leadT1ad

ডাকসু নির্বাচনের ফল বিএনপির জন্য ওয়েক-আপ কল

মো. আবুল কালাম আজাদ
১৯৯০ এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের আমান-মিলন জুটি পাস করেছিল। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তার পুরোটাই এসেছে ছাত্র-সিপাহী-জনতার মুষ্ঠিবদ্ধ ঐক্যে। দেশের প্রতিটি বিপর্যয়ে 'ওরা' কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ দেশকে রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সামরিক বাহিনী কখনো এই জাতির সঙ্গে বেইমানি করেনি। স্বৈরশাসক এরশাদ বা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনে তাঁরাই ছিলেন অগ্রবর্তি।

১৯৭১-এর ৯ মাসব্যাপি মুক্তিযুদ্ধ বা ৯ বছরব্যাপী এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন সফল হওয়ার হওয়ার পর ‘ওরা’ তো যার যার কাজে ফিরে গেছে। এবার ওরা যাচ্ছে না কেন? গলদটা কোথায়? তাহলে কী রাজনৈতিক দলগুলোর রোগ ছাত্র-জনতা ধরে ফেলেছে? কী সেই রোগ?

প্রতিটি অভ্যুত্থানের পর এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাঁরাই এসেছেন, তাঁরা কখনোই অভ্যুত্থানে আত্মাহুতি দেওয়া শহীদদের কষ্ট, আকাঙ্খা ও স্বপ্ন, কিছুই ধারণ করেনি। অভ্যুত্থানের ফসল যাঁদের ঘরে উঠেছে, তাঁরা কেবল নির্দিষ্ট ওই দিন লোক দেখানো কিছু আয়োজনের ব্যবস্থা করেছেন। যেমন শহীদ নূর হোসেন দিবস বা ডা. মিলন দিবস।

‘জুলাই-৩৬’-এর অভ্যুত্থানকারীদের বলতেই হয়, অনেক স্মার্ট। তাঁরা এদেশের সব ক্ষমতাসীন দলের ওপর যথেষ্ট লেখাপড়া করেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন রেকর্ড, স্ববিরোধীতা, কামড়াকামড়ি, চোখের সামনে লুটপাট ও পাচার, ইচ্ছাতন্ত্র কায়েম দেখে বড় হয়েছেন। তাই এবার তাঁরা তাঁদের মতো করে দেশটাকে গড়তে চান। যেসব দল তাদের ছন্দে ছন্দ মেলাবে, হয়তো তারাই ভালো করবে এবারের জাতীয় নির্বাচনে। যেমনটা দেখা গেল ডাকসুতে।

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর বা ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের ফসল বিএনপির ঘরে উঠেছিল। এবার ফসল কী অন্য কেউ কাটবে? ১৯৯০-এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের আমান-মিলন জুটি পাস করেছিল। এবার কেন ছাত্রদলের হাতছাড়া হল ডাকসু? অন্যান্য ক্যাম্পাসে কী ঘটতে যাচ্ছে?

এখানে ‘ছাত্রশিবির’ ব্যাকগ্রাউন্ডের বিএনপি-মনা কিছু শিক্ষকও ওই কম্বোপ্যাককে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করেছে। এর বড় উদাহারণ হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। হাসিনা পালানোর পর থেকেই জামাত দখল করল বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

উত্তর খুব সোজা। বিগত ১৭ বছর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে মুক্ত রাজনীতি করার সুযোগ পায়নি। ক্যাম্পাসগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার মতো জনবল তাদের ছিল না। ৫ আগস্টের পর মাত্র একটা ব্যাচ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল, যাদেরকে আবার ‘নো পলিটিক্স’ ব্যানারে থাকতে হয়েছে। যখনই ছাত্রদল নতুন ছাত্রদের ‘ইনটেক’ করার চেষ্টা করেছে, তখনই বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে ওইসব ছাত্রদেরকে ছাত্রদল থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এইসব ট্যাগিং কারা করেছে? কারা সহযোগিতা করেছে? এসব তথ্য প্রতিটি ক্যাম্পাসের সকলেই জানে।

একটি বিষয় জেনে রাখা ভালো, ২০১৩ সালের পর যখন জামাতের জাতীয় রাজনীতি কোণঠাসা হয়, তখন জামাতের অধিকাংশ শিক্ষক তাঁদের দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেয়। এমনকি তাঁদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির ঢুকে যায় ছাত্রলীগের পেটের ভেতর। এই ‘কম্বোপ্যাক’-এ জুলাই অভ্যুত্থানের পর যাঁর যাঁর খোলস ছেড়ে নিজেদের পতাকা তলে অবস্থান নেন। আর ক্যাম্পাসে গড়ে তোলেন নিজেদের রাজত্ব।

এখানে ‘ছাত্রশিবির’ ব্যাকগ্রাউন্ডের বিএনপি-মনা কিছু শিক্ষকও ওই কম্বোপ্যাককে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করেছে। এর বড় উদাহারণ হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। হাসিনা পালানোর পর থেকেই জামাত দখল করল বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর বিএনপি চলে গেল হাট-মাঠ-ঘাট-ইজারা মহল-টেম্পু, বাসস্ট্যান্ড, জমি ও ফ্ল্যাট দখলে। আজ বাংলাদেশের ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মধ্যে অন্তত ২৬টি জামাতপন্থীদের দখলে। বাকি ২৫টির মধ্যে বিএনপি-মনা পাঁচ-ছয়টি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসক ও সুসংগঠিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের যৌথ প্রযোজনায় আপনি আর কী আশা করতে পারেন?

মনে রাখতে হবে সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মেয়ে ভোটার এবং মোট ৪০ শতাংশ তরুণ। এই তরুণ ভোটারাই হবে আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক শক্তি। জামাত নারীদের হিজাব নিয়ে রাজনীতি বাদ দিয়েছে।

এখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দায় অবশ্যই রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যখন আমার ক্যাম্পাসের ছাত্রদলের নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁরা হলে গিয়ে নতুন ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে না কেন, নেতারা উত্তর দেয়—কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের হলে উঠতে নিষেধ করেছে। এরকম অবস্থা যদি প্রতিটি ক্যাম্পাসের হয়, তবে বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে।

টিভি মিডিয়ায়, বিশেষ করে টকশোগুলোতে ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের প্রতিবিম্ব বলে প্রচার পাচ্ছে। আসলেই কি তা-ই? নাকি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে? হ্যাঁ, অনেকটাই এ রকম। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই জামাতের বট বাহিনীর হাতে। এমনকি অনেক মিডিয়া হাউস তাদের কথায় ওঠেবসে। বিএনপির আলোচকরা যুৎসই জবাবের পরিবর্তে আওয়ামী বাদ্য বাজায়। এমনকি দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অযাচিত শব্দচয়নে বা অতিকথনে দলের বারোটা ইতিমধ্যে বেজে গেছে।

মনে রাখতে হবে সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মেয়ে ভোটার এবং মোট ৪০ শতাংশ তরুণ। এই তরুণ ভোটারাই হবে আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক শক্তি। জামাত নারীদের হিজাব নিয়ে রাজনীতি বাদ দিয়েছে। তারা মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলছে। বলছে নারীদের জন্য নিরাপত্তার কথা। তরুণদের জন্য বাস্তব কর্মমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

জামাত যদি সমাজের শিক্ষিত নারী ও তরুণ ভোটারদের আস্থা ডাকসু নির্বাচনের মতো নিয়ে আসতে পারে, তবে ফল কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হুঁশ হওয়া উচিত। ক্ষমতায় না গিয়েই যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, তাতে জনগণ, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের আস্থা নষ্ট করছেন না তো?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার নেতা-কর্মীদের বলছেন ‘আগামী নির্বাচন হবে খুবই কঠিন’। ডাকসু নির্বাচন কি তা প্রমাণ করে না? বিএনপির নেতা-কর্মীদের উচিত জনগণেরর কাছে যাওয়া। দিনশেষে তাঁরাই বিএনপির প্রাণ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত