সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ অভিযোগ করেছে বলেছে, অবৈধ বাংলাদেশি বাসিন্দারা ‘বাংলা’ নয়, ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় কথা বলে। পুলিশের এই অভিযোগের সমালোচনায় মুখর হয়ে সাধারণ ভারতীয় থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত। এমনকি এই ভাষার রাজনীতি নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন ভারতীয় লেখক অরিঘ্ন গুপ্ত। তাঁর লেখাটি স্ট্রিম পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
স্ট্রিম ডেস্ক
সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ এক দাবি তুলেছে। তাদের মামলার নথিতে লেখা হয়েছে—অবৈধ বাংলাদেশি বাসিন্দারা ‘বাংলা’ নয়, ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় কথা বলে। এর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে ডানপন্থী, অন্যদিকে প্রগতিশীল বাঙালি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ঘটনাকে ‘অপমানজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য উল্টো দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশি’ ভাষা বাংলা থেকে আলাদা। তাঁর মতে, বাংলাদেশের কথ্য ভাষা ভিন্ন, সিলেটি উপভাষা ভারতীয় বাঙালির কাছে প্রায় দুর্বোধ্য। আসলে ‘বেঙ্গলি’ একক ভাষা নয়, কেবল একটি জাতিসত্তা।
এই বাক্য বিভাজনের আড়ালে রয়েছে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের ভাঙন—জাতপাত, শ্রেণি ও সাম্প্রদায়িকতা। ডানপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনীতি এই বিভাজনকে টিকিয়ে রেখেছে।
‘বাংলাদেশি’ বা ‘মুসলমানি-বাংলা’ নামে কৃত্রিম শ্রেণিবিন্যাসের শিকড় রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগে। তখন বাঙালি অভিজাতরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে এই বিভাজনের বীজ বপন করেছিলেন। আজ তা নাগরিকত্ব ও অধিকারের প্রশ্নে অ-শহুরে ও অ-উচ্চবর্ণ বাংলাভাষীদের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে।
মূল অপরাধী মুসলমানি-বাংলা নয়। সমস্যা হলো এক পরিশোধিত, সংস্কৃতনির্ভর উপনিবেশিক ভাষা—সাধুভাষা। আরবি, ফারসি ও কথ্য বাংলার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন এই ভাষাই প্রগতিশীল বাংলার রাজনীতির মানদণ্ড হয়ে উঠেছিল।
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা নিয়ে রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় নতুন নয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন একসময় পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে বাধ্য করেছিল। ফলে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এই সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা উর্দুকে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে শহীদ হন।
ভারতের প্রগতিশীল বাঙালিরা এই আন্দোলনকে বাংলা ভাষার জয় হিসেবে উদ্যাপন করেছিলেন। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের প্রগতিশীল রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক তেমন ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকারীরা চাইছিলেন নিজেদের দৈনন্দিন জীবন বাংলায় চালাতে, উর্দুতে নয়। একই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র বাঙালি পরিচয় ঘোষণা করেছিলেন—প্রথমে ভারত থেকে, পরে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার দাবি নিয়েই।
কিন্তু ভারতের প্রগতিশীল বাঙালির কাছে এই জয় মানে ছিল তাদের নিজস্ব ‘বাঙালি ইতিহাসের’ জয়। সেই ইতিহাস মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্যক্তিত্বদের দ্বারা গড়ে তোলা। ফলে বাঙালিত্ব উদ্যাপিত হতো শুধু তখনই, যখন তা মুসলিম, দলিত বা অন্য কোনো পরিচয়ের রঙ ছাড়া এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।
তাহলে প্রশ্ন আসে—কেন ভারতীয় বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ মাধ্যম হয়ে উঠল? কেন সেখানে ধর্ম, জাতপাত বা শ্রেণিগত ভেদাভেদকে উপেক্ষা করা হলো?
‘বাংলাদেশি’ বা ‘মুসলমানি-বাংলা’ কী?
বাংলার মুসলিম রূপ বা কথিত ‘বাংলাদেশি ভাষা’-র প্রতি বিতৃষ্ণা বহুদিনের। ইতিহাস দেখায়, এটি উপনিবেশিক যুগে শুরু। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রেভারেন্ড জেমস লং প্রথম ব্যবহার করেন ‘মুসলমানি-বাংলা’ শব্দটি। ইতিহাসবিদ অনিন্দিতা ঘোষ বলেন, তখন এটি দিয়ে বোঝাতো ‘রুচিহীন মুসলিম মাঝিদের ভাষা’—নিম্নশ্রেণির সাহিত্য।
পরে এই বিষয়টি একাডেমিক আলোচনায় জায়গা পায়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে অনেক গবেষক এটিকে গ্রহণ করেছেন। যেমন সুকুমার সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও রফিউদ্দিন আহমেদ। রফিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, মুসলমানি-বাংলা ছিল ঔপনিবেশিক যুগের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের ভাষা। পূর্ব-ঔপনিবেশিক উদার সংস্কৃতি থেকে তারা সরে এসেছিল।
এই গবেষকের মতে, আগের মুসলিম লেখকরা ‘ঈশ্বর’ ব্যবহার করলেও ঔপনিবেশিক যুগে ‘আল্লাহ’ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। মুসলিম বাংলা সংস্কৃতির ধারণা তৈরি হয় এই ভিত্তিতে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মধ্যযুগীয় মুসলিম লেখকরা কেবল ‘ঈশ্বর’ ব্যবহার করেননি। তারা ইসলামী দার্শনিক ধারণাকে বৈষ্ণবসহ অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মিশিয়েছেন। বহুভাষিক জগতে ইসলামকে বাংলায় ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে। টনি কে. স্টুয়ার্ট একে বলেছেন সংযোগ গড়ার প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে মুসলিমত্ব হারায়নি।
আজকের প্রগতিশীল বাঙালি বৃত্তে একটি দ্বৈত ধারণা আছে—সুফিদেরকে ‘কম মুসলিম’, সংস্কারককে ‘বেশি মুসলিম’ হিসেবে দেখা হয়। থিবো দ্যুবের্ত ও আয়েশা এ. ইরানি দেখিয়েছেন, আলাওল (১৬০৭–৮০) ও সৈয়দ সুলতান (১৫৫০–১৬৪৮) গভীর ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম হলেও অমুসলিম দর্শনের সঙ্গে সমান বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে যুক্ত ছিলেন।
উনবিংশ শতকের শেষে রফিউদ্দিন আহমেদ মুসলমানি-বাংলাকে ইসলামীকরণের জন্য ‘মোল্লা’দের দায়ী করেছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দাবলী বহু আগে থেকেই ছিল—হিন্দু-মুসলিম উভয় লেখকের রচনায়। সুকুমার সেনও লিখেছেন, শব্দ ব্যবহারে লেখকের ধর্ম নির্ধারণ করা যায় না।
মধ্যযুগ ও ঔপনিবেশিক শুরুর সময়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের লেখক দ্বিভাষী বাংলায় লিখেছেন। ফলে বাংলা ভাষা আরবি-ফারসি শৈলী সমৃদ্ধ হয়। উদাহরণ—পঞ্চদশ শতকের বিপ্রদাস পিপলাই ও সপ্তদশ শতকের দ্বিজ গিরিধর।
কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, আঠারো শতকে মুঘল ও নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু লিপিকাররা ফারসি শব্দ ও রীতি বাংলায় প্রচলিত করেছিলেন। ভরতচন্দ্র রায় (১৭১২–৬০) রচনা করেছিলেন অন্নদামঙ্গল, যা ফারসী ধাঁচের বাংলা কাব্যের নিদর্শন।
মোটকথা, মুসলমানি-বাংলা ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত একটি শব্দ। মাঝিদের সাহিত্য, ফারসি-আরবি কবিতা, কোরান আশ্রিত সাহিত্য, দরবারি সাহিত্য ও ইসলামী সংস্কার—সবই এর আওতায় পড়ে। শব্দটি তৈরি হয়েছিল কথ্য বাংলার প্রতি অভিজাতদের অনীহা থেকে। উপনিবেশিক ও উচ্চবর্ণ বাঙালিরা এটি বারবার ব্যবহার করেছেন। আজকের ডানপন্থী হিন্দু ও মুসলিম মতাদর্শীরাও একই শব্দ একইভাবে ব্যবহার করছেন।
সংস্কৃতনির্ভর সাধুভাষা
‘মুসলমানি-বাংলা’ নিয়ে আলোচনায় আসল অপরাধীকে প্রায়ই আড়াল করা হয়। সেটি হলো উচ্চবর্ণীয়, শুদ্ধীকৃত বাংলা—যাকে বলা হয় সাধুভাষা।
ঊনবিংশ শতকে গড়ে ওঠা এই সাধুভাষা বাংলাকে তার বহুমুখী উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে। দাঁড় করায় একরকম পরিশুদ্ধ রূপ। অনিন্দিতা ঘোষ লিখেছেন, ‘সাধু বা ভদ্র ভাষার শব্দভাণ্ডার তৈরি হয়েছিল মূলত তৎসম সংস্কৃত শব্দ দিয়ে। অন্যদিকে চলিত ভাষা গড়ে উঠেছিল তদ্ভব, অ-সংস্কৃত, দেশজ ও বিদেশি শব্দে।’
তিনি আরও বলেছেন, উত্তর ভারতে হিন্দি-উর্দু বিভাজন রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠার আগে, মিশনারি ও বাঙালি অভিজাতরা বাংলাকে ‘কৃত্রিমভাবে সংস্কৃতায়িত’ করতে শুরু করেছিলেন। এই নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা’ ঔপনিবেশিক বিরোধী গর্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। কিন্তু একই সঙ্গে তাতে সাধারণ বাংলাভাষীর দৈনন্দিন কথ্যরীতি উপেক্ষিত হয়।
এই একরৈখিক সাধুভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছিল। প্রথম বাঙালি নারী আত্মজীবনীকার হিসেবে পরিচিত রাসসুন্দরী দেবী (১৮০৯–৯৯) সচেতনভাবে এই শুদ্ধ ভাষায় লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি লিখেছেন চলিত বাংলায়—উনবিংশ শতকের মধ্যভাগের মানুষের দৈনন্দিন কথ্যভাষায়।
প্রগতিশীল বাঙালি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা
ডানপন্থীদের চোখে ‘বাংলাদেশি’ ধারণার বিপরীতে প্রগতিশীলরা বলেন, বাংলা ভাষা অনেক বিস্তৃত। এই ভাষা সব বৈচিত্র্যকে জায়গা দেয়। কিন্তু এই ধারণাও আংশিক মিথ। একে প্রশ্ন করা জরুরি।
ভাবুন, দুজন উচ্চবর্ণের ভারতীয় বাঙালি বেঙ্গালুরু বা লন্ডনে দেখা করলেন। বাঙালি হিসেবেই পরিচিত তারা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন আসে, ‘আপনি কোথাকার?’
শুধু ‘বাঙালি’ পরিচয় যথেষ্ট নয়। আসল পরিচয় পরীক্ষা চলতেই থাকে। যতক্ষণ না কেউ প্রমাণ করে যে সে ‘খাঁটি কলকাত্তাইয়া’, ততক্ষণ তাকে ভদ্র বাঙালি বলে মেনে নেওয়া হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের ডানপন্থীরা এই বিভাজন কাজে লাগিয়েছে। তারা চায় ভিন্ন বাংলা বলা জনগোষ্ঠীকে ‘বাহিরের লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে। তাই শুধু ‘আমরা সবাই বাঙালি’ বলা যথেষ্ট নয়।
বাংলা সংস্কৃতিতে আছে নানা স্তর, বিভাজন ও অসমতা। তাই ভাষার ভিন্নতা স্বীকার করতে হবে। তখনই সহমর্মিতার জায়গা তৈরি হবে। কেবল তখনই ভাষা ও পরিচয় একরঙা করে অন্যকে মুছে ফেলা হবে না।
অমিত মালব্যর গবেষণায় সিলেটি ভাষাকে ‘অবাংলা’ বলা হয়েছে। যারা এই ভাষায় কথা বলেন, তাদের ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সিলেটি নিজস্ব ইতিহাস ও ভাষাগত পরম্পরা আছে, অন্তত চতুর্দশ শতক থেকে। তাদের আলাদা লিপি, ছাপাখানা ও পাঠকসমাজও ছিল।
একজন সিলেটি যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি যদি সেখানকার মানুষ হন, বেড়ে ওঠেন, নাগরিক হন, তাহলে তাঁর ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব বহাল রাখতে হলে জোর করে ‘বাঙালি’ বা ‘আসামি’ পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই।
একই কথা উত্তরবঙ্গের আদিবাসী রাজবংশীদের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি তাদের ‘বিদেশি’ বলা হয়েছে। ‘বাঙালি’ বা ‘নেপালি (গুর্খা)’ পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ায় আদিবাসী, রাজবংশী, লেপচা, লামা, ভুটিয়া, বিহারি ও মারওয়ারি সম্প্রদায় ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়েছে।
বাংলা আধিপত্যের মূল্য
বাংলা ভাষা অনেক ছোট ভাষার মৃত্যুর জন্য দায়ী। ঊনবিংশ শতকে ঔপনিবেশিক সহায়তা ও উচ্চবর্ণীয় প্রভাবের কারণে সংস্কৃতনির্ভর শুদ্ধ বাংলা গড়ে ওঠে। এতে বাংলা আধিপত্যশালী হয়ে ওঠে।
বিশ শতকের শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলার কারণে কয়েকটি প্রান্তিক ভাষা হারিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ৩৮টি স্থানীয় ভাষার মধ্যে ১০টি ‘চরম বিপন্ন’। যেমন—শবর, গয়া, থারু, জলদা, অসুর, হেমল, বেদিয়া ও মগর। মগর ভাষায় কথা বলেন এরকম মাত্র একজন মানুষ আছেন।
এই ভাষিক বৈচিত্র্য হারানোর মূল কারণ বাংলা ও ‘বাংলাদেশি’ ভাষাকে ঘিরে রাজনীতি। ঔপনিবেশিক যুগে উচ্চবর্ণীয় বাংলা স্থানীয় ভাষাগুলোকেও প্রান্তিক করেছে। স্বাধীনতার পর অভিবাসীরা আদিবাসী ও আদি সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মুখে পড়ে। রাজনীতিতে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
অষ্টাদশ শতকে সিলেটে বাংলা-খাসি মিশ্র সম্প্রদায় ছিল। কিন্তু উপনিবেশিক নীতি ও উচ্চবর্ণীয় বসতি সেই ইতিহাসকে দ্বৈততায়, মানে মুসলিম বনাম হিন্দু, বাঙালি বনাম খাসি—এই পরিচয়ে নামিয়ে এনেছে।
আজ শিলং ও শিলচরে মিশ্র ইতিহাসের বদলে বাঙালিবিরোধী মনোভাব দেখা যায়। উত্তরবঙ্গের দুয়ার অঞ্চলে একক ‘বাংলা’ চাপানো হয়েছে। স্কুলে বাধ্যতামূলক হওয়ায় অ-স্থানীয় ভাষাভাষীরা প্রান্তিক হয়েছেন।
বাইনারির বাইরে
‘বাংলাদেশি’ (বা মুসলমানি-বাংলা) শব্দের ভুল সংজ্ঞা এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়—উভয়ই ভাষাকে বিভক্ত রাখে। ভাষার রাজনীতিকে নতুন পথে নিতে হলে বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে। ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে।
বাংলা ভাষা এত রকম স্তরে গড়ে উঠেছে যে তাকে শুধু এক ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাষা হিসেবে দাবি করা যায় না। উদাহরণ হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণে পালন করা হয়। কিন্তু সেই সংগ্রামের মুসলিম পরিচয়কে এড়িয়ে কেবল ‘বাঙালিত্ব’কে জোর দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংযুক্ত পরিচয় যেমন মুসলিম-বাঙালি বা রাজবংশী-বাঙালি এগুলো তো বহাল আছে। যারা নিজেদের এভাবে দেখতে চান, তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, কম স্তরবিন্যস্ত সাংস্কৃতিক জমিন থাকা উচিত।
বাংলার ভেতরের বৈচিত্র্যকেও মর্যাদা দেওয়া দরকার। একক শুদ্ধ বাংলা চাপিয়ে দেওয়ার বদলে উপভাষাগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কলকাতাইয়া-বাংলার সঙ্গে তুলনা করে প্রতিটি ভিন্ন উচ্চারণ বা বাক্যবন্ধকে হীন করা উচিত নয়। কারণ প্রতিটি ভিন্নতায় লুকিয়ে আছে জাতপাত, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের ইতিহাস। এগুলো মুছে ফেলার বদলে গবেষণা, নথিভুক্তি ও শিক্ষার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা জরুরি।
বাংলা ভাষা অসীম নয়। তার সীমা আছে। রাজবংশীদের মতো অনেক সম্প্রদায় নিজেদের ভাষা রক্ষা করতে চায়। এর মানেই যে তারা বাঙালিদের প্রতি কম সহমর্মী, এমন নয়। বরং পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেওয়া ঐক্য তৈরি করে। শুধুমাত্র ‘বাংলা’ চাপিয়ে দিলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে ফাটল গভীর হবে।
বাংলার ভাষানীতিতে একটি কাঠামো থাকা জরুরি। যাতে বিপন্ন ভাষাগুলো সংরক্ষণ করা যায়। একরূপীকরণের নীতি কেবল ব্যবধান আর শত্রুতা বাড়াবে। এতে কেউ ভোটের অধিকার হারাতে পারে। কারো বা ভোটার কমে যাবে। ভবিষ্যৎ কেবল ডানপন্থীদের বিভাজিত করবার রাজনীতি বা শাসকদলের ফাঁপা বাঙালি গর্বের মধ্যে আটকে থাকতে পারে না।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক
(দ্য প্রিন্ট থেকে অনুবাদ করেছেন হুমায়ূন শফিক)
সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ এক দাবি তুলেছে। তাদের মামলার নথিতে লেখা হয়েছে—অবৈধ বাংলাদেশি বাসিন্দারা ‘বাংলা’ নয়, ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় কথা বলে। এর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে ডানপন্থী, অন্যদিকে প্রগতিশীল বাঙালি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ঘটনাকে ‘অপমানজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য উল্টো দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশি’ ভাষা বাংলা থেকে আলাদা। তাঁর মতে, বাংলাদেশের কথ্য ভাষা ভিন্ন, সিলেটি উপভাষা ভারতীয় বাঙালির কাছে প্রায় দুর্বোধ্য। আসলে ‘বেঙ্গলি’ একক ভাষা নয়, কেবল একটি জাতিসত্তা।
এই বাক্য বিভাজনের আড়ালে রয়েছে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের ভাঙন—জাতপাত, শ্রেণি ও সাম্প্রদায়িকতা। ডানপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনীতি এই বিভাজনকে টিকিয়ে রেখেছে।
‘বাংলাদেশি’ বা ‘মুসলমানি-বাংলা’ নামে কৃত্রিম শ্রেণিবিন্যাসের শিকড় রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগে। তখন বাঙালি অভিজাতরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে এই বিভাজনের বীজ বপন করেছিলেন। আজ তা নাগরিকত্ব ও অধিকারের প্রশ্নে অ-শহুরে ও অ-উচ্চবর্ণ বাংলাভাষীদের জন্য বিপদ সৃষ্টি করছে।
মূল অপরাধী মুসলমানি-বাংলা নয়। সমস্যা হলো এক পরিশোধিত, সংস্কৃতনির্ভর উপনিবেশিক ভাষা—সাধুভাষা। আরবি, ফারসি ও কথ্য বাংলার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন এই ভাষাই প্রগতিশীল বাংলার রাজনীতির মানদণ্ড হয়ে উঠেছিল।
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা নিয়ে রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় নতুন নয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন একসময় পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে বাধ্য করেছিল। ফলে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এই সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা উর্দুকে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে শহীদ হন।
ভারতের প্রগতিশীল বাঙালিরা এই আন্দোলনকে বাংলা ভাষার জয় হিসেবে উদ্যাপন করেছিলেন। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের প্রগতিশীল রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক তেমন ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকারীরা চাইছিলেন নিজেদের দৈনন্দিন জীবন বাংলায় চালাতে, উর্দুতে নয়। একই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র বাঙালি পরিচয় ঘোষণা করেছিলেন—প্রথমে ভারত থেকে, পরে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার দাবি নিয়েই।
কিন্তু ভারতের প্রগতিশীল বাঙালির কাছে এই জয় মানে ছিল তাদের নিজস্ব ‘বাঙালি ইতিহাসের’ জয়। সেই ইতিহাস মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দু ব্যক্তিত্বদের দ্বারা গড়ে তোলা। ফলে বাঙালিত্ব উদ্যাপিত হতো শুধু তখনই, যখন তা মুসলিম, দলিত বা অন্য কোনো পরিচয়ের রঙ ছাড়া এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।
তাহলে প্রশ্ন আসে—কেন ভারতীয় বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ মাধ্যম হয়ে উঠল? কেন সেখানে ধর্ম, জাতপাত বা শ্রেণিগত ভেদাভেদকে উপেক্ষা করা হলো?
‘বাংলাদেশি’ বা ‘মুসলমানি-বাংলা’ কী?
বাংলার মুসলিম রূপ বা কথিত ‘বাংলাদেশি ভাষা’-র প্রতি বিতৃষ্ণা বহুদিনের। ইতিহাস দেখায়, এটি উপনিবেশিক যুগে শুরু। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রেভারেন্ড জেমস লং প্রথম ব্যবহার করেন ‘মুসলমানি-বাংলা’ শব্দটি। ইতিহাসবিদ অনিন্দিতা ঘোষ বলেন, তখন এটি দিয়ে বোঝাতো ‘রুচিহীন মুসলিম মাঝিদের ভাষা’—নিম্নশ্রেণির সাহিত্য।
পরে এই বিষয়টি একাডেমিক আলোচনায় জায়গা পায়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে অনেক গবেষক এটিকে গ্রহণ করেছেন। যেমন সুকুমার সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও রফিউদ্দিন আহমেদ। রফিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, মুসলমানি-বাংলা ছিল ঔপনিবেশিক যুগের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের ভাষা। পূর্ব-ঔপনিবেশিক উদার সংস্কৃতি থেকে তারা সরে এসেছিল।
এই গবেষকের মতে, আগের মুসলিম লেখকরা ‘ঈশ্বর’ ব্যবহার করলেও ঔপনিবেশিক যুগে ‘আল্লাহ’ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। মুসলিম বাংলা সংস্কৃতির ধারণা তৈরি হয় এই ভিত্তিতে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মধ্যযুগীয় মুসলিম লেখকরা কেবল ‘ঈশ্বর’ ব্যবহার করেননি। তারা ইসলামী দার্শনিক ধারণাকে বৈষ্ণবসহ অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মিশিয়েছেন। বহুভাষিক জগতে ইসলামকে বাংলায় ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে। টনি কে. স্টুয়ার্ট একে বলেছেন সংযোগ গড়ার প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে মুসলিমত্ব হারায়নি।
আজকের প্রগতিশীল বাঙালি বৃত্তে একটি দ্বৈত ধারণা আছে—সুফিদেরকে ‘কম মুসলিম’, সংস্কারককে ‘বেশি মুসলিম’ হিসেবে দেখা হয়। থিবো দ্যুবের্ত ও আয়েশা এ. ইরানি দেখিয়েছেন, আলাওল (১৬০৭–৮০) ও সৈয়দ সুলতান (১৫৫০–১৬৪৮) গভীর ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম হলেও অমুসলিম দর্শনের সঙ্গে সমান বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে যুক্ত ছিলেন।
উনবিংশ শতকের শেষে রফিউদ্দিন আহমেদ মুসলমানি-বাংলাকে ইসলামীকরণের জন্য ‘মোল্লা’দের দায়ী করেছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দাবলী বহু আগে থেকেই ছিল—হিন্দু-মুসলিম উভয় লেখকের রচনায়। সুকুমার সেনও লিখেছেন, শব্দ ব্যবহারে লেখকের ধর্ম নির্ধারণ করা যায় না।
মধ্যযুগ ও ঔপনিবেশিক শুরুর সময়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের লেখক দ্বিভাষী বাংলায় লিখেছেন। ফলে বাংলা ভাষা আরবি-ফারসি শৈলী সমৃদ্ধ হয়। উদাহরণ—পঞ্চদশ শতকের বিপ্রদাস পিপলাই ও সপ্তদশ শতকের দ্বিজ গিরিধর।
কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, আঠারো শতকে মুঘল ও নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু লিপিকাররা ফারসি শব্দ ও রীতি বাংলায় প্রচলিত করেছিলেন। ভরতচন্দ্র রায় (১৭১২–৬০) রচনা করেছিলেন অন্নদামঙ্গল, যা ফারসী ধাঁচের বাংলা কাব্যের নিদর্শন।
মোটকথা, মুসলমানি-বাংলা ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত একটি শব্দ। মাঝিদের সাহিত্য, ফারসি-আরবি কবিতা, কোরান আশ্রিত সাহিত্য, দরবারি সাহিত্য ও ইসলামী সংস্কার—সবই এর আওতায় পড়ে। শব্দটি তৈরি হয়েছিল কথ্য বাংলার প্রতি অভিজাতদের অনীহা থেকে। উপনিবেশিক ও উচ্চবর্ণ বাঙালিরা এটি বারবার ব্যবহার করেছেন। আজকের ডানপন্থী হিন্দু ও মুসলিম মতাদর্শীরাও একই শব্দ একইভাবে ব্যবহার করছেন।
সংস্কৃতনির্ভর সাধুভাষা
‘মুসলমানি-বাংলা’ নিয়ে আলোচনায় আসল অপরাধীকে প্রায়ই আড়াল করা হয়। সেটি হলো উচ্চবর্ণীয়, শুদ্ধীকৃত বাংলা—যাকে বলা হয় সাধুভাষা।
ঊনবিংশ শতকে গড়ে ওঠা এই সাধুভাষা বাংলাকে তার বহুমুখী উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে। দাঁড় করায় একরকম পরিশুদ্ধ রূপ। অনিন্দিতা ঘোষ লিখেছেন, ‘সাধু বা ভদ্র ভাষার শব্দভাণ্ডার তৈরি হয়েছিল মূলত তৎসম সংস্কৃত শব্দ দিয়ে। অন্যদিকে চলিত ভাষা গড়ে উঠেছিল তদ্ভব, অ-সংস্কৃত, দেশজ ও বিদেশি শব্দে।’
তিনি আরও বলেছেন, উত্তর ভারতে হিন্দি-উর্দু বিভাজন রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠার আগে, মিশনারি ও বাঙালি অভিজাতরা বাংলাকে ‘কৃত্রিমভাবে সংস্কৃতায়িত’ করতে শুরু করেছিলেন। এই নতুন ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা’ ঔপনিবেশিক বিরোধী গর্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। কিন্তু একই সঙ্গে তাতে সাধারণ বাংলাভাষীর দৈনন্দিন কথ্যরীতি উপেক্ষিত হয়।
এই একরৈখিক সাধুভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছিল। প্রথম বাঙালি নারী আত্মজীবনীকার হিসেবে পরিচিত রাসসুন্দরী দেবী (১৮০৯–৯৯) সচেতনভাবে এই শুদ্ধ ভাষায় লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি লিখেছেন চলিত বাংলায়—উনবিংশ শতকের মধ্যভাগের মানুষের দৈনন্দিন কথ্যভাষায়।
প্রগতিশীল বাঙালি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা
ডানপন্থীদের চোখে ‘বাংলাদেশি’ ধারণার বিপরীতে প্রগতিশীলরা বলেন, বাংলা ভাষা অনেক বিস্তৃত। এই ভাষা সব বৈচিত্র্যকে জায়গা দেয়। কিন্তু এই ধারণাও আংশিক মিথ। একে প্রশ্ন করা জরুরি।
ভাবুন, দুজন উচ্চবর্ণের ভারতীয় বাঙালি বেঙ্গালুরু বা লন্ডনে দেখা করলেন। বাঙালি হিসেবেই পরিচিত তারা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন আসে, ‘আপনি কোথাকার?’
শুধু ‘বাঙালি’ পরিচয় যথেষ্ট নয়। আসল পরিচয় পরীক্ষা চলতেই থাকে। যতক্ষণ না কেউ প্রমাণ করে যে সে ‘খাঁটি কলকাত্তাইয়া’, ততক্ষণ তাকে ভদ্র বাঙালি বলে মেনে নেওয়া হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের ডানপন্থীরা এই বিভাজন কাজে লাগিয়েছে। তারা চায় ভিন্ন বাংলা বলা জনগোষ্ঠীকে ‘বাহিরের লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে। তাই শুধু ‘আমরা সবাই বাঙালি’ বলা যথেষ্ট নয়।
বাংলা সংস্কৃতিতে আছে নানা স্তর, বিভাজন ও অসমতা। তাই ভাষার ভিন্নতা স্বীকার করতে হবে। তখনই সহমর্মিতার জায়গা তৈরি হবে। কেবল তখনই ভাষা ও পরিচয় একরঙা করে অন্যকে মুছে ফেলা হবে না।
অমিত মালব্যর গবেষণায় সিলেটি ভাষাকে ‘অবাংলা’ বলা হয়েছে। যারা এই ভাষায় কথা বলেন, তাদের ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সিলেটি নিজস্ব ইতিহাস ও ভাষাগত পরম্পরা আছে, অন্তত চতুর্দশ শতক থেকে। তাদের আলাদা লিপি, ছাপাখানা ও পাঠকসমাজও ছিল।
একজন সিলেটি যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি যদি সেখানকার মানুষ হন, বেড়ে ওঠেন, নাগরিক হন, তাহলে তাঁর ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব বহাল রাখতে হলে জোর করে ‘বাঙালি’ বা ‘আসামি’ পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই।
একই কথা উত্তরবঙ্গের আদিবাসী রাজবংশীদের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি তাদের ‘বিদেশি’ বলা হয়েছে। ‘বাঙালি’ বা ‘নেপালি (গুর্খা)’ পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ায় আদিবাসী, রাজবংশী, লেপচা, লামা, ভুটিয়া, বিহারি ও মারওয়ারি সম্প্রদায় ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়েছে।
বাংলা আধিপত্যের মূল্য
বাংলা ভাষা অনেক ছোট ভাষার মৃত্যুর জন্য দায়ী। ঊনবিংশ শতকে ঔপনিবেশিক সহায়তা ও উচ্চবর্ণীয় প্রভাবের কারণে সংস্কৃতনির্ভর শুদ্ধ বাংলা গড়ে ওঠে। এতে বাংলা আধিপত্যশালী হয়ে ওঠে।
বিশ শতকের শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলার কারণে কয়েকটি প্রান্তিক ভাষা হারিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ৩৮টি স্থানীয় ভাষার মধ্যে ১০টি ‘চরম বিপন্ন’। যেমন—শবর, গয়া, থারু, জলদা, অসুর, হেমল, বেদিয়া ও মগর। মগর ভাষায় কথা বলেন এরকম মাত্র একজন মানুষ আছেন।
এই ভাষিক বৈচিত্র্য হারানোর মূল কারণ বাংলা ও ‘বাংলাদেশি’ ভাষাকে ঘিরে রাজনীতি। ঔপনিবেশিক যুগে উচ্চবর্ণীয় বাংলা স্থানীয় ভাষাগুলোকেও প্রান্তিক করেছে। স্বাধীনতার পর অভিবাসীরা আদিবাসী ও আদি সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মুখে পড়ে। রাজনীতিতে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
অষ্টাদশ শতকে সিলেটে বাংলা-খাসি মিশ্র সম্প্রদায় ছিল। কিন্তু উপনিবেশিক নীতি ও উচ্চবর্ণীয় বসতি সেই ইতিহাসকে দ্বৈততায়, মানে মুসলিম বনাম হিন্দু, বাঙালি বনাম খাসি—এই পরিচয়ে নামিয়ে এনেছে।
আজ শিলং ও শিলচরে মিশ্র ইতিহাসের বদলে বাঙালিবিরোধী মনোভাব দেখা যায়। উত্তরবঙ্গের দুয়ার অঞ্চলে একক ‘বাংলা’ চাপানো হয়েছে। স্কুলে বাধ্যতামূলক হওয়ায় অ-স্থানীয় ভাষাভাষীরা প্রান্তিক হয়েছেন।
বাইনারির বাইরে
‘বাংলাদেশি’ (বা মুসলমানি-বাংলা) শব্দের ভুল সংজ্ঞা এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়—উভয়ই ভাষাকে বিভক্ত রাখে। ভাষার রাজনীতিকে নতুন পথে নিতে হলে বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে। ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে।
বাংলা ভাষা এত রকম স্তরে গড়ে উঠেছে যে তাকে শুধু এক ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাষা হিসেবে দাবি করা যায় না। উদাহরণ হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণে পালন করা হয়। কিন্তু সেই সংগ্রামের মুসলিম পরিচয়কে এড়িয়ে কেবল ‘বাঙালিত্ব’কে জোর দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংযুক্ত পরিচয় যেমন মুসলিম-বাঙালি বা রাজবংশী-বাঙালি এগুলো তো বহাল আছে। যারা নিজেদের এভাবে দেখতে চান, তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, কম স্তরবিন্যস্ত সাংস্কৃতিক জমিন থাকা উচিত।
বাংলার ভেতরের বৈচিত্র্যকেও মর্যাদা দেওয়া দরকার। একক শুদ্ধ বাংলা চাপিয়ে দেওয়ার বদলে উপভাষাগুলোকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কলকাতাইয়া-বাংলার সঙ্গে তুলনা করে প্রতিটি ভিন্ন উচ্চারণ বা বাক্যবন্ধকে হীন করা উচিত নয়। কারণ প্রতিটি ভিন্নতায় লুকিয়ে আছে জাতপাত, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের ইতিহাস। এগুলো মুছে ফেলার বদলে গবেষণা, নথিভুক্তি ও শিক্ষার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা জরুরি।
বাংলা ভাষা অসীম নয়। তার সীমা আছে। রাজবংশীদের মতো অনেক সম্প্রদায় নিজেদের ভাষা রক্ষা করতে চায়। এর মানেই যে তারা বাঙালিদের প্রতি কম সহমর্মী, এমন নয়। বরং পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেওয়া ঐক্য তৈরি করে। শুধুমাত্র ‘বাংলা’ চাপিয়ে দিলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে ফাটল গভীর হবে।
বাংলার ভাষানীতিতে একটি কাঠামো থাকা জরুরি। যাতে বিপন্ন ভাষাগুলো সংরক্ষণ করা যায়। একরূপীকরণের নীতি কেবল ব্যবধান আর শত্রুতা বাড়াবে। এতে কেউ ভোটের অধিকার হারাতে পারে। কারো বা ভোটার কমে যাবে। ভবিষ্যৎ কেবল ডানপন্থীদের বিভাজিত করবার রাজনীতি বা শাসকদলের ফাঁপা বাঙালি গর্বের মধ্যে আটকে থাকতে পারে না।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক
(দ্য প্রিন্ট থেকে অনুবাদ করেছেন হুমায়ূন শফিক)
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, কোনো তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই ভারত সরকার ও ভারতীয় গণমাধ্যম এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং দাবি করে দুই হামলাকারী পাকিস্তানের নাগরিক।
৩ দিন আগে১৯৬৭ সালের পর থেকে প্রতিটি ইসরায়েলি সরকার দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় বসতি সম্প্রসারণ করেছে এবং ইহুদি নাগরিকদের পশ্চিম তীরে স্থানান্তর করতে আর্থিক সুবিধা ও অবকাঠামো উন্নয়নে উৎসাহিত করেছে।
৩ দিন আগেফিলিস্তিন কেবল এক যুদ্ধক্ষেত্রই নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্ব এখনো তাদের ঔপনিবেশিক অতীতের সত্য দেখতে পারে এমন শেষ আয়না। তাই এই আয়নাটিকেই ভেঙে ফেলা চাই।
৪ দিন আগেএক বছর আগে, এই মাসেই, বাংলাদেশের সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাজারো শিক্ষার্থী অসংখ্য সাধারণ মানুষের সমর্থনে আমাদের জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্মম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল। অবশেষে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা ৫ আগস্ট এক স্বৈরাচারীকে দেশত্যাগ
৫ দিন আগে