মির্জা তাসলিমা সুলতানা
অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের হুবহু প্রতিবিম্ব হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় মানে তা নয়। সামাজিক বিজ্ঞানের চর্চাকারী হিসাবে জানি, সমাজের হু-বুহু প্রতিভূ হলে তা এমন সংকীর্ণ হবে যে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন কিছু সৃষ্টি করা আর হবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টিরই পরিসর, তা অনেকেই ভুলে যান। শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান—সব ক্ষেত্রেই নতুন জ্ঞান মানুষের জন্য খুবই দরকারি। সামাজিক মানুষের চারণভূমি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এই নিয়ে টানাপড়েন, লড়াই চলতেই থাকে। রাষ্ট্রের সঙ্গে তো চলেই।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনের ইতিহাসে চোখ ফিরিয়ে এ কথা বলা যাবে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লড়িয়ে হিসেবে দেশে সুপরিচিত। এর মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা সবাই জানেন। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সংঘটিত যৌন হয়রানীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রথম সম্মিলিতভাবে ফুঁসে ওঠেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। অভূতপর্ব কৌশলে সেই সময়ের নারী শিক্ষার্থীরা—আমরা এই অন্যায়ের বিহিত করে ছেড়েছিলাম।
বলা বাহুল্য, তখন আমরা ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটাও জানতাম না! আমরা তখন কেবল ‘খারাপ কাজ’-এর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিলাম। ফলে একই বছরে সূর্যাস্ত আইনবিরোধী আন্দোলনেও নামতে হয় নারী শিক্ষার্থীদের। কারণ, আগের ঘটনাটা ঘটে রাত আটটার কমিউনিটি বাসে। তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সে সময় ‘মেয়েরা ঝোপেঝাড়ে থাকে’ উল্লেখ করে অভিভাবকদের কাছে চিঠি পাঠায়। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলে। অন্যায়ের জন্য অন্যায়কারীকে দায়ী না করে দায় চাপানো হয় নারী শিক্ষার্থীদের ওপর। আদতে প্রশাসন সে সময় নারী শিক্ষার্থীদের দায়ী করে তাঁদেরই বন্দী করার মাধ্যমে কড়াকড়ি ব্যাবস্থা আরোপ করতে চেয়েছিল। তখন সামনে আমার মাস্টার্স পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপে তাই বিষয়গুলো এতটা খুঁটিনাটিভাবে জানতাম না। তবে বন্ধুরা যখন আন্দোলন শুরু করল, তখন বিশদে জানলাম সবকিছু। এ সময় আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, প্রশাসন থেকে পাঠানো চিঠি তাঁর কাছেও এসেছে। কিন্তু সঙ্গে এ-ও বলেছিলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয় এত ‘অশ্লীল’ চিঠি পাঠাতে পারে! এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনের বাড়াবাড়িকে পরাস্ত করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
এরপর ১৯৯৫ সালে এক নারী শিক্ষার্থী যখন ক্যাম্পাসেরই এক ছাত্রের কাছে হেনস্তার শিকার হলেন, তখনও আবার আন্দোলন গড়ে তুললেন নারী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রশাসনের চাতুরিতে ব্যর্থ হলো আন্দোলনটি। পরে ১৯৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের কথা তো সবারই জানা। বলা দরকার, ১৯৯৫ সালের সেই ‘ব্যর্থ আন্দোলন’-এর অভিজ্ঞতার কারণে নারী শিক্ষার্থীরা তখন আরও সংগঠিত। মনে আছে, সে সময় প্রশাসন আমাদের যত খারাপ কথা বলেছে, তার প্রমাণ আমরা রেখে দিয়েছি ‘অশুচি’ নামের সংকলনে।
এর পরবর্তী দশ বছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আট মার্চে প্রতিবার যৌন হয়রানীবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছে। অবশেষে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত থেকে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানীবিরোধী নীতিমালা পেয়েছি, যেখানে জাহাঙ্গীরনগরের নারী শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের উল্লেখ আছে। যুথবদ্ধ হয়ে অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বারবার মোকাবিলা করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। ছেলেরাও তাঁদের পেছনে ছিলেন। এ ছাড়া, আরও কত শত আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা! ‘র্যাগিং’-এর স্বরূপ চেনা এবং তার প্রতিবাদ আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে চালিয়ে গেছি, এখানেও অগ্রবর্তী ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা।
৩৩ বছর পর জাকসু অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী নারী শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধি বাছাই করে নেবে। শিক্ষার্থীরা নতুন ভোর নিয়ে আসবে, সেই অপেক্ষায়…
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক
অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের হুবহু প্রতিবিম্ব হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় মানে তা নয়। সামাজিক বিজ্ঞানের চর্চাকারী হিসাবে জানি, সমাজের হু-বুহু প্রতিভূ হলে তা এমন সংকীর্ণ হবে যে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন কিছু সৃষ্টি করা আর হবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টিরই পরিসর, তা অনেকেই ভুলে যান। শুধু বিজ্ঞান নয়, দর্শন, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান—সব ক্ষেত্রেই নতুন জ্ঞান মানুষের জন্য খুবই দরকারি। সামাজিক মানুষের চারণভূমি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এই নিয়ে টানাপড়েন, লড়াই চলতেই থাকে। রাষ্ট্রের সঙ্গে তো চলেই।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনের ইতিহাসে চোখ ফিরিয়ে এ কথা বলা যাবে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লড়িয়ে হিসেবে দেশে সুপরিচিত। এর মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা সবাই জানেন। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সংঘটিত যৌন হয়রানীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রথম সম্মিলিতভাবে ফুঁসে ওঠেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। অভূতপর্ব কৌশলে সেই সময়ের নারী শিক্ষার্থীরা—আমরা এই অন্যায়ের বিহিত করে ছেড়েছিলাম।
বলা বাহুল্য, তখন আমরা ‘যৌন হয়রানি’ শব্দটাও জানতাম না! আমরা তখন কেবল ‘খারাপ কাজ’-এর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিলাম। ফলে একই বছরে সূর্যাস্ত আইনবিরোধী আন্দোলনেও নামতে হয় নারী শিক্ষার্থীদের। কারণ, আগের ঘটনাটা ঘটে রাত আটটার কমিউনিটি বাসে। তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সে সময় ‘মেয়েরা ঝোপেঝাড়ে থাকে’ উল্লেখ করে অভিভাবকদের কাছে চিঠি পাঠায়। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলে। অন্যায়ের জন্য অন্যায়কারীকে দায়ী না করে দায় চাপানো হয় নারী শিক্ষার্থীদের ওপর। আদতে প্রশাসন সে সময় নারী শিক্ষার্থীদের দায়ী করে তাঁদেরই বন্দী করার মাধ্যমে কড়াকড়ি ব্যাবস্থা আরোপ করতে চেয়েছিল। তখন সামনে আমার মাস্টার্স পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপে তাই বিষয়গুলো এতটা খুঁটিনাটিভাবে জানতাম না। তবে বন্ধুরা যখন আন্দোলন শুরু করল, তখন বিশদে জানলাম সবকিছু। এ সময় আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, প্রশাসন থেকে পাঠানো চিঠি তাঁর কাছেও এসেছে। কিন্তু সঙ্গে এ-ও বলেছিলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয় এত ‘অশ্লীল’ চিঠি পাঠাতে পারে! এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনের বাড়াবাড়িকে পরাস্ত করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
এরপর ১৯৯৫ সালে এক নারী শিক্ষার্থী যখন ক্যাম্পাসেরই এক ছাত্রের কাছে হেনস্তার শিকার হলেন, তখনও আবার আন্দোলন গড়ে তুললেন নারী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রশাসনের চাতুরিতে ব্যর্থ হলো আন্দোলনটি। পরে ১৯৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের কথা তো সবারই জানা। বলা দরকার, ১৯৯৫ সালের সেই ‘ব্যর্থ আন্দোলন’-এর অভিজ্ঞতার কারণে নারী শিক্ষার্থীরা তখন আরও সংগঠিত। মনে আছে, সে সময় প্রশাসন আমাদের যত খারাপ কথা বলেছে, তার প্রমাণ আমরা রেখে দিয়েছি ‘অশুচি’ নামের সংকলনে।
এর পরবর্তী দশ বছর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আট মার্চে প্রতিবার যৌন হয়রানীবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছে। অবশেষে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত থেকে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানীবিরোধী নীতিমালা পেয়েছি, যেখানে জাহাঙ্গীরনগরের নারী শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের উল্লেখ আছে। যুথবদ্ধ হয়ে অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বারবার মোকাবিলা করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। ছেলেরাও তাঁদের পেছনে ছিলেন। এ ছাড়া, আরও কত শত আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা! ‘র্যাগিং’-এর স্বরূপ চেনা এবং তার প্রতিবাদ আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে চালিয়ে গেছি, এখানেও অগ্রবর্তী ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরা।
৩৩ বছর পর জাকসু অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী নারী শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধি বাছাই করে নেবে। শিক্ষার্থীরা নতুন ভোর নিয়ে আসবে, সেই অপেক্ষায়…
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধাপক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) যাই না বহুদিন। আজ ৩৩ বছর পর ফিরে এসেছে জাকসু নির্বাচন। সেই উছিলায় আজ যাওয়া যেতেই পারে।
২ ঘণ্টা আগেজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। প্রায় ৩৩ বছর দীর্ঘ বিরতির পর আবারও জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
২১ ঘণ্টা আগেসমাজ-পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন-অভ্যুত্থান আর নৈরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। অভ্যুত্থানের গন্তব্য থাকে, কিন্তু নৈরাজ্য গন্তব্যহীন। নেপাল অথবা বাংলাদেশ—যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই কথাগুলো সমানভাবে সত্য।
১ দিন আগেদীর্ঘ বিরতির পর আবারও অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে পুরো দেশের ছাত্ররাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারে এবারের ডাকসু। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনকে একটি দিক নির্দেশক মাইলফলক হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ আছে।
২ দিন আগে