leadT1ad

বাংলাদেশের অর্থনীতি: বাস্তবতা কোন দিকে

সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ২৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৫ সালে এসে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা কী। এ প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ২০২৪ সালের পরে। গত বছরের ঘটনা প্রবাহের পর বদলে গেছে এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চালচিত্র। অর্থনৈতিক পটভূমিতে বিপর্যয়ের কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি সম্ভাবনার আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে এসেছে, আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তবতা কী?

প্রথম বাস্তবতা হলো, প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র‍্য দূরীকরণ, সামাজিক নানা সূচক ও ভৌতকাঠামোর বিস্তারে অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ তার অনপেক্ষ দারিদ্র্যের হার ১৯৯০-এর দশকে ৫৮ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। একই সময়ে দেশে চরম দারিদ্র্যের হার ৪৩ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ৭৪ বছরের প্রত্যাশিত গড় আয়ু অর্জন করেছে—ভারতে যা ৬৮ বছর, পাকিস্তানে ৬৬ বছর। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে প্রতি হাজারে ৩৪ এবং পাকিস্তানে প্রতি হাজারে ৬৭।

বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় বাস্তবতা হলো অসমতা ও বৈষম‍্য। যে অর্জনের কথা উল্লিখিত হয়েছে, তার সুফল সমভাবে বণ্টিত হয়নি—না অঞ্চলের মধ‍্যে, না গ্রাম-শহরের মধ‍্যে, না বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ‍্যে। বঞ্চনারও ভিন্নতা আছে। যেমন বয়স্ক স্বাক্ষরতার হার বরিশালে যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে তা ৬০ শতাংশ। তেমনি অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত‍্যুর হার উচ্চতম আয়ের পরিবারে যেখানে হাজারে ২০, নিম্নতম আয়ের পরিবারে সংশ্লিষ্ট সংখ‍্যাটি হচ্ছে ৫০। গ্রাম-বাংলায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপতন (২৭ শতাংশ) শহুরে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের (১৩ শতাংশ) দ্বিগুণেরও বেশি।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ৭৪ বছরের প্রত্যাশিত গড় আয়ু অর্জন করেছে—ভারতে যা ৬৮ বছর, পাকিস্তানে ৬৬ বছর। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩১, ভারতে প্রতি হাজারে ৩৪ এবং পাকিস্তানে প্রতি হাজারে ৬৭।

অসমতা বা বৈষম‍্য তো শুধু অর্থনৈতিক নয়, তা ব‍্যাপ্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বলয়েও। বৈষম‍্য শুধু ফলাফলে নয়, তা পরিস্ফুট সুযোগেও। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত। তাঁরা বঞ্চিত সম্পদে, ঋণ সুবিধায়, তথ্য-প্রযুক্তি সেবায়। ফলে কর্মনিয়োজন এবং আয়ের দিক থেকেও তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়। পরিবেশ-নাজুক অঞ্চলে যে সব প্রান্তিক মানুষের বাস, তাঁরাও ক্রমবর্ধমান অসমতার শিকার হয়। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যকার নিম্নবর্ণের মানুষ এবং আশরাফ-আতরাফদের মধ্যে আতরাফ জনগোষ্ঠী সামাজিক বৈষম্যমূলক একটি স্থানে অবস্থান করে।

সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে নগর ও পল্লির মধ্যকার বৈষম্যের কথা সুবিদিত। রাজনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, আদিবাসীদের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দিকে নিতান্ত সীমিত। সমাজ অঙ্গনে ধর্মীয় বৈষম্যের কথা বারবার নানা আলোচনায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তার অভাবের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যাহত করার অভিযোগও উঠেছে। এ সবই বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিকেরই সমান অধিকার।

নারীর প্রতি বৈষম‍্য এবং তার বিরুদ্ধে সহিংসতা বাংলাদেশি সমাজের অসমতার একটি অন‍্যতম বাস্তবতা। সুযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা বৈষম‍্যের শিকার হয়, যা প্রতিফলিত হয় ফলাফলে। ঘরে-বাইরে নানাবিধ হয়রানি আর সহিংসতার শিকার হয় নারীরা। সেসব নির্যাতনের অংশ হলো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহাভ‍্যন্তরের সহিংসতা ও ধর্ষণ। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব‍্যাপার হলো, যখন পথে-ঘাটে নারী-নির্যাতিত হয়, তখন খুব কম ঘটনায় পুরুষকে তাদের সাহায‍্যের জন‍্যে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের দেখা যায় নারীর ব‍্যাপারে নৈতিক-পুলিশের ভূমিকায়।

সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশে নগর ও পল্লির মধ্যকার বৈষম্যের কথা সুবিদিত। রাজনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, আদিবাসীদের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দিকে নিতান্ত সীমিত। সমাজ অঙ্গনে ধর্মীয় বৈষম্যের কথা বারবার নানা আলোচনায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতার তৃতীয় দিক হলো গুণগত মানের অধোগতি। প্রায়শই শুনি যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু খুব কমই বলা হয় যে, সে সব উন্নতি মানে পরিমাণগত প্রসার—গুণগত অগ্রগতি নয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে একাধিক ধারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকাঠামো ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সেবার মেরুকরণ করা হয়েছে, সৃষ্টি করা হয়েছে গুণগত বৈষম্য। সেই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার পরিমাণের যূপকাষ্ঠে মানকে বলি দেয়া হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সনদপ্রাপ্তিই বড় হয়ে উঠেছে, জ্ঞান নয়। স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো মানসম্পন্ন সেবা নয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে মানসম্পন্ন সেবা পেয়েছেন দেশের ধনিক শ্রেণি, নিম্নমানের সেবা বরাদ্দ ছিল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যে।

আমাদের অর্থনীতির চতুর্থ বাস্তবতা হলো আগামী দিনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অন্তরায়ের সন্মুখীন হবে বাংলাদেশ—এর কিছু দেশজ, কিছু বৈশ্বিক। দেশজ অঙ্গনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত থাকবে। শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং বিস্তৃত কর্মহীনতা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে থাকবে। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনও প্রার্থিত স্তরে পৌঁছুয় নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরো বিপর্যস্ত করতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের জীবনযাপনকে প্রভাবিত করবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান কতগুলো মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা এ অর্থনীতির ভবিষ্যত অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেমন, আর্থিক খাতে কিছু উন্নতি হলেও আর্থিক শৃঙ্খলা, বিধিনিষেধের প্রতিস্থাপন এখনও তেমনভাবে হয়নি।

দেশের উৎপাদন পরিমাণ, প্রবৃদ্ধি, সঞ্চয়, বিনিয়োগ একটি শ্লথতার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার জন্ম দিয়েছে। পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, বহু উদ্যোক্তা কার্যকর নন, বিদেশি বিনিয়োগেও দ্বিধা আছে। ফলে দেশের উৎপাদন ভিত্তিও দুর্বল এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ঘাটতি ও বেকারত্ব দেশের একটি বড় সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

দেশের ২৪ লাখ মানুষ বেকার। তার মধ্যে ১০লাখই তরুণ। তরুণদের মধ্যে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েছেন, তাদের ১৩ শতাংশই বেকার। দেশের ৮৩ লাখ তরুণই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মনিয়োজিন কিংবা প্রশিক্ষণে নেই। যুবশক্তির এই বিরাট অপচয় দেশের জন্যে বিশাল ক্ষতি।

দারিদ্র্যের বিস্তার এব সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাজুকতার সম্ভাবনার বৃদ্ধি আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশে দারিদ্র্যের বিস্তার ও নাজুকতার গভীরতা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। যেমন নিম্ন আয়ের মানুষদের ৮৮ শতাংশ মানুষ দুবেলা ভাত খেতে পারে না। তাঁরা একবেলা পাউরুটি কিংবা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দেয়। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের মাসিক আয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাদের তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ আজকাল সকালের নাস্তা খান না। কারণ সেটা খাবার মত সামর্থ্য তাঁদের নেই। এ প্রবণতা চলতে থাকলে পুষ্টিহীনতা একটি মানব উন্নয়ন সমস্যা হিসবে দেখা দিতে পারে, বিশেষত শিশুদের মধ্যে।

আগামী বছর নির্বাচনের পর একটি নির্বাচিত সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। অর্থনীতির কিছু মৌলিক বিষয়ে তাঁদের নজর দিতে হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করবে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেয়া ভর্তুকিও একটি ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানিকৃত উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেয়। জ্বালানি খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া দেয়, তার বেশির ভাগটাই ভোগ করেন সমাজের ধনাঢ্য ও সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেয় ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় আমাদের দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান কতগুলো মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা এ অর্থনীতির ভবিষ্যত অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেমন আর্থিক খাতে কিছু উন্নতি হলেও আর্থিক শৃঙ্খলা, বিধিনিষেধের প্রতিস্থাপন এখনও তেমনভাবে হয় নি। দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি এখনও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত করা যায় নি। যদিও দেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেমন বিধি-নিষেধের যথাযথ প্রয়োগ, অর্থ-পাচার বন্ধ ইত্যাদি; কিন্তু ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যাংকিং শৃঙ্খলা প্রয়োগ এখনও অর্জিত হয় নি। কু-ঋণ, ঋণের অপর্যাপ্ততা, অদক্ষতা ও অ-কার্যকারিতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এ খাতের সমস্যা হিসাবে এখনও বিরাজ করছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। আগামী দিনগুলোতে রাজস্ব আদায়ের শ্লথতা বাংলাদেশের জন্যে একটি উন্নয়ন সমস্যা হিসবে দেখা দিতে পারে।

উন্নয়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের দৃষ্টি কেবল দেশজ চালচিত্রে রাখলে চলবে না, তাকে একটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। শুধু অন্তর্মুখী নীতি নয়, কিংবা ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’ নয়, তার বদলে বাংলাদেশ অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি পথযাত্রার অন্যতম নির্ণায়ক হতে হবে বিশ্বের অর্থনীতি প্রবণতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির পঞ্চম বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন বিষয়ে বৈশ্বিক চাপ এদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, এ বছর ও আগামী বছরও বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগবে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতি এড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হবে। এ সব শুল্কের মোকাবেলা বাংলাদেশকে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদিও উত্তরণ সময় পিছিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছে; কিন্তু সম্ভবত আগামী বছরই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু সুযোগ হারাবে—যেমন স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশ পর্যায়ে উন্নীত হলে বাংলাদেশ এ সব সুবিধা পাবে না। সুতরাং উত্তরণ-পরবর্তী কালে উত্থিত বাংলাদেশকে বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বের নানান অঞ্চলের যুদ্ধ ও সংঘাতের প্রভাবও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে।

আগামী বছর নির্বাচনের পর একটি নির্বাচিত সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে। অর্থনীতির কিছু মৌলিক বিষয়ে তাঁদের নজর দিতে হবে। প্রথমত, আমাদের ভবিষ্যত উন্নয়ন রূপরেখায় ‘অগ্রগতি’ এবং ‘উন্নয়নে’র মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। অগ্রগতি মানেই উন্নয়ন নয়। অগ্রগতি মানে হলো কোনো ইতিবাচক বিষয়ের (যেমন জাতীয় আয়) পরিমাণগত বৃদ্ধি কিংবা কোনো নেতিবাচক বিষয়ের (যেমন মূল্যস্ফীতি) পরিমাণগত হ্রাস। আর উন্নয়ন মানে হলো কেবল পরিমাণগত অর্জন নয়, সেই সঙ্গে বিষয়টির 'গুণগত' পরিবর্তন। যেমন জাতীয় আয়ের পরিমাণগত বৃদ্ধি অগ্রগতি, আর সেটা যদি সুষমবণ্টিত হয়, তবে সেটি উন্নয়ন। এর আগের সকল বয়ানে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই উন্নয়নের সমার্থক মনে করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন রূপরেখায় একটি উন্নয়ন দর্শন থাকতে হবে। সে দর্শনের মূল কথা হবে মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্যে উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। মানুষের সক্ষমতার প্রসার ঘটতে হবে—পরিমাণগত ও গুণগত—উভয় দিক থেকেই সে সক্ষমতার প্রসার কেবল তার কুশলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাতে অন্তর্ভূক্ত থাকবে মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ে একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি সময় বাংলাদেশকে একটি নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে, অন্যদিকে তা আমাদের দেশের জন্যে একটি বড় সুযোগের দুয়ার খুলে দিতে পারে।

উন্নয়নের সুফল সুষমভাবে বণ্টিত হতে হবে—শুধু ফলাফলের সুষম বণ্টন নয়, সুযোগেরও সমবণ্টন। তেমনিভাবে, মানুষ শুধু উন্নয়ন সুফলের নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হবে না, সে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও হবে। কারণ উন্নয়নের যেসব সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করবে, সেখানে মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকা দরকার। এটা করলেই মানুষের কর্মকুশলতা, সৃষ্টিশীলতা বেড়ে যাবে। মানুষ তখন আর উন্নয়ন বৃত্তের পরিসীমায় থাকবে না, কেন্দ্রে স্থিত হবে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন পথযাত্রার একটি নৈতিক ভিত্তি থাকবে। উন্নয়নের লক্ষ্য কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, শুধু বস্তুগত বিষয়ের সমাহার নয়, উন্নয়নের লক্ষ্য মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা, মানুষের মানবিক মর্যাদা সুনিশ্চিতকরণ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, পরধর্ম ও পরমতসহিষ্ণুতার একটি পরিবেশ গড়ে তোলা। উন্নয়নের নৈতিক ভিত্তির ভেতর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অধিষ্ঠান ও নিরন্তর চর্চা একান্ত দরকার। সে চর্চা হতে হবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক দল ও প্রক্রিয়ার ভেতর আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এর পথ ধরেই পরিহার করতে হবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা।

চতুর্থত, উন্নয়নকে কেবল শুদ্ধ অর্থনীতির বিষয় ভাবলে চলবে না, বরং উন্নয়নকে রাজনৈতিক-অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আর ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে বিনির্মাণ করতে হবে। সঙ্গে আসবে সাংস্কৃতিক চালচিত্র। জনকল্যাণমুখী একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, প্রলম্বিত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের ধারণার ভিত্তিতে একটি আঁতাত তৈরি করা যেতে পারে সমাজের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোত্রের মধ্যে। ইতিহাস-বিচ্ছিন্নতায় কিংবা দেশজ সংস্কৃতি বিযুক্তিতে কোন উন্নয়নই স্থায়ী হয় না। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্যে মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে একটি ভারসাম্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি পরিবেশকে একটি উন্নয়ন বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার, শুদ্ধ পরিবেশ সমস্যা হিসেবে নয়—উন্নয়ন ও পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়া।

পঞ্চমত, উন্নয়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের দৃষ্টি কেবল দেশজ চালচিত্রে রাখলে চলবে না, তাকে একটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। শুধু অন্তর্মুখী নীতি নয়, কিংবা ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’ নয়, তার বদলে বাংলাদেশ অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি পথযাত্রার অন্যতম নির্ণায়ক হতে হবে বিশ্বের অর্থনীতি প্রবণতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা। বৈশ্বিক বলয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বদলে বহুপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতি আমাদের দেশের অঙ্গীকার, সমর্থন ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা দরকার। পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক জোটগুলোর দিকে বাংলাদেশকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা কেন জি-২০, জি-১৫ কিংবা ব্রিকসে্র মতো জোটগুলোর সদস্য হতে পারবো না?

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ে একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি সময় বাংলাদেশকে একটি নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে, অন্যদিকে তা আমাদের দেশের জন্যে একটি বড় সুযোগের দুয়ার খুলে দিতে পারে। সে সুযোগ হলো পরিবর্তনের, সংস্কারের ও নতুন একটি অর্থনীতির। সে অর্থনীতির ভিত্তি হবে সমতা, মানবাধিকার ও সুনৈতিকতা। বস্তুনিষ্ঠভাবে সে কাঙ্ক্ষিত অর্থনীতি বিনির্মিত হলে তার বয়ান আর বাস্তব অবস্থার মধ্যে কোনো ফারাক থাকবে না।

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্যদূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

Ad 300x250

সম্পর্কিত