leadT1ad

আজ বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের গল্প কেন ফুরায় না

আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা কেন বারবার হোঁচট খায়?

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের গল্প কেন ফুরায় না। স্ট্রিম গ্রাফিক

কাকে বলে গণতন্ত্র? এই প্রশ্ন আজ পুরোনো। পুরনো হয়ে গেছে এই প্রশ্নও--বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা কোথায়? এমনকি পুরোনো হয়ে গেছে বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। তবু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ফুরায় না। খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশিরা স্বপ্ন দেখে গণতন্ত্রের। যদিও পশ্চিমী আধুনিকতা ও আধুনিকায়নের অনুষঙ্গ হিসেবে এ অঞ্চলে এসেছিল গণতন্ত্রের ধারণা। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাবাদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান ও পতন। তাই বলে গণতান্ত্রিক চেতনা শতভাগ পশ্চিমী সম্পদ, তা বলা যায় না। কেননা ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উদ্যোগসমূহে দেখা যায় গণক্ষমতার উপাদান। হাজি শরিয়তুল্লাহ ও তিতুমিরের সশস্ত্র আন্দোলন কিংবা নীলবিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহের ভেতর এই জনগণক্ষমতা তীব্রভাবে প্রকাশিত।

তবে আজকের অর্থে, উদার, জনগণ চেতনা, মুক্তমত, স্বাধীনতা ইত্যাদি ভাবধারার যে সম্মিলনকে আমরা গণতন্ত্র বলে চিনি এ অঞ্চলে তার বিস্তার ঘটেছে ইউরোপীয় শিক্ষার সূত্রে। বিশ শতকে উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে গণতান্ত্রিক ভাবধারা। ১৯৪৭-এর আগ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পরিসর আমরা দেখতে আরম্ভ করেছি। ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্তি তাই গণতান্ত্রিকতায় উত্তরণেরও ইতিহাস। কিন্তু প্রত্যাশিত জনশাসন কি পূর্ববঙ্গে মানুষ পেয়েছে?

এদেশের মানুষ সামন্তবাদী আধিপত্য থেকে মুক্তি পেলেও নতুন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে খোদ ভাষা ও সংস্কৃতিই দমন ও নিপীড়নের শিকার। আর তাই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গণতান্ত্রিক মানসিকতা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার ন্যূনতম সাতটি ছিল গণতন্ত্রমুখিনতার নিদর্শন; যেখানে দাবি করা হয়েছিল পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন, বিচারবিভাগ থেকে শাসনবিভাগকে আলাদা করা, সংবাদপত্র ও সভাসমিতি করার অবাধ অধিকার নিশ্চিতকরণ। কিন্তু আধিপত্যের আরও কিছু প্রকাশ বাকি ছিল।

রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সত্যিকার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

১৯৫৮ সালে স্বাধীন পাকিস্তানে দেখা দিল সামরিক শাসন। গণতন্ত্রায়নের প্রাথমিক যুগেই মুখ থুবড়ে পড়ল পূর্ববঙ্গের মানুষের রাষ্ট্রবাসনা। সেখান থেকেও মানুষ মুক্তি খুঁজেছে। ছয় দফা কর্মসূচির ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও প্রাপ্তবয়স্কের ভোটের দাবি। সংখ্যাগরিষ্ঠের দিক থেকে এই দাবি গণতান্ত্রিক। সামরিক সরকার জনদাবিকে উপেক্ষা করেছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সমবেত হয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর এ দেশের মানুষের মনে আবারও সংগঠিত হয়েছে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রবাসনা। ১৯৭১-এ জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্র–বাংলাদেশ। এবার সংবিধানে বিশেষভাবে যুক্ত হলো ‘গণতন্ত্র’। কিন্তু গণতন্ত্র কি এল?

আমরা দেখতে পেলাম, নতুন নেতৃত্বে ফিরে এল দুঃশাসন--যাকে কখনোই গণতান্ত্রিক শাসন বলা যায় না। সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার চূড়ায় আরোহণ করেছে জাতীয়তাবাদী শক্তি। তারই হাত ধরে এসেছে বাকশালের মতো একদলীয় শাসন। মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সংবাদপত্র। নির্বাচন চলাকালে ছিনতাই করা হয়েছে ব্যালট বাকশো। অর্থাৎ গণতন্ত্র হরিয়ে ফেলেছে তার প্রত্যাশিত দিশা।

১৯৭৫-এর পর গণতন্ত্রে উত্তরণের চেষ্টা চলেছে। কিন্তু তা এসেছে সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে। এখানেও ছিল মত ও পথের ভিন্নতা। আশির দশকের পুরোটা সময় কেটেছে গণতন্ত্রহীনতায়। সামরিক আইনের অধীন জিয়াউর রহমান তিন বছর আট মাস এবং হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ চার বছর চার মাস রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এই সময়পর্বে ইচ্ছেমতো ব্যবহৃত হয়েছে ভোট, রাজনীতি আর সংবিধানও। এরশাদের সময় মিছিলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাক। ভিন্নমত দমন করা হয়েছে প্রবলভাবে। জনতার সম্মিলিত প্রত্যাশার কোনো চিহ্ন আমরা দেখতে পাইনি।

এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ আবার শামিল হয়েছিল নব্বইয়ের আন্দোলনে। নাগরিক অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে সামরিক বাহিনীপ্রসূত রাষ্ট্রপতিকে। এই অভ্যুত্থান স্বপ্ন দেখিয়েছিল নতুন বাংলাদেশের। কিন্তু নব্বই-উত্তর সরকারগুলো সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক মানসিকতা দেখাতে পারেনি। বিরোধী দলগুলোও দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো সরকারই সহজে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ প্রস্তুত করতে চায়নি।

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান। সংগৃহীত ছবি
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান। সংগৃহীত ছবি

এই সব কিছুর অর্থ দাঁড়ায়, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সত্যিকার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ তার অঙ্গীকারে লিখেছে, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ এবং ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি স্তরের সব প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতির চর্চা ও অনুশীলন করা।’ কিন্তু গণতন্ত্রবিষয়ক কোনো অঙ্গীকারই আওয়ামী লীগ রক্ষা করতে পারেনি। রক্ষা করার কোনো সৎ ও আন্তরিক প্রয়াস দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের গঠনতন্ত্রের একাধিক ধারায় গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ‘উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক মানবমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন।’, ‘এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়’ এবং ‘গণতান্ত্রিক জীবনধারা ও গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবে গণনির্বাচিত জাতীয় সংসদের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা।’ বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই বিএনপিও ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সব দল নির্বাচন বর্জন করায় দলটি ২৮৯ আসনে জয়লাভ করে। ২০০৬ সালেও ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপি একরোখা আচরণ করেছে।

বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্রের জিকির তুলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও কোনো সরকারই যথার্থভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখেনি। ক্ষমতার আসনে থাকা দল গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখায়; সেই দলই ক্ষমতার আসনচ্যুত হলে গণতন্ত্রায়নের কথা বলে। পঞ্চান্ন বছরের বাংলাদেশ এই দ্বিচারিতারই পুনরাবৃত্তি দেখেছে।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টি লিখেছে, ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সংহত করা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দৃঢ়মূল ভিত্তি প্রদান...।’ সামরিক আশ্রয়প্রশ্রয়ে থাকা জাতীয় পার্টি সব সময়ই থেকেছে গণতান্ত্রিক চেতনার বাইরে। সুবিধাবাদী আচরণ ও অবস্থানের কারণে জাতীয় পার্টি সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী দলে পরিণত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।

গণতন্ত্রের উল্লেখ আছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে। ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অংশে বলা হয়েছে, ‘নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা’র কথা। ‘স্থায়ী কর্মনীতি’র একটি অংশে আছে, ‘সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করিয়া সমাজ হইতে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।’ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনে’র প্রসঙ্গ। চার দলীয় ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তনের কথা বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অনুগামী।

১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান। সংগৃহীত ছবি
১৯৯০ এর গণ-অভ্যুত্থান। সংগৃহীত ছবি

দলীয় গঠনতন্ত্রে বারবার গণতন্ত্রের উল্লেখ এই ভাবনাই জোগায় যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক। এটি খুবই ইতিবাচক দিক। কিন্তু তত্ত্ব আর প্রয়োগের মাঝখানে কোনো যোগসূত্র কি স্থাপিত হয়েছে? বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্রের জিকির তুলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও কোনো সরকারই যথার্থভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখেনি। ক্ষমতার আসনে থাকা দল গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখায়; সেই দলই ক্ষমতার আসনচ্যুত হলে গণতন্ত্রায়নের কথা বলে। পঞ্চান্ন বছরের বাংলাদেশ এই দ্বিচারিতারই পুনরাবৃত্তি দেখেছে।

অগণতান্ত্রিকতার সাম্প্রতিক নজির বিগত দেড় দশকের আওয়ামী শাসনকাল। বিগত সরকার গণতন্ত্রবিরোধী সব ধরনের তৎপরতা চালিয়েছে। ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে নির্দয়ভাবে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন–যাকে সাম্প্রতিক কালে ফ্যাসিবাদ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘আইডিওয়লজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাস’ বা রাষ্ট্রের ভাবদর্শিক হাতিয়ার এবং ‘রিপ্রেসিভ স্টেইট অ্যাপারেটাস’ বা রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক যন্ত্র যৌথভাবে জনগণের ওপর নিষ্পেষণ চালিয়েছে। গণতন্ত্রের বদলে দেখা দিয়েছে গণভীতি।

আর এসবের প্রতিক্রিয়ায় জনতা তার চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে উৎখাত করেছে কর্তৃত্ববাদী সরকারকে। এই অভ্যুত্থান একদিকে যেমন প্রতিবাদ, অন্যদিকে প্রত্যাশার দরোজায়ও কড়া নেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আবারও উন্মুখ হয়েছে গণতন্ত্রের খোঁজে, আবারও তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়, ফিরে পেতে চায় নেতৃত্ব নির্বাচিত করার অধিকার। বাংলাদেশের মানুষ আবারও হাঁটতে চায় গণতন্ত্রায়নের পথে। কীভাবে সম্ভব সত্যিকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা?

গণতন্ত্র কী, গণতন্ত্রায়ণের পথ ও পদ্ধতি কী--এই সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট দার্শনিক ও প্রায়োগিক বোঝাপড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেই। গণতন্ত্র এবং এই জাতীয় শব্দ ও ভাবকে তারা অতিমাত্রায় ব্যবহার করে স্রেফ ‘রাজনৈতিক পরিভাষা’ হিসেবে।

এই প্রশ্নের জবাবে হতাশাকেই বরণ করে নিতে হয়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই; বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের ধারণা দলের অভ্যন্তরের গণতন্ত্রকে খারিজ করে দেয়। এর বিপরীতে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণে দলগুলোর কোনো আন্তরিকতা দেখা যায় না, নেই সদিচ্ছাও। তা ছাড়া, একেকটি রাজনৈতিক দল মুখ্যত দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে তারা মনে করে স্বজনতোষণ ও ব্যবসায়িক উন্নতির হাতিয়ার। ফলে বিলীন হয়ে গেছে গণতন্ত্রের বোধ।

জনগণের প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের অশ্রদ্ধার বড় প্রমাণ তাদের ভাষা। বিশেষভাবে তাদের শরীরী ভাষাও বলে দেয়, তাঁরা আগাগোড়া অগণতান্ত্রিক। মিছিল, ময়দান আর গণমাধ্যমে তাঁরা কথা বলেন শাসানোর ভাষায়। চেতনার দিক থেকে যে গণতান্ত্রিক নয়, সে তার শরীর ও বাচন দিয়ে সেই অগণতান্ত্রিক চৈতন্যকেই প্রকাশ করবে। আর তাই গণতন্ত্রের জয়গান গাওয়া নেতৃবর্গের কাছ থেকে এমন ভঙ্গির কথাই শোনা যায় যে যত উন্নয়ন, অগ্রগতি সবই তাঁর বা তাঁদের দান। অর্থাৎ জনগণের অবদানকে অস্বীকার করা হয়, জনগণকে বিযুক্ত করে ফেলা হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে।

আরও একটি সমস্যাকে গভীর বলেই অনুমিত হয়। সেটি হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার গণতন্ত্র বিষয়ক দার্শনিকতার অনুপস্থিতি। গণতন্ত্র কী, গণতন্ত্রায়ণের পথ ও পদ্ধতি কী--এই সংক্রান্ত কোনো সুস্পষ্ট দার্শনিক ও প্রায়োগিক বোঝাপড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেই। গণতন্ত্র এবং এই জাতীয় শব্দ ও ভাবকে তারা অতিমাত্রায় ব্যবহার করে স্রেফ ‘রাজনৈতিক পরিভাষা’ হিসেবে। গণশক্তির ওপর তাদের যদি শ্রদ্ধা থাকত তাহলে গণতন্ত্রও থাকত।

জুলাই অভ্যুত্থানের জনতার উল্লাস। সংগৃহীত ছবি
জুলাই অভ্যুত্থানের জনতার উল্লাস। সংগৃহীত ছবি

‘বাংলাদেশি গণতন্ত্রে’র যে মডেল তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হয় গণতন্ত্রের অর্থ হলো : ক. দীর্ঘমেয়াদে অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় থাকা; খ. জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা; গ. বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা; ঘ. বিরোধী দলকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা; ঙ. নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করা; চ. সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা; ছ. গণমাধ্যমকে অনুগত প্রচারযন্ত্রে পরিণত করা। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও প্রসঙ্গ যোগ করা যাবে। সব কিছু মিলিয়ে ‘বাংলাদেশি গণতন্ত্র’ আসলে কর্তৃত্ববাদ।

আর তাই গণতন্ত্রের যেকোনো মডেল থেকে ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ, পিছিয়ে পড়েছে গণতন্ত্রসূচকে। নাগরিক স্বাধীনতা, নির্বাচনী বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সরকারের কার্যকারিতা–ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্রবিষয়ক প্রতিটি বর্গ বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ।

তবুও আশা জাগে। ১৯৪৭, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪ সময়ের এই সিঁড়িগুলো পেরিয়েই বাংলাদেশ। প্রতিটি পর্বে আমরা দেখব, জনতা সেই নেতা ও দলকে নির্বাচন করতে চেয়েছে যে হবে তার জীবনের ভালোমন্দের অংশীদার। এই বিশ্বাস থেকে দিয়েছে ভোট ও সমর্থন। কিন্তু প্রতিটিবার শাসনের সুকঠিন দেয়ালে ঘা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে স্বপ্ন। ২০২৪-এর পর বাংলাদেশের মানুষ আবারও আশায় বুক বেঁধেছে। জনগণ আবারও ক্ষমতায়িত হতে চাইছে। বলা যায়, গণতন্ত্রের গল্প এখানে ফুরায় না। হয়তো গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হবে অন্য কোনো গল্প।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক; কবি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত