আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস
আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন। এই লেখায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, গণতন্ত্রের পথে ডাকসু নির্বাচন কতটা আশা জাগাল।
মীর নাদিয়া নিভিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন। এই ফল নিয়ে কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশেষত প্রতিবেশী দেশের কয়েকজন তড়িঘড়ি করে বলছেন, বাংলাদেশে আবারও ‘কট্টর ইসলামপন্থী রাজনীতি’র উত্থান ঘটছে। কিন্তু তাঁদের এই ব্যাখ্যা অনেক সরলীকৃত। বাস্তবতা আসলে অনেক জটিল। মূলত এই জয়ের পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। পুরোনো রাজনৈতিক ধ্যানধারণা যে এখনকার বাস্তবতায় আর সেভাবে কাজ করছে না, ডাকসুতে শিবিরের এই জয়ই তার প্রমাণ।
২০২৫ সালের আগস্টে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, দেশের ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় রয়েছেন। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বাকি মাত্র পাঁচ মাস। এ প্রেক্ষিতে একটু সাম্প্রতিক অতীতে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক বোঝাপড়া আর পরের বোঝাপড়ার মধ্যে স্পষ্ট ফারাক রয়েছে।
জুলাই আন্দোলনের পর থেকে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এত বিরাট অংশের ভোটাররা যখন কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা তো অবশ্যই। তাই দলগুলোর এখন উচিত হবে তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে আমলে নেওয়া। পাশাপাশি ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মানুষের মনোভাবে যে পরিবর্তন এসেছে, তাকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা।
ডাকসু নির্বাচনের জটিলতা বোঝার জন্য বিজয়ীর কৌশল আর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ দুটোই খতিয়ে দেখা জরুরি। বিজয়ী প্যানেলের কৌশল নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাধাগুলো বিশ্লেষণ করা দরকার। যেমন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বামঘেঁষা সংগঠনগুলোর সংকট। এসবই নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে।
নির্বাচনের আগে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ছাত্রলীগ নিয়মিতভাবে ছাত্রদলকে দমন-পীড়ন করেছে। হত্যা, গ্রেপ্তার, কারারোধসহ নানা ধরনের নিপীড়নের ফলে সংগঠনটি প্রায় ভেঙে পড়েছিল। তাদের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয়ে গিয়েছিল দুর্বল। অনেক সদস্য মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে হয়েছিলেন কারাবন্দী। তাই অভ্যন্তরীণভাবে সংগঠিত হওয়া এবং কার্যকর প্রচারণা চালানো ছাত্রদলের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সময় ও লোকবলের সীমাবদ্ধতাও ছিল একটি বড় বাধা।
অন্যদিকে, জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবিরকে নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করা হলেও তারা ধীরে ধীরে বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। ক্যাম্পাসে কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টিকে থেকে ছাত্রশিবির গোপনে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। এতে নানা বাতাবরণে তারা ক্যাম্পাসে অস্পষ্ট কিন্তু শক্তিশালী উপস্থিতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সংগঠনটি দ্রুত আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ছাত্রদল একটি ‘বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হয়। তাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবুও ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে একটি প্যানেল দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু কোনো শক্তিশালী মূল্যবোধ বা নতুন বয়ান তারা হাজির করতে পারেনি। অনেকের মতে, ছাত্রদল যদি একটি স্পষ্ট ও ভিন্নধর্মী প্ল্যাটফর্ম হাজির করতে পারত, পরিস্থিতি তাহলে বদলে যেত। কিন্তু ছাত্রদল নির্ভর করেছিল পুরোনো প্রচারণাকেন্দ্রিক প্রথাগত বয়ানের ওপর, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের বয়ানের মতো করে সামনে আনা হয়। অথচ আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন এই বয়ানকে দমনমূলক কাজে ব্যবহার করেছিল। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই বয়ানের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে ছাত্রদলের নির্বাচনমুখী প্রথাগত প্রচারণা ভোটারদের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
ছাত্রদল ও শিবির ছাড়াও বামঘেঁষা সংগঠনগুলোও ডাকসু নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা সাধারণত ছাত্রবান্ধব হিসেবে পরিচিত এবং নিয়মিতভাবে কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ চালানোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির অভাব ছিল তাদের। বড় সংগঠনগুলো যেখানে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে আকৃষ্ট করে, বামপন্থী সংগঠনগুলো সেখানে অধিকতর মেধাভিত্তিক, অধিকারকেন্দ্রিক আর আন্দোলননির্ভর কর্মসূচির মাধ্যমেই সরব থেকেছে। ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় মনে করা হলেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের কাঠামোগত দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। এ ছাড়া, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং তাদের শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় তারা মূলত ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আবার জাতীয় রাজনীতিতেও বামপন্থীদের প্রভাব এখন সীমিত। ফলে ছাত্রসমাজ তাদের নেতা হিসেবে কল্পনা করতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বলেই মনে হয়।
এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপট এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের জটিলতাকে সামনে হাজির করেছে।
ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয় মানুষ তথা তরুণ সমাজের মনোভাবেরই বর্হিঃপ্রকাশ। সংগত কারণে এটি আমাদের সবাইকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। পুরোনো ধারার রাজনৈতিক কৌশল আর কাজ করছে না—এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর এখন উচিত হবে বাহ্যিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে গভীরভাবে খুঁজে দেখা, কেন ডাকসুতে শিবির এমন সাফল্য পেল? এর পেছনে তাদের কৌশলগুলোই বা কী ছিল?
তবে কৌশলগুলো খুঁজে দেখার আগে এটাও বলা দরকার যে, এ ফল হয়তো নতুন প্রজন্মের পরিবর্তিত অগ্রাধিকার এবং তাঁদের গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততারও ইঙ্গিতবাহী। উল্লেখ্য, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রজন্মই বিশাল ভোটারগোষ্ঠী হিসেবে অংশ নেবে। ফলে তাঁদের মনোভাব বিশ্লেষণ করা যেমন জরুরি, একইভাবে তা রাজনৈতিক রীতিনীতির পরিবর্তনগুলোও আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারে। ডাকসুতে বিজয়ীদের সাফল্যের কার্যকারণ ঘাঁটলে মোটা দাগে মোট পাঁচটি বিষয় উঠে আসে:
বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম পুরোনো ধারার ‘বাইনারি পলিটিক্স’-এর বাইরে বেরোতে চায় বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে ডাকসু নির্বাচন প্রমাণ করেছে, আমাদের তরুণেরা গণতান্ত্রিক চেতনায় দিনে দিনে আরও পরিণত হচ্ছেন। নির্দষ্ট মতাদর্শের বদলে তাঁরা এ নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজেদের স্থানিক সমস্যা সমাধানের প্রতি।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ভোটাররা সাধারণত প্রার্থীর ঘোষণাপত্রকে গুরুত্ব দেন। প্রমাণসাপেক্ষ প্রতিশ্রুতি এবং তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাকেই সেখানে মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নেওয়া প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারগুলো আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে, শিবির-সমর্থিত কমিটির বিজয়ের মূল কারণ ছিল তাদের সংগঠিত আর সক্রিয় প্রচেষ্টা। আদতে তারা শিক্ষার্থীরা কী চান, তাঁদের প্রয়োজন কী, তা বুঝতে পেরেছিল। ফলে আবাসিক হল থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাসেই তারা ছাত্রবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দলের ইসলামী আদর্শ কি শিবিরের জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে? তখন তাঁরা জানান, আদর্শ নয় বরং নির্বাচনের আগে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ছাত্রকল্যাণভিত্তিক ঘোষণাপত্রই ছিল সমর্থনের কারণ। এ থেকে বোঝা যায়, ভোটাররা এখন আর মতাদর্শ নয়, তাঁদের স্থানীয় সমস্যাগুলো কে সামাধান করবে, তার ওপরেই বেশি গুরুত্বারোপ করছেন। বাস্তব ফলাফলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কৌশল কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা দেখিয়েছে ডাকসুর এই ভোটযুদ্ধ। বস্তুত, শিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণ করেছে। বলা যায়, মতাদর্শকে বাইরে রেখে তারা এসব শিক্ষার্থীবান্ধব প্রচার কৌশল—যেমন বৈচিত্র্য, নারী অধিকার, শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কর্মকাণ্ড—এসব হাতে নিয়েছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি আস্থা অনুভব করেছেন। বলা বাহুল্য, তাদের জয়ের পেছনে এই অভিনব নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল বড় ভূমিকা পালন করেছে।
এক্ষেত্রে তাদের প্রার্থী তালিকাও ছিল বৈচিত্র্যময়। এখানে নারী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিও ছিলেন। এতে করে তারা তাদের নিয়ে অনেকের যে উদ্বেগ—বৈচিত্র্য বা নারী প্রশ্নে তারা কট্টর—এই ভয়ের জায়গাগুলো দূর করতে সক্ষম হয়। বিশেষভাবে নারী হলগুলোতে তারা সক্রিয় প্রচারণা চালিয়েছে, যা ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতি আস্থাশীল হতে ভূমিকা রেখেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের রাজনৈতিক বয়ান। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত এ বয়ানে তারা বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি মুক্ত, ন্যায্য ও শিক্ষাকেন্দ্রিক ক্যাম্পাস গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে যে এই স্পষ্ট বার্তা বা বয়ান, শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন, আর কার্যকর প্রচারণাই ছিল তাদের সাফল্যের মূল উপাদান।
এখান থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করা যায়, প্রচলিত নেতিবাচক প্রচারণা বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যর্থতা তুলে ধরার কৌশল এখন আর আগের মতো কার্যকর হচ্ছে না। বিপরীতে এই সময়ের ভোটাররা স্পষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক প্রস্তাবকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এবারের ডাকসু নির্বাচন সম্ভবত অতীতের ‘সামাজিক চুক্তি’ মডেল থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছিল। বিশেষত, হলের আবাসিক শিক্ষার্ধীরা বাধ্য ছিলেন শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে; এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করতেন। বিনিময়ে তাঁদের অংশ নিতে হতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল বলছে, ছাত্ররা হয়তো এই মডেল প্রত্যাখ্যান করছে। তাঁরা রাজনৈতিক আনুগত্য থেকে স্বাধীন হতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মূল লক্ষ্য শিক্ষা ও ছাত্রকল্যাণকে গুরুত্ব দেওয়া। এই নির্বাচন তাই এটি অন্তত বুঝিয়েছে যে ছাত্ররাজনীতি যেন জাতীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি না হয়ে বরং ছাত্রদের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কেটে গেছে পঞ্চান্ন বছর। বিগত সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটিকে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে একপাক্ষিকভাবে যত্রতত্র ব্যবহার করেছে। এ কারণে সম্ভবত এটি তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যে এখন আর আগের মতো আবেগ জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আদতে দেশের রাজনীতিকে পুরোনো বয়ানের সঙ্গে বেঁধে রাখার চেষ্টা, তা এখন আর খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকার দাবি কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে পুনর্মিলনের ভয়ের মতো প্রচারণা—দুইয়ের কোনেটাই এখন আর আগের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
কেননা, আজকের তরুণেরা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছেন। তাঁরা বহু চর্চিত ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি আবেগী সংযোগ অনুভব করেন কি? ডাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচন দেখিয়েছে, এ ধরনের অদেখা আবেগনির্ভর কৌশল এখন আর তরুণদের মধ্যে সেভাবে কাজ করছে না।
জুলাই ২০২৪-এর গণ-আন্দোলনের ছাপ এখনো তরুণদের মনে জাজ্জ্বল্যমান। ওই আন্দোলনে স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় শিবির সংগঠন আকারে না হলেও দৃশ্যমানভাবে যুক্ত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে। এতে তারা ব্যাপক সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করেছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
শিবির-সমর্থিত প্যানেল দক্ষতার সঙ্গে এই আন্দোলনের চেতনা তাদের নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত করেছে। আবার ভোটাররাও এতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ১৯৯০-এর দশক থেকে শিবির ক্যাম্পাসে উপেক্ষিত ও দমনমূলক আচরণের শিকার হয়ে এসেছে। আর আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সামান্য সন্দেহভাজন সম্পর্ক থাকলেই কঠোর নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে দলটিকে। এসব মিলিয়ে এবারে তাদের বিজয় প্রমাণ করেছে, শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন আন্দোলনে শিবিরের সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশলের স্বীকৃতি দিয়েছে, অন্যদিকে প্রত্যাখ্যান করেছে অতীতের দমননীতি।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবার হয়তো এ ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। ক্যাম্পাসের রাজনীতি আর পুরোপুরি জাতীয় প্রবণতাকে অনুকরণ করছে না। ডাকসুর ভোটের লড়াইয়ে শিক্ষার্থীরা স্পষ্টভাবে এবার ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ বাস্তবতায় জাতীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতীক হওয়ার প্রবণতা তাই খানিকটা কমেছে। ফলে এই কৌশল সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, এমন সম্ভাবনা কম।
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তার উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। কেননা নির্বাচনটি দেখিয়েছে যে ভোটাররা—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, নতুনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক ধারণার প্রয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে তারা পুরোনো দ্বিদলীয় ধারার বাইরে গিয়ে তাঁদের জন্য কে বিকল্প হতে পারে, তা-ও অনুসন্ধান করছে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আগেই তো বলা হয়েছে, পুরোনো কৌশলগুলো এখন আর আগের মতো কার্যকরী হচ্ছে না; বরং সেগুলো ভোটারদের দূরেই সরিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জনগণের সামাজিক চুক্তি রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়, ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। তাই প্রধান দলগুলো কখনো শক্তিশালী রাজনৈতিক বয়ান তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেনি। কিন্তু এবারের ডাকসু নির্বাচন ইঙ্গিত করছে, সে যুগ হয়তো ইতি ঘটতে চলেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে ভাবা দরকার। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে সঙ্গে সুস্পষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক বয়ান তৈরি করতে পারলেই তারা সচেতন ও বিচক্ষণ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে ভোটারদের আস্থায় নিতে তাদের মনোভাব বোঝা ছাড়া আর উপায় নেই।
লেখক: আন্তর্জাতিক শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ; দেড় দশক ধরে জাতিসংঘের হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রশাসন শক্তিশালীকরণ ও সংস্কার বাস্তবায়নে কাজ করেছেন; বর্তমানে বাংলাদেশ নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন। এই ফল নিয়ে কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশেষত প্রতিবেশী দেশের কয়েকজন তড়িঘড়ি করে বলছেন, বাংলাদেশে আবারও ‘কট্টর ইসলামপন্থী রাজনীতি’র উত্থান ঘটছে। কিন্তু তাঁদের এই ব্যাখ্যা অনেক সরলীকৃত। বাস্তবতা আসলে অনেক জটিল। মূলত এই জয়ের পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। পুরোনো রাজনৈতিক ধ্যানধারণা যে এখনকার বাস্তবতায় আর সেভাবে কাজ করছে না, ডাকসুতে শিবিরের এই জয়ই তার প্রমাণ।
২০২৫ সালের আগস্টে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, দেশের ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় রয়েছেন। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বাকি মাত্র পাঁচ মাস। এ প্রেক্ষিতে একটু সাম্প্রতিক অতীতে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক বোঝাপড়া আর পরের বোঝাপড়ার মধ্যে স্পষ্ট ফারাক রয়েছে।
জুলাই আন্দোলনের পর থেকে মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এত বিরাট অংশের ভোটাররা যখন কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা তো অবশ্যই। তাই দলগুলোর এখন উচিত হবে তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে আমলে নেওয়া। পাশাপাশি ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মানুষের মনোভাবে যে পরিবর্তন এসেছে, তাকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা।
ডাকসু নির্বাচনের জটিলতা বোঝার জন্য বিজয়ীর কৌশল আর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ দুটোই খতিয়ে দেখা জরুরি। বিজয়ী প্যানেলের কৌশল নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাধাগুলো বিশ্লেষণ করা দরকার। যেমন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বামঘেঁষা সংগঠনগুলোর সংকট। এসবই নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে।
নির্বাচনের আগে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ছাত্রলীগ নিয়মিতভাবে ছাত্রদলকে দমন-পীড়ন করেছে। হত্যা, গ্রেপ্তার, কারারোধসহ নানা ধরনের নিপীড়নের ফলে সংগঠনটি প্রায় ভেঙে পড়েছিল। তাদের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয়ে গিয়েছিল দুর্বল। অনেক সদস্য মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে হয়েছিলেন কারাবন্দী। তাই অভ্যন্তরীণভাবে সংগঠিত হওয়া এবং কার্যকর প্রচারণা চালানো ছাত্রদলের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সময় ও লোকবলের সীমাবদ্ধতাও ছিল একটি বড় বাধা।
অন্যদিকে, জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবিরকে নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করা হলেও তারা ধীরে ধীরে বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। ক্যাম্পাসে কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টিকে থেকে ছাত্রশিবির গোপনে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। এতে নানা বাতাবরণে তারা ক্যাম্পাসে অস্পষ্ট কিন্তু শক্তিশালী উপস্থিতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সংগঠনটি দ্রুত আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ছাত্রদল একটি ‘বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হয়। তাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবুও ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে একটি প্যানেল দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু কোনো শক্তিশালী মূল্যবোধ বা নতুন বয়ান তারা হাজির করতে পারেনি। অনেকের মতে, ছাত্রদল যদি একটি স্পষ্ট ও ভিন্নধর্মী প্ল্যাটফর্ম হাজির করতে পারত, পরিস্থিতি তাহলে বদলে যেত। কিন্তু ছাত্রদল নির্ভর করেছিল পুরোনো প্রচারণাকেন্দ্রিক প্রথাগত বয়ানের ওপর, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের বয়ানের মতো করে সামনে আনা হয়। অথচ আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন এই বয়ানকে দমনমূলক কাজে ব্যবহার করেছিল। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই বয়ানের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে ছাত্রদলের নির্বাচনমুখী প্রথাগত প্রচারণা ভোটারদের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
ছাত্রদল ও শিবির ছাড়াও বামঘেঁষা সংগঠনগুলোও ডাকসু নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা সাধারণত ছাত্রবান্ধব হিসেবে পরিচিত এবং নিয়মিতভাবে কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ চালানোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির অভাব ছিল তাদের। বড় সংগঠনগুলো যেখানে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে আকৃষ্ট করে, বামপন্থী সংগঠনগুলো সেখানে অধিকতর মেধাভিত্তিক, অধিকারকেন্দ্রিক আর আন্দোলননির্ভর কর্মসূচির মাধ্যমেই সরব থেকেছে। ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় মনে করা হলেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের কাঠামোগত দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। এ ছাড়া, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং তাদের শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় তারা মূলত ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আবার জাতীয় রাজনীতিতেও বামপন্থীদের প্রভাব এখন সীমিত। ফলে ছাত্রসমাজ তাদের নেতা হিসেবে কল্পনা করতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বলেই মনে হয়।
এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপট এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের জটিলতাকে সামনে হাজির করেছে।
ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয় মানুষ তথা তরুণ সমাজের মনোভাবেরই বর্হিঃপ্রকাশ। সংগত কারণে এটি আমাদের সবাইকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। পুরোনো ধারার রাজনৈতিক কৌশল আর কাজ করছে না—এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর এখন উচিত হবে বাহ্যিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে গভীরভাবে খুঁজে দেখা, কেন ডাকসুতে শিবির এমন সাফল্য পেল? এর পেছনে তাদের কৌশলগুলোই বা কী ছিল?
তবে কৌশলগুলো খুঁজে দেখার আগে এটাও বলা দরকার যে, এ ফল হয়তো নতুন প্রজন্মের পরিবর্তিত অগ্রাধিকার এবং তাঁদের গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততারও ইঙ্গিতবাহী। উল্লেখ্য, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রজন্মই বিশাল ভোটারগোষ্ঠী হিসেবে অংশ নেবে। ফলে তাঁদের মনোভাব বিশ্লেষণ করা যেমন জরুরি, একইভাবে তা রাজনৈতিক রীতিনীতির পরিবর্তনগুলোও আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারে। ডাকসুতে বিজয়ীদের সাফল্যের কার্যকারণ ঘাঁটলে মোটা দাগে মোট পাঁচটি বিষয় উঠে আসে:
বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম পুরোনো ধারার ‘বাইনারি পলিটিক্স’-এর বাইরে বেরোতে চায় বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে ডাকসু নির্বাচন প্রমাণ করেছে, আমাদের তরুণেরা গণতান্ত্রিক চেতনায় দিনে দিনে আরও পরিণত হচ্ছেন। নির্দষ্ট মতাদর্শের বদলে তাঁরা এ নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজেদের স্থানিক সমস্যা সমাধানের প্রতি।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ভোটাররা সাধারণত প্রার্থীর ঘোষণাপত্রকে গুরুত্ব দেন। প্রমাণসাপেক্ষ প্রতিশ্রুতি এবং তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাকেই সেখানে মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নেওয়া প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারগুলো আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে, শিবির-সমর্থিত কমিটির বিজয়ের মূল কারণ ছিল তাদের সংগঠিত আর সক্রিয় প্রচেষ্টা। আদতে তারা শিক্ষার্থীরা কী চান, তাঁদের প্রয়োজন কী, তা বুঝতে পেরেছিল। ফলে আবাসিক হল থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাসেই তারা ছাত্রবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দলের ইসলামী আদর্শ কি শিবিরের জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে? তখন তাঁরা জানান, আদর্শ নয় বরং নির্বাচনের আগে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ছাত্রকল্যাণভিত্তিক ঘোষণাপত্রই ছিল সমর্থনের কারণ। এ থেকে বোঝা যায়, ভোটাররা এখন আর মতাদর্শ নয়, তাঁদের স্থানীয় সমস্যাগুলো কে সামাধান করবে, তার ওপরেই বেশি গুরুত্বারোপ করছেন। বাস্তব ফলাফলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কৌশল কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা দেখিয়েছে ডাকসুর এই ভোটযুদ্ধ। বস্তুত, শিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণ করেছে। বলা যায়, মতাদর্শকে বাইরে রেখে তারা এসব শিক্ষার্থীবান্ধব প্রচার কৌশল—যেমন বৈচিত্র্য, নারী অধিকার, শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কর্মকাণ্ড—এসব হাতে নিয়েছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি আস্থা অনুভব করেছেন। বলা বাহুল্য, তাদের জয়ের পেছনে এই অভিনব নির্বাচনী প্রচারণা কৌশল বড় ভূমিকা পালন করেছে।
এক্ষেত্রে তাদের প্রার্থী তালিকাও ছিল বৈচিত্র্যময়। এখানে নারী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিও ছিলেন। এতে করে তারা তাদের নিয়ে অনেকের যে উদ্বেগ—বৈচিত্র্য বা নারী প্রশ্নে তারা কট্টর—এই ভয়ের জায়গাগুলো দূর করতে সক্ষম হয়। বিশেষভাবে নারী হলগুলোতে তারা সক্রিয় প্রচারণা চালিয়েছে, যা ক্যাম্পাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতি আস্থাশীল হতে ভূমিকা রেখেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের রাজনৈতিক বয়ান। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত এ বয়ানে তারা বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি মুক্ত, ন্যায্য ও শিক্ষাকেন্দ্রিক ক্যাম্পাস গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে যে এই স্পষ্ট বার্তা বা বয়ান, শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন, আর কার্যকর প্রচারণাই ছিল তাদের সাফল্যের মূল উপাদান।
এখান থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করা যায়, প্রচলিত নেতিবাচক প্রচারণা বা প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যর্থতা তুলে ধরার কৌশল এখন আর আগের মতো কার্যকর হচ্ছে না। বিপরীতে এই সময়ের ভোটাররা স্পষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক প্রস্তাবকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এবারের ডাকসু নির্বাচন সম্ভবত অতীতের ‘সামাজিক চুক্তি’ মডেল থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছিল। বিশেষত, হলের আবাসিক শিক্ষার্ধীরা বাধ্য ছিলেন শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে; এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করতেন। বিনিময়ে তাঁদের অংশ নিতে হতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল বলছে, ছাত্ররা হয়তো এই মডেল প্রত্যাখ্যান করছে। তাঁরা রাজনৈতিক আনুগত্য থেকে স্বাধীন হতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মূল লক্ষ্য শিক্ষা ও ছাত্রকল্যাণকে গুরুত্ব দেওয়া। এই নির্বাচন তাই এটি অন্তত বুঝিয়েছে যে ছাত্ররাজনীতি যেন জাতীয় ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি না হয়ে বরং ছাত্রদের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কেটে গেছে পঞ্চান্ন বছর। বিগত সরকার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটিকে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে একপাক্ষিকভাবে যত্রতত্র ব্যবহার করেছে। এ কারণে সম্ভবত এটি তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যে এখন আর আগের মতো আবেগ জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আদতে দেশের রাজনীতিকে পুরোনো বয়ানের সঙ্গে বেঁধে রাখার চেষ্টা, তা এখন আর খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকার দাবি কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে পুনর্মিলনের ভয়ের মতো প্রচারণা—দুইয়ের কোনেটাই এখন আর আগের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
কেননা, আজকের তরুণেরা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছেন। তাঁরা বহু চর্চিত ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি আবেগী সংযোগ অনুভব করেন কি? ডাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচন দেখিয়েছে, এ ধরনের অদেখা আবেগনির্ভর কৌশল এখন আর তরুণদের মধ্যে সেভাবে কাজ করছে না।
জুলাই ২০২৪-এর গণ-আন্দোলনের ছাপ এখনো তরুণদের মনে জাজ্জ্বল্যমান। ওই আন্দোলনে স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় শিবির সংগঠন আকারে না হলেও দৃশ্যমানভাবে যুক্ত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে। এতে তারা ব্যাপক সমর্থন ও সহানুভূতি অর্জন করেছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
শিবির-সমর্থিত প্যানেল দক্ষতার সঙ্গে এই আন্দোলনের চেতনা তাদের নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত করেছে। আবার ভোটাররাও এতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ১৯৯০-এর দশক থেকে শিবির ক্যাম্পাসে উপেক্ষিত ও দমনমূলক আচরণের শিকার হয়ে এসেছে। আর আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সামান্য সন্দেহভাজন সম্পর্ক থাকলেই কঠোর নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে দলটিকে। এসব মিলিয়ে এবারে তাদের বিজয় প্রমাণ করেছে, শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন আন্দোলনে শিবিরের সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশলের স্বীকৃতি দিয়েছে, অন্যদিকে প্রত্যাখ্যান করেছে অতীতের দমননীতি।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবার হয়তো এ ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। ক্যাম্পাসের রাজনীতি আর পুরোপুরি জাতীয় প্রবণতাকে অনুকরণ করছে না। ডাকসুর ভোটের লড়াইয়ে শিক্ষার্থীরা স্পষ্টভাবে এবার ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ বাস্তবতায় জাতীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতীক হওয়ার প্রবণতা তাই খানিকটা কমেছে। ফলে এই কৌশল সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, এমন সম্ভাবনা কম।
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তার উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। কেননা নির্বাচনটি দেখিয়েছে যে ভোটাররা—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, নতুনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক ধারণার প্রয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে তারা পুরোনো দ্বিদলীয় ধারার বাইরে গিয়ে তাঁদের জন্য কে বিকল্প হতে পারে, তা-ও অনুসন্ধান করছে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আগেই তো বলা হয়েছে, পুরোনো কৌশলগুলো এখন আর আগের মতো কার্যকরী হচ্ছে না; বরং সেগুলো ভোটারদের দূরেই সরিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জনগণের সামাজিক চুক্তি রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়, ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। তাই প্রধান দলগুলো কখনো শক্তিশালী রাজনৈতিক বয়ান তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেনি। কিন্তু এবারের ডাকসু নির্বাচন ইঙ্গিত করছে, সে যুগ হয়তো ইতি ঘটতে চলেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন জরুরি ভিত্তিতে নতুন করে ভাবা দরকার। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে সঙ্গে সুস্পষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক বয়ান তৈরি করতে পারলেই তারা সচেতন ও বিচক্ষণ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে ভোটারদের আস্থায় নিতে তাদের মনোভাব বোঝা ছাড়া আর উপায় নেই।
লেখক: আন্তর্জাতিক শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ; দেড় দশক ধরে জাতিসংঘের হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রশাসন শক্তিশালীকরণ ও সংস্কার বাস্তবায়নে কাজ করেছেন; বর্তমানে বাংলাদেশ নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য।
আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা কেন বারবার হোঁচট খায়?
৩৬ মিনিট আগেআজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। এই লেখায় স্লাভয় জিজেক দেখানোর চেষ্টা করেছেন, উদারতাবাদী বৈশ্বিক গণতন্
৩ ঘণ্টা আগেরাজশাহীর পবা উপজেলায় সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে। ঋণের দায়ে স্ত্রী-সন্তানসহ মিনারুল ইসলাম নামে এক যুবকের আত্মহত্যার পর তাঁর বাবা রুস্তম আলী ছেলের চল্লিশায় ১২ শ লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াইছেন। আর খাওয়ানোর জন্য এ খরচ তিনি জোগাড় করেছেন ঋণ করে। কেন এই প্রদর্শনবাদিতার অংশ হলেন তিনি? এর পেছনে কারণ কী?
৩ ঘণ্টা আগেআজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। এই লেখায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, বৈশ্বিক গণতন্ত্রের বর্তমান পরিস্তিত
৩ ঘণ্টা আগে