leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস

গণতন্ত্রের যাত্রা: প্রাচীন গ্রিস থেকে আজকের পৃথিবী

স্ট্রিম ডেস্ক
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস

আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। জাতিসংঘ ২০০৭ সালে সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে ১৫ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস ঘোষণা করে। প্রথমবার এটি পালিত হয় ২০০৮ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছর ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ, সংগঠন ও গণমাধ্যমে গণতন্ত্রের গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা ও কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘Ensuring effective governance of AI at all levels’ তথা ‘সকল স্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা’। এই দিনে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকে নাগরিক অধিকার, অংশগ্রহণ আর রাষ্ট্রের জবাবদিহি। তবে গণতন্ত্রের এই দীর্ঘ যাত্রা কেবল আজকের নয়—হাজার বছরের ইতিহাস আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে।

শুরুটা প্রাচীন গ্রিসে

গণতন্ত্রের ইংরেজি শব্দ ডেমোক্রেসি এসেছে গ্রিক ভাষার ডেমোস ও ক্রাটোস শব্দ থেকে। ডেমোস মানে জনগণ, ক্রাটোস মানে শাসন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিসের এথেন্স নগররাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রথম কাঠামো দেখা যায়। নাগরিকরা সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতেন, বিতর্ক করতেন, ভোট দিতেন। তবে সেই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ছিল স্পষ্ট—নারী, দাস আর বিদেশিরা এই ‘জনগণ’-এর অংশ ছিলেন না।

রোম থেকে ইংল্যান্ডে

রোমান প্রজাতন্ত্র গণতন্ত্রে প্রতিনিধি প্রথার ভিত্তি স্থাপন করে। পরে মধ্যযুগে ইউরোপের রাজশক্তি বেড়ে গেলেও শহর ও নগরের স্থানীয় পরিষদে কিছু গণতান্ত্রিক ধারা টিকে ছিল। ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে ম্যাগনা কার্টা সনদ রাজার ক্ষমতাকে সীমিত করে। এটি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম দলিল হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।

আলোকায়ন ও বিপ্লবের ঢেউ

১৭ থেকে ১৮ শতকে ইউরোপের আলোকায়ন যুগ রাজনৈতিক চিন্তাকে আমূল বদলে দেয়। দার্শনিকরা যুক্তি, স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর সামাজিক চুক্তির ধারণা সামনে আনেন। এই ধারার ফলেই জন্ম নেয় আমেরিকান বিপ্লব (১৭৭৬) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)। এই দুই বিপ্লবে সমতা, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করা হয়।

উপনিবেশ ভাঙন ও বৈশ্বিক বিস্তার

১৯ শতকজুড়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ধীরে ধীরে ভোটাধিকার বিস্তৃত হয়। প্রথমে ধনীদের জন্য, পরে শ্রমিক, নারী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাদের অনেকেই গণতন্ত্রকে গ্রহণ করে জাতীয় শাসনব্যবস্থার মূলনীতি হিসেবে।

স্নায়ুযুদ্ধ শেষে পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়।

আজকের পৃথিবীতে গণতন্ত্র

আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। তবে গণতন্ত্রের চেহারা একরকম নয়। কোথাও সংসদীয়, কোথাও প্রেসিডেন্সিয়াল, কোথাও আবার মিশ্র কাঠামো।

গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়। বরং এর কেন্দ্রে আছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, সংখ্যালঘু অধিকার আর নাগরিক অংশগ্রহণ।

চ্যালেঞ্জের মুখে গণতন্ত্র

তবুও আজকের বিশ্বে গণতন্ত্র নানা সংকটে। কোথাও রাজনৈতিক মেরুকরণ, কোথাও কর্তৃত্ববাদী শাসন, আবার কোথাও সামাজিক বৈষম্য গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্য, ঘৃণাবাচক প্রচারণা এবং নজরদারিও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র

বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের সংবিধান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে।

তবে বাস্তবে গণতন্ত্রের যাত্রা ছিল উত্থান-পতনে ভরা— রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং পুনরায় গণতন্ত্রে ফেরা।

বর্তমানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক মেরুকরণ, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা এবং নাগরিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। তরুণ প্রজন্ম বারবার দাবি তুলেছে অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের জন্য।

তাই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশের প্রশ্নটি হলো—কেবল আনুষ্ঠানিক নির্বাচন নয়, আমরা কি গণতন্ত্রকে সত্যিকারের অংশগ্রহণ ও জনগণের মর্যাদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি?

গণতন্ত্র কোনো স্থির কাঠামো নয়। বরং এক চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে তাই প্রশ্নটি কেবল অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও— আমরা কি গণতন্ত্রকে আরো গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারছি?

Ad 300x250

সম্পর্কিত