জনগণ এই রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্ট প্রয়োগ করবার সুযোগ পায়। শাসক যদি ভাল কাজ বেশি ও মন্দ কাজ কম করে, তাহলে জনগণ সেই শাসকের পক্ষে ভোটের মাধ্যমে রায় প্রদান করে তাদের আবার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শাসন করার জন্য নির্বাচিত করেন—এটা পুরষ্কার। আর শাসক যদি মন্দ কাজ বেশি করে, ভালো কাজ কম করে, তাহলে জনগণ ভোটের মাধ্যমে অন্য শাসককে বেছে নেন এবং বর্তমান শাসককে প্রত্যাখ্যান করেন—এটা শাস্তি।

পুরষ্কার ও শাস্তি প্রথা করপোরেট-জগতে এবং অন্যান্য পেশাতেও আমরা ক্রিয়াশীল দেখি। একজন কর্মচারী পদোন্নতি, বেতনবৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদির আশায় এবং চাকুরিচ্যুতি, পদাবনতি, ইনক্রিমেন্ট হেল্ডাপ ইত্যাদি শাস্তির ভয়ে ভালো পারফরম্যান্স করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন।

এখন শাসক যখন স্বৈরাচার হতে থাকে, তখন কী করে? সে ক্রমে ক্রমে জনগণের এই পুরষ্কার অ শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তথা ভোটাধিকারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। তারা বিরোধীদলকে নির্মূল করতে থাকে। ভোটকেন্দ্র দখল করে, দিনের ভোট রাতে করতে থাকে।

এসব বলপ্রয়োগ পদ্ধতির পাশাপাশি শাসক তার ট্র্যাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বয়ান তৈরি করতে থাকে। যেমন, খারাপ হলেও এই শাসকের বিকল্প কে? কিংবা এই শাসকেরাই একমাত্র স্বাধীনতার চেতনার পাহারাদার। অথবা গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নই বেশি জরুরি বা এই সরকারকেই পাঁচ-দশ-পঞ্চাশ বছর দেখতে চাই ইত্যাদি। আর এই সব ধ্যান-ধারণার প্রচারে সহায়তা করে শাসকের পালিত সাংস্কৃতিক কর্মী, মিডিয়া হাউজ, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। পাবলিকের একাংশের মনে এইসব ধারণাই প্রাকৃতিক সত্য বলে মনে হতে থাকে। এটাই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রভাব। আর তার ফলে ঐ যে শাসক ক্ষমতায় থাকার জন্য যেইসব জোর-জবরদস্তিগুলো করছিল, সেগুলো জনগণের কাছে যুক্তিসংগতই মনে হতে থাকে। কাজেই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্য থেকে যেই প্রতিরোধ আসার কথা ছিল, তা ঠিকঠাক মতো গড়েই উঠতে পারে না।

এখানেই অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের কাজ করার জায়গা। জনগণের মুক্তির জন্য তাঁদের রাজনৈতিক রূপান্তরের দীর্ঘ সংগ্রামটাই তাঁদের করে যেতে হয়। এক জীবনে তার ফল আশা না করেই এই কাজটা তাঁদের করে যাওয়া উচিত।

পাঁচ আগস্ট-পরবর্তীতে বাংলাদেশের অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক, অ্যাক্টিভিস্টরা কী করবেন না করবেন, তার দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকেই ‘মববাজি’কেই অ্যাক্টিভিজম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অনেকেই নতুন নতুন সংগঠন খুলে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, অনেকে আবার আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হচ্ছেন। যদি সত্যি সত্যিই জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করতে চান, জনগণের বুদ্ধিজীবী হয়ে কাজ করতে চান, তাহলে আপনাদের কাজ হলো এই খেয়াল রাখা যে নতুন যাঁরা আসছেন বা আসবেন, সেই শাসকের মধ্যে কেউ জনগণের কাছ থেকে এই রিওয়ার্ড অ্যান্ড পানিশমেন্টের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায় কি না। এবং অতি অবশ্যই বুদ্ধিজীবী হিসাবে শাসকের পকেটে গিয়ে না ওঠা। ব্যস।

লেখক: কবি

Ad 300x250

সম্পর্কিত