leadT1ad

ছাঁটাই-ওএসডি: কী হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকে

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
স্ট্রিম গ্রাফিক

আওয়ামী লীগের সময় ‘অস্বচ্ছ উপায়ে’ নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে ইসলামী ব্যাংকে ফের শুরু হয়েছে অস্থিরতা। গত শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পাঁচ হাজারের বেশি কর্মীর ওই পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তবে অংশ নেন ৫০০ জনেরও কম। এরপর পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া কর্মীদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি হয়। এ ছাড়া চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২০০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। গত রবি, সোম ও আজ মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিক্ষোভও করেছেন শাস্তির আওতায় আসা কর্মীরা।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ। তাঁরা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রুপের কর্ণধার এস আলমের এলাকা চট্টগ্রামের। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এস আলম গ্রুপকে সরিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। এরপর একাধিক নিরীক্ষায় এস আলমের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, সনদ জালিয়াতিসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

এমন পরিস্থিতিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়া চাকরি পাওয়াদের মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৮৫ জনের ‘বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষা নিতে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটি। তবে গত শনিবার ওই মূল্যায়ন পরীক্ষায় চার হাজার ৯৫৩ জনই অংশ নেননি। পরে তাঁদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে ব্যাংকটি। আর চাকরিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২০০ জনকে ছাঁটাই করা হয়।

ব্যাংকটির জনবল কত

এস আলম নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে ২০১৬ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকের জনবল ছিল ১৩ হাজার ৫৬৯ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ছিল ৭৭৬ জন। তবে বর্তমানে ব্যাংকটিতে থাকা প্রায় ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই চট্টগ্রাম বিভাগের।

ইসলামী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। অস্বচ্ছ উপায়ে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মীর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলার সাত হাজার ২২৪ জন, যাদের মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের নিজ উপজেলা পটিয়ার বাসিন্দাই ৪ হাজার ৫২৪ জন। এসব কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের সনদ আবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁদের একটি অংশ আবার সনদ জালিয়াতির কারণে বরখাস্ত হয়েছেন।

যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, এস আলমের গ্রামের বাড়ি ও চট্টগ্রামের অফিসে ইসলামী ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার জন্য বক্স বসানো হয়েছিল। এসব বক্সে জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়লেই তখন চাকরি জুটে যেত। পুরো প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হতো কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ছাড়াই।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কোনো জীবনবৃত্তান্ত পাঠালেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশেও বড় নিয়োগ হয়। এভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদেরই এখন যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

কী হবে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের

ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যাদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে, তাদের সবার যোগ্যতা যাচাই করা হবে। ব্যাংকে অযোগ্য কাউকে রাখা হবে না। যারা থাকতে চান, তাদের যোগ্য হয়ে থাকতে হবে। ব্যাংকিং পেশায় অযোগ্যরা থাকার ফলে এত অনিয়ম হয়েছে। সেবার মান খারাপ হয়েছে।

২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। স্ট্রিম গ্রাফিক
২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। স্ট্রিম গ্রাফিক

ব্যাংকটির মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দীন জসীম। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘নীতিমালা না মেনে যারা নিয়োগ পেয়েছিল, তাদের যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বড় অংশই সেখানে অংশ নেয়নি। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন কেউ যদি যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে পরীক্ষায় আবার অংশ নেওয়ার আবেদন করে, তা ইতিবাচকভাবে দেখা হবে। আমরা চাই যোগ্য কর্মকর্তারা ব্যাংকে থাকুক।’

ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা

দেশের অন্যতম বৃহত্তম মূলধনী প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি খাতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যাংক ছিল ইসলামী ব্যাংক। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ থাকলেও খেলাপি ঋণ ছিল না বললেই চলে। তবে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই অর্থনৈতিক সব সূচকে ব্যাংকটির পতন শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা ছাড়ায়, যা মোট ঋণের ৪২ দশমিক ২২ শতাংশ। ঋণের বিপরীতে মোট ৭৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকার প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংকটি রাখতে পারে মাত্র ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল ৬৯ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকের মুনাফায়ও ধস নেমেছে। ২০২৪ সালে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ছিল ১০৯ কোটি টাকা। অথচ এর আগের বছর ৬৩৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল বলে জানিয়েছিল ব্যাংকটি। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে নিট মুনাফা কমে ৫২৬ কোটি টাকা বা ৮৩ শতাংশ।

বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের অর্ধেক। এস আলম বা সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদের ইউনিটেক্স গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ৪৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নাবিল গ্রুপের নামে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, যার প্রধান সুবিধাভোগী এস আলম। এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না, বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত