leadT1ad

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনায় বিশ্ব নেতাদের সমর্থন, সমালোচকদের সন্দেহ

বিজয়া জয়ারত্নম
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ১৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

বিশ্বের অনেক দেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২১-পদক্ষেপের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে। এই প্রস্তাবের লক্ষ্য প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শেষ করা এবং গাজা স্ট্রিপ পুনর্গঠন করা। তবে বিশ্লেষকরা প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ নিয়ে সন্দিহান।

ট্রাম্প সোমবার এই প্রস্তাব ঘোষণা করেন। এতে হামাসকে আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্র ত্যাগ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গাজা থেকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক সংস্থা গঠন করা হবে, যা ট্রাম্প ও সাবেক যুক্তরাজ্য প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। এ ছাড়া একটি নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করা হবে। এই বাহিনী ইসরায়েলি দখলাধীন এলাকায় দায়িত্ব নেবে এবং ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। তবে এর মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় হামলা বৃদ্ধি করছে। মঙ্গলবার অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন, জানিয়েছে আল জাজিরা। পশ্চিম তীরে আংশিক শাসনকারী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ট্রাম্পের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রশাসনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। হামাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যস্থতাকারী দেশ মিশর ও কাতারের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করবে।

প্রস্তাবটি এসেছে দীর্ঘমেয়াদি স্থগিত অস্ত্রবিরতি ও গাজার ওপর ইসরায়েলের বোমা হামলার আন্তর্জাতিক নিন্দার মাঝে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্বাধীন পর্যবেক্ষণের অভাবে, মানবিক সংস্থা, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে। তবে এই পরিসংখ্যান নাগরিক ও যোদ্ধার মধ্যে পার্থক্য দেখায় না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী ফিলিস্তিনি নাগরিকের মৃত্যুহার ৮৩ শতাংশ।

যুদ্ধটি শুরু হয় ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর। এতে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নাগরিক ও যোদ্ধা উভয়ই রয়েছে।

বিশ্বনেতারা কী বলছেন

অনেক বিশ্বনেতা এই প্রস্তাবকে ইতিমধ্যেই স্বাগত জানিয়েছেন এবং হামাসকে তা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক্স পোস্টে বলেছেন, তিনি ট্রাম্পের ‘গাজায় যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি এবং সব জিম্মিদের মুক্ত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশা করি ইসরায়েল এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসবে। হামাসের কোনো বিকল্প নেই, তারা তৎক্ষণাৎ সব জিম্মিদের মুক্ত করবে এবং এই পরিকল্পনা অনুসরণ করবে। এই পদক্ষেপগুলো অঞ্চলটিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাসঙ্গিক সব পক্ষের সঙ্গে গভীর আলোচনা চালানোর পথ খুলে দেবে। এই আলোচনা হতে হবে দুই-রাষ্ট্র সমাধান ও ১৪২টি জাতিসংঘ সদস্য দেশের নীতির ওপর ভিত্তি করে।’

এই মাসের শুরুতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মাল্টা ও পর্তুগালের সঙ্গে মিলিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারও প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা সব পক্ষকে একত্রিত হওয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি। হামাস এখন প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আঘাত বন্ধ করবে, অস্ত্র ত্যাগ করবে এবং অবশিষ্ট সব কবরবন্দি মুক্ত করবে।’

ইসরায়েলের কঠোর সমালোচক স্পেনের প্রেসিডেন্ট পেদ্রো সানচেজ এক্সে লিখেছেন, ‘স্পেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারিত গাজার শান্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানাচ্ছে। ... দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পথে এগিয়ে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিন শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে পাশাপাশি বাঁচুক। এটাই একমাত্র সম্ভবপর সমাধান।’

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, এই ‘উদ্যমী’ প্রস্তাব স্থায়ী অস্ত্রবিরতির দিকে একটি ‘মাইলফলক’ হতে পারে। তিনি হামাসকে এর শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্চ এই প্রস্তাবকে যুদ্ধ বন্ধ করার ‘সর্বোত্তম সুযোগ’ হিসেবে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার তিনি হামাসের হেফাজতে থাকা জার্মান জিম্মিদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মঙ্গলবার বলেছেন, ট্রাম্পের প্রস্তাব ‘ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি জনগণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের একটি বাস্তবসম্মত পথ প্রদান করবে। পাশাপাশি বৃহত্তর পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের জন্যও তা প্রযোজ্য।’

কাতার, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও যৌথ বিবৃতিতে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। বিবৃতিতে প্রস্তাবের শর্তগুলো ‘ফিলিস্তিনি জনগণের উৎখাত রোধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা’ করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া বিবৃতিতে গাজায় যথেষ্ট মানবিক সহায়তা অবাধে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য ইসরায়েলের সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের গুরুত্বকেও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা গাজা পশ্চিম তীরের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত হয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার পক্ষেও সমর্থন জানিয়েছেন।

সমালোচকদের সন্দেহ

তবে কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, ট্রাম্পের প্রস্তাব মূলত ইসরায়েলের পক্ষে এবং এতে কিছু শর্ত রয়েছে যা হামাসের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

ওয়াশিংটনের আরব সেন্টারের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসেফ মুনায়ের ব্লুমবার্গকে বলেছেন, ‘এটি মূলত গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকা-প্রযোজিত রাজনৈতিক নাটক।’

কিছু ইসরায়েলি কর্মকর্তাও এ বিষয়ে একই মত প্রকাশ করেছেন। নেসেট সদস্য মোশে সাডা জিউইশ নিউজ সিন্ডিকেটকে বলেছেন, প্রস্তাবে হামাসের জন্য এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে ‘আমরা জানি যা তারা মানতে পারবে না। যেমন সব জিম্মিদের বিনা শর্তে মুক্ত করা এবং অস্ত্রসমর্পন করা।’ এইসব শর্ত মানলে ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে, গাজা সিটি দখল চালিয়ে যেতে সবুজ সংকেত দেওয়া হবে।

ইসরায়েলে অনেক কর্মকর্তা প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগ বলেছেন, এই পরিকল্পনা ‘জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যুদ্ধ শেষ করা এবং গাজা অঞ্চলে ও মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন অংশীদারিত্বের বাস্তব সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। আমি এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই এবং দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই।’

ইসরায়েলি ডেমোক্র্যাটস চেয়ারম্যান ইয়ায়ার গোলান বলেছেন, প্রস্তাবের প্রতি ‘পূর্ণ সমর্থন’ দেওয়া হবে, তবে ‘আমরা তখনই আনন্দ উদযাপন করব যখন সব জিম্মি ফিরে আসবে।’ ইসরায়েলি সংসদের স্পিকার আমির ওহানা সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের ছবি পোস্ট করে সমর্থন জানিয়েছেন।

এছাড়া, নেতানিয়াহুর গাজা বোমাবর্ষণকে সমালোচনা করা অনেক বিরোধী নেতারাও প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতার ও তুরস্কের চাপে প্রস্তাবটি হামাসের সমর্থন পেয়ে গেলেও এটি বাস্তবায়নের পথ এখনও অনেক দূরে। এই বছরের শুরুতে আগের এক যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে ইসরায়েল আবার সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, এই কথা ভুলে যাওয়ার উপায় নেই।

ইসরায়েল পলিসি ফোরামের প্রধান কর্মকর্তা মাইকেল কোপলউ এক্স পোস্টে বলেছেন, ‘ট্রাম্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই চুক্তি করতে চাইছেন। …এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো হামাসকে আলোচনায় বসানো আর ইসরায়েলের রাজনৈতিক জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা।’

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নামে দুই রাষ্ট্র গঠন করে সমস্যা সমাধানের পক্ষে জাতিসংঘ এবং অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ। কিন্তু কিছু ইসরায়েলি কর্মকর্তা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করেছেন। ইসরায়েলি যোগাযোগ মন্ত্রী শ্লোমো কারহি বলেছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিতে কখনও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না!’

প্রস্তাবের শর্তে উল্লেখ আছে, নির্দিষ্ট ‘শর্তাবলী মানা হলে’ ফিলিস্তিনিদের আত্মনির্ধারণ এবং রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা থাকবে। ইসরায়েলি সংসদ সদস্য হালেভি বলেছেন, ঠিক এই সম্ভাবনার কারণে চুক্তিটি বাস্তবসম্মত নয়।

নেতানিয়াহু তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে ভিডিওবার্তায় মঙ্গলবার বলেছেন, ‘গাজার অধিকাংশ অংশে’ ইসরায়েলি সেনা থাকবে। এই কথা চুক্তির প্রস্তাবের শর্তের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। কারণ প্রস্তাবে বলা হয়েছে ইসরায়েল গাজা দখল বা সংযুক্ত করতে পারবে না এবং ধাপে ধাপে সেনা প্রত্যাহার করবে।

কার্নেগি সিনিয়র ফেলো এবং প্রাক্তন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘নেতানিয়াহু চতুরভাবে খেলেছেন। ট্রাম্পের প্রস্তাবকে তিনি নিজের সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করছেন। হামাস যদি একমত হয়, তবুও আলোচনা, বিতর্ক এবং রাজনৈতিক লড়াই শেষ হতে সপ্তাহ বা মাস লাগবে। এর আগে স্পষ্ট ফলাফল পাওয়া যাবে না।’

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘আরব দেশগুলোর মধ্য থেকে আমাদের পক্ষে অনেক সমর্থক আছে। আমাদের ব্যাপক সমর্থন আছে ইউরোপীয়দের কাছ থেকেও।… কিছু বিষয় ঠিক করতে হবে। তবে ট্রাম্পকে যেমন আমি চিনি, অদম্য লোক তিনি। সবাইকে তিনি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবেন।’

ট্রাম্পের ২১-পদক্ষেপের গাজা পরিকল্পনাটি বিশ্ব নেতাদের প্রশংসা ও সমর্থন পেয়েছে, তবে বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ এখনো অনেক। যদিও ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ও শান্তিচেষ্টা সমর্থন করছে, তবে বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে সন্দিহান। হামাসের শর্তাবলী, ইসরায়েলের রাজনৈতিক জটিলতা এবং পূর্বের যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যর্থতা প্রস্তাব বাস্তবায়নকে জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাঝেও প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার রাজনৈতিক সংলাপ, বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ এবং প্রতিটি পক্ষের বাস্তব প্রতিশ্রুতি।

লেখক: সাংবাদিক, দ্য প্রিন্ট থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত