leadT1ad

মিয়ানমারে চীনের নয়া সমীকরণ: তবে কি ফ্যাসিবাদকেই বরণ?

চীনের সাম্প্রতিক মিয়ানমার-নীতি স্পষ্ট করে দিয়েছে—বেইজিং স্থিতিশীলতার নামে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জান্তাকে বাঁচাতে দ্বিধা করছে না। কিন্তু এই সমর্থন শেষ পর্যন্ত কি শান্তি আনবে, নাকি গৃহযুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করবে? আজ বিশ্ব গণতন্ত্র দিবসে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেত তার মং-এর মতামতে জানুন এসব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর।

স্ট্রিম ডেস্ক
মিয়ানমারে চীনের নয়া সমীকরণ: তবে কি ফ্যাসিবাদকেই বরণ? সংগৃহীত ছবি

গত ৩ সেপ্টেম্বর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয় স্মরণে চীন এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নানজিং গণহত্যার মতো নৃশংসতার শিকারদের সম্মান জানানো। কিন্তু এক নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো সেখানে উপস্থিত ছিলেন মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। নিজ দেশের জনগণের ওপর দমন-পীড়ন ও সহিংসতার চলমান অভিযানের হোতা হওয়া সত্ত্বেও লাল গালিচায় মিন অং হ্লাইং-এর উপস্থিতি প্রতিটি চীনা নাগরিকের জন্য এক লজ্জাজনক মুহূর্ত।

২০২৪ সালের আগস্ট থেকেই বেইজিং মিয়ানমারের বিপর্যস্ত জান্তা সরকারকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। চার বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় ছিল মিন অং হ্লাইং-এর জান্তা সরকার। এমতাবস্থায় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন এবং বেইজিংয়ের সামরিক কুচকাওয়াজের মতো হাই-প্রোফাইল ইভেন্টে আমন্ত্রণ পাওয়া মিন অং হ্লাইং-এর জন্য এক বিরাট কূটনৈতিক বিজয়।

মিয়ানমার জান্তার প্রতি চীনের অবস্থান

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যন্তরীণভাবে ভাঙনের মুখে পড়েছিল এবং উত্তর-পূর্বের লড়াইয়ে প্রতিরোধ শক্তিগুলো ক্রমশ জমি খুঁজে পাচ্ছিল। এমন সংকটময় মুহূর্তে চীনের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আবারও জটিল করে তুলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং যদি তার সমর্থন দিতে সামান্য দেরি করত তবে তা সেনাবাহিনীর ভেতরেই নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটাতে পারত এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটভূমিতে ব্যাপক রদবদল ঘটার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে চীন মিন অং হ্লাইংকে সমর্থন করার পথ বেছে নেয় এবং ক্ষমতা সংহত করতে সাহায্য করে।

অনেকেই মনে করেন, চীনের এই সমর্থনের পেছনে কাজ করছে এক গভীর ভয়। সামরিক বাহিনীর পতন ঘটলে মিয়ানমার বিশৃঙ্খলায় ডুবে যেতে পারে, যা বেইজিংয়ের ভূ-কৌশলগত স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবে। কিন্তু মিন অং হ্লাইংকে এতটা প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্তও এক গভীরতর উদ্দেশ্যের দিকেই ইঙ্গিত করে।

তিয়ানজিনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার স্ত্রী পেং লিয়ুয়ানের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ছবি: সংগৃহীত
তিয়ানজিনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও তার স্ত্রী পেং লিয়ুয়ানের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বৃহত্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ হিসেবে জান্তাকে একটি প্রক্সি শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার কৌশলেরই প্রতিফলন মনে করছেন অনেকে। পাশাপাশি একটি অনুগত সরকারের মাধ্যমে মিয়ানমারের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরে নিজের কৌশলগত অবস্থান পাকা করতে চাইছে চীন। মিয়ানমারের সামরিক বা রাজনৈতিক কাঠামোতে যেকোনো পরিবর্তন বেইজিংয়ের প্রভাব ধরে রাখার ক্ষমতাকে বিপদে ফেলতে পারে।

মিন অং হ্লাইং-এর সাম্প্রতিক সফরে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সমর্থনের বিনিময়ে জান্তা সরকার বেইজিংয়ের প্রস্তাবিত যেকোনো প্রকল্প অনুমোদন করতে এবং যেকোনো জাতীয় সম্পদ বিশাল ছাড়ে বিক্রি করতে প্রস্তুত। এমনকি এই শাসকগোষ্ঠী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থাকা সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য চীনের কাছে আবেদনও জানিয়েছে। মিন অং হ্লাইং বেইজিংয়ের সহায়তার জন্য প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার যে প্রস্তুতি জান্তা দেখিয়েছে, তাতে যদি ভবিষ্যতে দেশটির কোনো একটি বড় অংশ চীনের প্রভাব বলয়ের অধীনে চলেও যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ছায়া রাজনীতির খেলা

৩ সেপ্টেম্বরের কুচকাওয়াজের সময় চীন ঘোষণা করে, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য দেশকে ভয় দেখাই না বা জোর করি না।’ বাস্তবে জান্তা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী চীন তার সীমান্তের কাছাকাছি থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে এই সম্ভাবনা কম। বরং বেইজিং এই গোষ্ঠীগুলোকে জান্তা সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। যাতে মিন অং হ্লাইং-এর সরকার চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে চীনের প্রক্সি বা হাতিয়ারে পরিণত হয়।

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একটি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি চীনের সমর্থন জান্তাকে বাস্তব সুবিধা দিয়েছে। কোনো প্রকার জবাবদিহিতার ভয় ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে, কারাগারে, শহরের রাস্তায় ও গ্রামীণ জনপদে সামরিক সরকারের নৃশংস অভিযানকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। এর ফলে মিয়ানমারের মানুষের দুর্ভোগ কেবল বাড়ছেই।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে দশ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার। ১ লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট অব মিয়ানমারের (এনইউজি) মতে, কেবল ২০২৫ সালেই জান্তা সরকার, প্রমাণযোগ্য এরকম ১০৫টি গণহত্যা চালিয়েছে, যেখানে এক হাজার একাশি জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। জুলাই মাসে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাগাইং-এর মিনগুন-এ পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সদস্য সন্দেহে একজন বেসামরিক নাগরিকের শিরশ্ছেদ করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করছে জান্তা সেনারা। এই ভিডিও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখনো ভঙ্গুর। তবুও, বেইজিংয়ের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে জান্তা সরকার মনে করছে, তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং জাতিগত শক্তিগুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা আরও জোরদার করছে। যা কেবল গৃহযুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে এবং মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরও তীব্রতর করবে।

চীনের সাম্প্রতিক প্রকাশ্য সমর্থন মিন অং হ্লাইং-এর ক্ষমতার দখলকে আরও শক্তিশালী করেছে। শাসকগোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহি থেকে রক্ষা করেছে, জাতীয় সমঝোতার আশাকে নষ্ট করেছে এবং সর্বোপরি মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার যে প্রস্তুতি জান্তা দেখিয়েছে, তাতে যদি ভবিষ্যতে দেশটির কোনো একটি বড় অংশ চীনের প্রভাব বলয়ের অধীনে চলেও যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

চীনের কৌশলগত ভুল

চীন সরকার তার মিয়ানমার নীতিতে দুটি বড় কৌশলগত ভুল করেছে। প্রথম ভুলটি করেছিল ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে, যখন চীন সীমান্ত অঞ্চলে বার্মার (মিয়ানমার) কমিউনিস্ট পার্টিকে সামরিক সহায়তা প্রদান করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল কুওমিনতাং ও মার্কিন গোয়েন্দা অভিযান মোকাবিলা করা এবং বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে চীনের এই সহায়তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল।

দ্বিতীয় ভুলটি করেছে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর। জান্তা সরকারের সঙ্গে চীনের বর্তমান সম্পৃক্ততাকে অনেকেই তার আমেরিকা-বিরোধী স্নায়ুযুদ্ধের (কোল্ড ওয়ার) কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছে। আগের মতোই চীনের এই সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে যাচ্ছে বলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

চীনের সমর্থন সত্ত্বেও জান্তা সরকার দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। জোর করে লোক ধরে এনে সেনাবাহিনী ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে শৃঙ্খলা নেই, মনোবলও দুর্বল। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ আরও বাড়িয়েছে।

এসব সমালোচনার বিরুদ্ধে চীনের যুক্তি, জান্তার প্রতি তাঁদের এ সমর্থন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়, বরং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে। নির্বাচনের পর জাতীয় সমঝোতার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে চলেছে চীন। কিন্তু জান্তার কর্মকাণ্ডে সমঝোতার কোনো অঙ্গীকার দেখা যায় না। কেবল চীনের তরফ থেকে ক্রমাগত চাপই হয়তো সামরিক বাহিনীকে পথ পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। বেইজিং কি শান্তির পক্ষে চাপ দেবে, নাকি স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন জুগিয়ে যাবে—তা ২০২৬ সালের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

• দ্য ইরাবতীতে প্রকাশিত মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেত তার মং-এর মতামত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত