leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস

গণতন্ত্র কি মরে যাচ্ছে

আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খোঁজে ১৯৪৭ থেকে বহুবার রক্ত দিয়েছে এই বাংলার মানুষ। আদর্শ ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দেখা কখনোই পায়নি। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আবারও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য পথ চেয়ে আছে। এই লেখায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, বৈশ্বিক গণতন্ত্রের বর্তমান পরিস্তিতি কেমন।

গণতন্ত্র কি মরে যাচ্ছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

আমরা নিজেদের স্বাধীন মনে করি, কারণ আমাদের কাছে নিজের দাসত্ব বোঝানোর ভাষা নেই।

— স্লাভয় জিজেক

লিবারেল ডেমোক্রেসি, মানে উদার গণতন্ত্রকে অনেকদিন ধরে মানুষের রাজনৈতিক উন্নতির চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে—পশ্চিমা কায়দার ভোট, আইন আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই নাকি স্বাধীনতা, সমতা আর উন্নয়ন আসে।

কিন্তু এই সুন্দর কাহিনির আড়ালে আছে এক বড় সত্য—লিবারেল ডেমোক্রেসি কখনোই নিরপেক্ষ ছিল না। কখনোই সে সবার জন্য সমান ছিল না। আর প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিকও ছিল না। এটি পশ্চিমাদের উপনিবেশকাল থেকে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জন্মের পর থেকেই তা মানুষের মুক্তির বদলে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

এই লিবারেল ডেমোক্রেসির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো—এটা শাসনকেই স্বাধীনতার মতো করে দেখায়। আপনি এখানে দল বদলাতে পারেন, কিন্তু নিজের জীবন বদলাতে পারবেন না। ভোট দেওয়া আর নির্বাচনকে স্বাধীনতা বলা হয়। কিন্তু দারিদ্র্য, বৈষম্য বা শোষণ নিয়ে এখানে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না।

আজ ইউরোপ থেকে গ্লোবাল সাউথ—যা ঘটছে তা কোনো ‘গণতান্ত্রিক সংকট’ নয়, বরং লিবারেল ডেমোক্রেসিরই স্বাভাবিক পরিণতি। যে ব্যবস্থা একসময় ‘ইতিহাস শেষ’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল, তা এখন নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ছে। ডানপন্থার উত্থান, রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা, বেড়ে চলা বৈষম্য আর বিশ্বজুড়ে লিবারেল ধারণার প্রতি তৈরি হয়েছে গভীর হতাশা।

স্লাভয় জিজেক। সংগৃহীত ছবি
স্লাভয় জিজেক। সংগৃহীত ছবি

এখন প্রশ্ন উঠছে—লিবারেল ডেমোক্রেসি কি সত্যিই মানুষের আশা পূরণ করতে পেরেছে? যদি না পারে, তবে হয়তো সময় এসেছে গণতন্ত্রকে নতুন করে ভাবার।

মুনাফা আর আধুনিকতার সন্তান: লিবারেল ডেমোক্রেসি

পশ্চিমা চিন্তাবিদদের গল্পে যেমন শোনানো হয়, লিবারেল ডেমোক্রেসি তেমন কোনো চিরন্তন মানবমুক্তির স্বপ্ন থেকে জন্ম নেয়নি। এটি এসেছিল এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন মেটাতে—মূনাফার জন্য পাগলামির বিকাশের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে।

১৭ থেকে ১৯ শতকের ব্রিটেন, আমেরিকা আর ফ্রান্সের বিপ্লবগুলোকে আমরা সাধারণত ন্যায়বিচারের জন্য বিদ্রোহ ভাবি। বাস্তবে এগুলো ছিল মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন। উদ্দেশ্য ছিল পুরনো সামন্ত শাসনের বাধাগুলো সরিয়ে ব্যবসা, বাজার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পথ পরিষ্কার করা। এর ফলে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠল, তা অধিকার দিল। কে পেল সেই অধিকার? মূলত সেই মানুষেরা যাদের আগে থেকেই সম্পদ ও মর্যাদা ছিল।

গণতন্ত্র এখানে হয়ে উঠল এক ধরনের সমঝোতা। শিল্পায়নের জন্য দরকার ছিল দক্ষ শ্রমিক, শহরের অবকাঠামো আর কিছু রাজনৈতিক বৈধতা। তাই ভোটাধিকার, সরকারি শিক্ষা বা শ্রমিক সুরক্ষা এসেছে নিচ থেকে চাপের মুখে। আর একই সঙ্গে তা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে অর্থনীতির চালিকাশক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে।

লিবারেল ডেমোক্রেসি তেমন কোনো চিরন্তন মানবমুক্তির স্বপ্ন থেকে জন্ম নেয়নি। স্ট্রিম গ্রাফিক
লিবারেল ডেমোক্রেসি তেমন কোনো চিরন্তন মানবমুক্তির স্বপ্ন থেকে জন্ম নেয়নি। স্ট্রিম গ্রাফিক

এখানেই লিবারেল ডেমোক্রেসির বড় কৌশল—নিজেকে সাধারণ মানুষের নিরপেক্ষ রক্ষক হিসেবে দেখানো। অথচ আসল কাজ সম্পত্তি, বাজার আর মুনাফার স্বার্থই রক্ষা করা। স্বাধীনতার কথা সে বলে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা কখনো বহাল অর্থনৈতিক কাঠামোকে নাড়া দিতে পারে না।

যখনই স্বাধীনতা পুঁজির স্বার্থে হুমকি হয়—যখন শ্রমিক ধর্মঘট করে, সগঠিত হয়, বা গরিবরা জমি-খাবারের দাবি তোলে—তখন এই গণতন্ত্র নিজেকে স্থগিত করতে একবারও পিছপা হয়নি। ১৯৭৩ সালের চিলির অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের মিশরের দমন—পশ্চিমা শক্তি বারবার দেখিয়েছে, প্রয়োজন পড়লে ভোট, অধিকার, এমনকি নির্বাচিত সরকারও ফেলে দেওয়া যায়।

এইভাবে, মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও আইনের সমতার ভাষা দিয়ে তৈরি হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা, যা শুধু বাজার রক্ষা করে না, তার জন্যই বিশ্বজুড়ে একই নিয়ম চাপিয়ে দেয়। ফলে লিবারেল ডেমোক্রেসি হয়ে উঠেছে কেবল পশ্চিমের আবিষ্কার নয়, পশ্চিমের রপ্তানি। সে অন্য ধরনের গণতান্ত্রিক কল্পনাকে জায়গা দিতে চায় না।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে লিবারেল ডেমোক্রেসি মুক্তি আনেনি। বরং নতুন রকমের শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে। এখানে ভোট হয়, কমিশন হয়, সংসদ চলে। একই সঙ্গে বাড়ে বৈষম্য, সহিংসতা, অটল হয় একনায়কতন্ত্র।

সাম্রাজ্যের হাত ধরে রপ্তানি: চাপানো গণতন্ত্র আর হারানো বিকল্প

লিবারেল ডেমোক্রেসির সবচেয়ে বড় চালাকি ছিল নিজেকে একমাত্র গণতন্ত্র হিসেবে দেখানো। পশ্চিমা শক্তি একে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে সাম্রাজ্য, যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘স্বাধীন বিশ্বের’ নামে এই মডেল চাপায়। নতুন স্বাধীন দেশগুলোকে বলা হলো—বাজার খোলো, বিদেশি বিনিয়োগ আনো, আর নির্বাচনের নামে ভোট দিয়ে শান্ত থাকো।

যারা অন্য পথ নিতে চেয়েছিল—নিজেদের স্থানীয় শাসনব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল—তাদের হুমকি হিসেবে ধরা হলো। লুমুম্বা, মোসাদ্দেক, আলেন্দে—সবাইকে হত্যা বা উচ্ছেদ করা হলো।

সামরিক শক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক দড়িও টানা হলো। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঋণ এল শর্তে—বাজার খোলো, খরচ কাটো, বেসরকারিকরণ করো। ফলে দেশগুলো বাধ্য হলো বিনিয়োগকারীর স্বার্থ আগে রাখতে, নিজের মানুষ পরে।

সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়ল মানসিকতায়। পশ্চিম ঠিক করে দিল—কোনটা গণতন্ত্র, কোনটা নয়। এশিয়া-আফ্রিকার পুরনো স্থানীয় পরিষদ বা কমিউনের মডেলগুলোকে বলা হলো ‘অসভ্য’। ফল হলো, স্থানীয় অংশগ্রহণের যে ভালো পদ্ধতি ছিল তা ভেঙে গেল। জায়গা নিল পশ্চিমা সংসদ-আদালত-প্রশাসন। কিন্তু ক্ষমতা থেকে গেল এলিট আর বিদেশিদের হাতে।

এই ‘স্বাধীনতা’ তাই অনেক সময় গভীর বশ্যতা লুকিয়ে রাখে। ভোট হয় ঠিকই, কিন্তু কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

লিবারেল ডেমোক্রেসি টিকে আছে কারণ এটি বিকল্পগুলো মুছে দিয়েছে। একে বাঁচিয়ে রেখেছে সাম্রাজ্যের শক্তি, পুঁজির টাকা আর বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের ছাতা। আজ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার—সবখানেই এই আমদানি করা মডেল ন্যায় প্রতিষ্ঠার বদলে ক্ষমতাবানদের ঢাল হয়ে আছে।

ঔপনিবেশিক ফাঁদ—দেখনদারি গণতন্ত্র

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে লিবারেল ডেমোক্রেসি মুক্তি আনেনি। বরং নতুন রকমের শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে। এখানে ভোট হয়, কমিশন হয়, সংসদ চলে। একই সঙ্গে বাড়ে বৈষম্য, সহিংসতা, অটল হয় একনায়কতন্ত্র।

এটাই আসলে লিবারেল ডেমোক্রেসির কাজ — পরিবর্তনের নাটক চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু আসল ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখা।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে লিবারেল ডেমোক্রেসি মুক্তি আনেনি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে লিবারেল ডেমোক্রেসি মুক্তি আনেনি। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের উদাহরণ ধরুন। সরকার শিক্ষা, ডিজিটাল উন্নয়ন, শাসন সংস্কারের জন্য কমিশন করে, কিন্তু সম্পদের অসম বণ্টন, শ্রমিক শোষণ বা দাতা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো কমিশন হয় না। এটা ভুল নয়। লিবারেল নিয়ম মেনেই সব চলে। যেকোনো সংস্কার হবে, কিন্তু মূল অর্থনৈতিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকবে।

ভারতে নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, ভিন্নমত দমন আর কর্পোরেটকরণ চলছে প্রকাশ্যে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভোট আর বাজারের আড়ালে একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটছে।

পাকিস্তানে গণতন্ত্র মানে সামরিক গোয়েন্দাদের ছায়ায় সরকার পালাবদল। অর্থনীতি আইএমএফের হাতে, পররাষ্ট্রনীতি সেনাদের হাতে। বাহ্যিক গণতন্ত্র আছে, ভিতরে ফাঁকা।

মিয়ানমারে কিছুদিন ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তর’এর গল্প শোনা গেল। তারপর সেনা অভ্যুত্থানে সব শেষ। পশ্চিমা মডেল অর্থনীতি খুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশটা থেকে গেছে স্থানীয় অভিজাতদের হাতে।

এই সব দেশে লিবারেল ডেমোক্রেসি সমস্যার সমাধান নয়, বরং সময় কেনার কৌশল। জনগণকে বলা হয়, ধৈর্য ধরো। পরের নির্বাচনের অপেক্ষা করো, ধাপে ধাপে সব ঠিক হবে। অথচ জমি দখল, শ্রম শোষণ, জাতি-ধর্মের নিপীড়ন, পরিবেশ ধ্বংস অব্যাহত থাকে।

এই মডেলকে আন্তর্জাতিক দাতা আর সংস্থা সমর্থন করে। কোটি কোটি টাকা ঢালা হয় ‘গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে’। কিন্তু সেই অর্থই শেষমেষ সেই অর্থনীতি ও দমনমূলক শাসনকে টিকিয়ে রাখে।

লিবারেল ডেমোক্রেসি ব্যর্থ স্বপ্ন নয়, বরং একটা সাজানো মায়া। এটা ন্যায়ের ভাষায় কথা বলে, কিন্তু প্রকৃত ন্যায়বিচার যেন না আসে — সেটা নিশ্চিত করে।

ট্রাম্প একদিকে শ্বেত জাতীয়তাবাদী ও পপুলিস্ট, অন্যদিকে মূলধারার গণতন্ত্রেরই বিকৃত রূপ। এলন মাস্কও আজকের উদার গণতন্ত্রের পরিণতি। তিনি বিদ্রোহের ভান করেন, কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো অটুট রাখেন।

পশ্চিমে সংকট—চরম দক্ষিণপন্থার উত্থান ও উদার গণতন্ত্রের পতন

পশ্চিমে চরম ডানপন্থা গণতন্ত্রকে দখল করছে না। বরং উদার গণতন্ত্র নিজেই ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নিচ্ছে। বহু বছর ধরে এটি স্থিতিশীলতা ও ধীর উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বলেছে, মধ্যপন্থাই চরমপন্থার প্রতিষেধক। কিন্তু আজ সেই ‘মধ্যমার্গ’ ভেঙে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ডানপন্থীরা আর প্রান্তিক নয়। তারা ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসছে, নীতি ঠিক করছে, বিতর্কের দিক পাল্টাচ্ছে। আর এসব করছে গণতন্ত্রের ভেতর দিয়েই। যেসব প্রতিষ্ঠান একসময় গণতন্ত্রের রক্ষক ছিল, এখন তারাই স্বৈরশাসক পপুলিস্ট, ধনী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা আর ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে বৈধতা দিচ্ছে।

ট্রাম্প এর বড় উদাহরণ। তিনি একদিকে শ্বেত জাতীয়তাবাদী ও পপুলিস্ট, অন্যদিকে মূলধারার গণতন্ত্রেরই বিকৃত রূপ। এলন মাস্কও আজকের উদার গণতন্ত্রের পরিণতি। তিনি বিদ্রোহের ভান করেন, কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো অটুট রাখেন।

ট্রাম্প ও ইলন মাস্ক—আজকের উদার গণতন্ত্রের পরিণতি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
ট্রাম্প ও ইলন মাস্ক—আজকের উদার গণতন্ত্রের পরিণতি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ইউরোপেও একই ছবি। জার্মানির এএফডি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালি, ইতালির ব্রাদার্স অফ ইটালি বা ডাচ নেতা গির্ট ওয়াইল্ডার্স—সবাই গণতান্ত্রিক ভোটে উঠে এসে অভিবাসীদের প্রাণ অতিষ্ঠ করছে, জাতীয় পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

মধ্যপন্থীরা বলছে, এগুলো গণতন্ত্রের হুমকি। কিন্তু এ সংকট তৈরি করেছে তারাই। কঠোর অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর শাসন মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। চরম দক্ষিণপন্থা সেই শূন্যতা কাজে লাগিয়েছে।

কিন্তু এরা অল্প কয়েকজনের দুনিয়ার মালিক হয়ে যাওয়ার বিরোধী নয়। তারা শুধু জনরোষকে অভিবাসী, নারী অধিকার বা সংখ্যালঘুদের দিকে ঘুরিয়ে দেয়—যাতে প্রকৃত অর্থনৈতিক কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকে।

আজকের উদার গণতন্ত্র আর আস্থা জাগাতে পারে না। এটি এখন টিকে আছে বিরোধী কণ্ঠ দমন, শক্তিশালী নেতাদের ক্ষমতা বাড়ানো, আর একই সঙ্গে ‘আমরা আক্রমণের শিকার’ দাবি করার ভরসায়।

এ কারণেই আমরা যে সংকট দেখছি, তা ব্যতিক্রম নয়। এটাই উদার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পরিণতি। বহুদিন ধরে যেটি সভ্যতা, অধিকার ও পছন্দের আড়ালে লুকিয়েছিল, আজ তা প্রকাশ পাচ্ছে।

অধিকারের ধোঁয়াশা

মতাদর্শের আসল কাজ ভুল উত্তর দেওয়া নয়, বরং প্রশ্নটাই এমনভাবে সাজানো যাতে সত্যিকার উত্তর দেওয়া না যায়।

আমাদের শেখানো হয়, উদার গণতন্ত্রই নাকি সেরা ব্যবস্থা। এটাই স্বাধীনতা, মানবাধিকার, প্রতিনিধিত্ব আর আইনের চোখে সমতা নিশ্চিত করে। কিন্তু এগুলো কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতি মাত্র। বাস্তবে জীবনে কোথাও নাগরিকদের মধ্যে সমতা নেই।

আসলে উদার গণতন্ত্র ন্যায়বিচারের পথ নয়।

তুমি ভোট দিতে পারো, কিন্তু বাসস্থানের নিশ্চয়তা নেই।

তুমি কথা বলতে পারো, কিন্তু সেই কথা প্রচারের নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেট অ্যালগরিদমের হাতে।

তুমি প্রতিবাদ করতে পারো, কিন্তু সেটা হবে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে, নজরদারির মধ্যে।

তুমি আইনের চোখে সমান, কিন্তু আইন বানায় ধনীরা, তাদের স্বার্থেই।

এভাবেই উদার গণতন্ত্র আমাদের মনে করায় আমরা ক্ষমতাবান। কিন্তু সে প্রকৃত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের দরজা বন্ধ রাখে। রাজনৈতিক অধিকার অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে আলাদা থাকতে পারে, এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর নেই। না খেতে পেয়ে বউ-বাচ্চাসহ আত্মহত্যা করা মানুষটাকেও আমরা স্বাধীন বলি।

চীন কোনো পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নয়। বহুদলীয় নির্বাচনও নেই সেখানে। তবু চীন দারিদ্র্য কমিয়েছে, টানা প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, বিশ্বশক্তি হয়েছে।

লিবারেল ডেমোক্রেসি কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। সে বরং সফল। কারণ সে অবিচারকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে দেখায়। যৌথ প্রতিরোধ ভেঙে দেয়। সে আমাদের বিশ্বাস করায় যে দারিদ্র্য আমারই দোষ। আর ব্যাংক লুট করে সফলতা আমার যোগ্যতার পুরস্কার।

তাই ডানপন্থার উত্থান আসলে উদার গণতন্ত্রের বিরোধিতা নয়—তার বিকৃত রূপ। মাস্ক বা ট্রাম্প সত্যিকার বিকল্প নয়। তারা খোলাখুলি বলে দেয় সেই শ্রেণিবিন্যাসের কথা যেটি উদার গণতন্ত্র আড়ালে রাখে।

মাস্ক প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদী ধারণা ছড়াতে পারে। কিন্তু মিডিয়া তাকে বিপ্লবী বানিয়ে দেখায়। তাঁর বিদ্রোহ কেবল বাহ্যিক। ভেতরের কাঠামো অটুট থাকে।

অন্যদিকে, বাসস্থান, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা বা জমির গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মতো প্রকৃত অর্থনৈতিক দাবিকে বলা হয় ‘অবাস্তব’ বা ‘স্বৈরাচারী’। যতক্ষণ তুমি ক্ষমতার কাঠামো বদলাতে চাইছ না, ততক্ষণ তোমাকে চিৎকার করতে দেওয়া হবে।

উদার গণতন্ত্র ধ্বসেপড়ছে ভাবলে ভুল হবে। সে তার ঐতিহাসিক কাজ শেষ করছে। আর এই কাজ হোল এই অল্প কিছু লোকের সব কিছুর মালিক হওয়ার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করা, প্রতিবাদকে নিরাপদ প্রথায় পরিণত করা এবং কিছু না বদলানো। রাজনীতিকে এক গোলকধাধায় ফেলে এক নাটক বানিয়ে ফেলা।

উদার গণতন্ত্র কি মৃত্যুপথযাত্রী? অপরিহার্যতার মিথ ও চীনের ব্যতিক্রম

শীতল যুদ্ধের পর থেকে উদার গণতন্ত্র শুধু শক্তির জোরে নয়, বয়ানের জোরেও শাসন করেছে। গল্পটা ছিল—ইতিহাসের শেষ গন্তব্য নাকি এখানেই। উন্নতি চাইলে বাজার খুলতে হবে, নির্বাচন করতে হবে, অধিকার মানতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব বলেছে, আর কোনো বিকল্প নেই।

এ মিথ বহু বছর টিকে ছিল। কিন্তু এখন তা ভেঙে পড়ছে। আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ চীন।

চীন কোনো পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নয়। বহুদলীয় নির্বাচনও নেই সেখানে। তবু চীন দারিদ্র্য কমিয়েছে, টানা প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, বিশ্বশক্তি হয়েছে। অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য উদার গণতন্ত্র অপরিহার্য—এই বিশ্বাস ভেঙে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে বরং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ আরও কার্যকর হতে পারে।

এতে গ্লোবাল সাউথের সামনে বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—যদি উন্নয়নের জন্য পশ্চিমা মডেল কি জরুরি? যদি চীন উদার গণতন্ত্র ছাড়াই হাই-স্পিড রেল, আধুনিক শিল্প আর অবকাঠামো বানাতে পারে, তবে বাংলাদেশ, ঘানা বা বলিভিয়াকে কেন আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের শর্ত মেনে চলতে হবে?

চীন পশ্চিমের কাছে হুমকি তার সেনাবাহিনীর জন্য নয়, তার উদাহরণের জন্য। চীন দেখিয়েছে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ অবিচ্ছেদ্য নয়। অন্য পথও সম্ভব।

চীন কোনো পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নয়। ছবি: সংগৃহীত
চীন কোনো পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নয়। ছবি: সংগৃহীত

এতে পশ্চিমের ভণ্ডামিও ফাঁস হয়েছে। যারা বেইজিংয়ের মানবাধিকার নিয়ে সরব, তারাই গাজায় গণহত্যায় অর্থায়ন করে, ভূমধ্যসাগরে সীমান্ত সামরিকায়ন করে, হুইসলব্লোয়ারদের জেলে পাঠায়।

এখানে পরিষ্কার থাকা দরকার যে চীনের মডেল নিখুঁত নয়। এর কর্তৃত্ববাদ বাস্তব। কিন্তু এটি পশ্চিমের ‘আমরাই একমাত্র পথ’ এই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।

যদি উদার গণতন্ত্র সত্যিই অপরিহার্য হয়, তবে কেন তা পশ্চিমেই ধ্বসে পড়ছে? কেন তাদের টিকে থাকতে সেন্সরশিপ, নজরদারি, কর্পোরেট প্রচারণা দরকার হচ্ছে? কেন খোদ পশ্চিমা নাগরিকরা ফ্যাসিবাদ আর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দিকে ঝুঁকছে?

সম্ভবত সত্যটা আরও ভয়ানক। উদার গণতন্ত্র বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেই মরছে। এর প্রতিষ্ঠান ফাঁপা, প্রতিশ্রুতি শেষ, মতাদর্শ ভেঙে পড়েছে, আর পশ্চিমা পুঁজির অর্থনীতি নিজেই মৃতপ্রায়।

হয়তো এর পর আসবে নতুন কর্তৃত্ববাদ, ডিজিটাল সামন্তবাদ বা পরিবেশ বিপর্যয়। আবার খুলতে পারে মুক্তির পথও। যেখানে আমরা পশ্চিমা ছায়ার বাইরে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রকে নতুনভাবে কল্পনা করব।

এখন প্রশ্ন আর ‘উদার গণতন্ত্র টিকবে কি না’ তা নয়। প্রশ্ন হলো—আমরা কি এর বাইরে কিছু ভাবার সাহস করব?

উদার গণতন্ত্রের বাইরে

আজকের কাজ গণতন্ত্রকে ত্যাগ করা নয়—বরং একে উদারপন্থার খোলস থেকে মুক্ত করা।

উদার গণতন্ত্রের পতন কোনো দুর্ঘটনা নয়। পুঁজির শাসনকে গণতন্ত্রের নামে বৈধতা দেওয়ার ঐতিহাসিক কাজ শেষ। আজ এর অধিকার, আইন, প্রতিষ্ঠান—সবই যেন ফাপা প্রথা। আসল সত্য আড়ালে থাকে—ধনীদের শাসন, দারিদ্র্য, নজরদারি আর ক্রমেই খারাপ হতে থাকা জীবনযাত্রা।

উদার গণতন্ত্র কোনো পবিত্র ব্যবস্থা নয়। এটি ইতিহাসের এক ধাপ। একে পার হওয়া সম্ভব। গণতন্ত্র মানেই লিবারেলপন্থা— এই ভুল ধারণা নতুন ভবিষ্যৎ কল্পনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

কিন্তু বিকল্প কেমন হতে পারে? তা হতে পারে স্থানীয় গণপরিষদ, শ্রমিক সমবায়, ভূমি পরিষদ বা কমিউনিটির ফেডারেশন। হতে পারে প্রবৃদ্ধির গল্পের বদলে বদলে প্রকৃতির পুনর্জাগরণ, প্রতিযোগিতার বদলে সহমর্মিতা, একক ভোগের বদলে যৌথ সিদ্ধান্তের অগ্রাধিকার। হতে পারে এমন অর্থনীতি যেখানে গ্লোবাল সাউথের সম্পদ লুট হয়ে উত্তর গোলার্ধের বিলাসিতা মেটাবে না।

সবচেয়ে জরুরি যা তা হোল, এই ভবিষ্যৎ হতে হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক—মানুষের হাতে নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত, জীবন্ত ও অংশগ্রহণমূলক। গণতন্ত্র কোনো ব্র্যান্ড নয়, কোনো রপ্তানি করবার পণ্য নয়। এটি শুধু নির্বাচন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়। এটি এক চলমান প্রক্রিয়া যা প্রতিটি প্রজন্মকে নতুন করে গড়ে তুলতে হয়।

আজ যখন ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা, ব্রাসেলস থেকে দিল্লি—সর্বত্র ‘উদার গণতন্ত্র’ ধ্বসে পড়ছে, তখন সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় আমরা ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র আর জাতীয়তাবাদী অবক্ষয়ের অন্ধকারে ডুবে যাব। নয়তো আমরা এই ভাঙনকে ব্যবহার করব রাজনীতিকে নতুন করে, নিচ থেকে গড়ার সুযোগ হিসেবে।

গণতন্ত্রকে পুরোনো রূপে বাঁচিয়ে রাখার সময় শেষ। এখন তাকে নতুন রূপে গড়ার সময়। এই উদার গণতন্ত্রের পতনে শোক করার কিছু নেই। আফসোস বরং এই জন্য যে—আমরা একসময় ভেবেছিলাম, এটাই একমাত্র পথ।

লেখক: লেখক ও অনুবাদক

Ad 300x250

সম্পর্কিত