leadT1ad

‘প্যারা নাই, চিল’-এর দর্শন

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ২৬
‘প্যারা নাই, চিল’-এর দর্শন। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘প্যারা নাই, চিল’ দর্শনের সূচনা করেছিলেন টাক মাথার এক দার্শনিক। নাম এপিকিউরাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালে সামোসে জন্ম। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলা তেমন করেননি, পাবজি ও টিকটক তখনও আসেনি, তাই তিনি সময় কাটাতেন একটা কাজ করতেই। সেই কাজের নাম ‘ভাবনা’। আর ভাবতে ভাবতেই এপিকিউরাস বুঝলেন, মানুষ জীবনে যতকিছু পায়, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি আসলে পায় ভয়। যুদ্ধের ভয়। দেবতাদের ভয়। মৃত্যুর ভয়। অর্থাৎ, তখনকার যুগেও অফলাইনে সবচেয়ে বড় গ্রুপ ছিল ‘ভয়-ফোবিয়া-প্যারানইয়া’ নামক গ্রুপ।

এই ভয় থেকে দূরে থাকতে এপিকিউরাস অ্যাথেন্সে এসে একটা বাগান বানালেন। বাগানে নিয়ে আসলেন বই, বন্ধু, আর কিছু সাধারণ খাবার। সেখানে কেউ আসলো পড়াশোনা করতে, কেউ আসলো খেতে, কেউ শুধু আসলো একটু ওয়াইন খেয়ে ‘চিল’ করতে। আজকের দিনে হলে এটাকে বলতাম ‘প্যারা নাই জোন’।

এপিকিউরাস শিখিয়েছিলেন, সুখ মানে শুধু কাবাব-চিকেন-বার্গার না। সুখ মানে ভাত-ডাল আর ভালো ঘুম। শরীরের চাহিদায় প্লেজার আছে, কিন্তু সেটা সীমিত। যেমন, দুইটা ফুচকা খেলেই সুখ পাওয়া যায়, তার মানে এই না যে চল্লিশটা খেলেই সুখ বিশগুণ হবে। বরং চল্লিশটা খেললে হাসপাতাল ভর্তির বিল দেখে চোখে জল আসবে। এপিকিউরাস তিন ভাগে সুখকে ভাগ করলেন।

প্রথমত, শারীরিক সুখ
ঘুম, খাওয়া, ঠান্ডা বাতাস। একেবারে সিম্পল। আজকের দিনে তিনি থাকলে হয়তো লিখতেন, ‘নেটফ্লিক্স দেখো, কিন্তু পুরো সিজন এক রাতেই শেষ করার দরকার নাই।’

দ্বিতীয়ত, মানসিক সুখ
বন্ধু। আড্ডা। হাসি। সেই সুখের জন্য এপিকিউরাসের বাগানটা ছিল মূলত একরকম ‘চিল স্পট’। কেউ এসে কথা বলছে রাজনীতি নিয়ে, কেউ বলছে প্রেমের কষ্ট নিয়ে। তবে ফেসবুকের মতো কেউ কাউকে আনফ্রেন্ড করে না। কেউ কাউকে ট্রলও করে না।

তৃতীয়ত, ভয় থেকে মুক্তি
এপিকিউরাস বলতেন—'ভয় জীবনকে মেরে ফেলে।’ আজকের বাংলাদেশি কনটেক্সটে বললে, ‘পরীক্ষার ভয়, ট্রাফিকের ভয়, নির্বাচনের ভয়, চাকরির ইন্টারভিউর ভয়’ এসব ছেড়ে দাও। জীবন ছোট। একদিন সেলেব্রেটেড হবা, পরদিন হয়তো আর এক্সিস্টই করবা না, আজাইরা প্যারা নিয়া কি লাভ?

এ কারণেই এপিকিউরাসের হাজার বছর আগের দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক। তখনও মানুষ টেনশনে মরতো, আর এখনো মানুষ টেনশনে মরে। তখনও শান্তির দরকার ছিল, এখনো শান্তির দরকার আছে। তফাৎ শুধু এখন শান্তির জন্য মানুষ মেডিটেশন অ্যাপে সাবস্ক্রিপশন কেনে, আর এপিকিউরাস কিনতেন সস্তা ওয়াইন।

এসবের বাইরে এপিকিউরাসের সবচেয়ে কনট্রোভার্শিয়াল আইডিয়া ছিল মৃত্যু নিয়ে। তিনি বললেন, ‘যতক্ষণ আমরা আছি, ততক্ষণ মৃত্যু নাই। যখন মৃত্যু আসবে, তখন আমরা নাই। তো, ভয় কিসের?’
শুনতে অনেকটা মিমের মতো লাগে: ‘চিন্তা করিস না, ব্রো, আমরা বেঁচে থাকা পর্যন্ত মরবো না।‘

এখন আসি মার্ক্সে। কারণ যেকোনো দার্শনিক আলোচনার শেষে মার্ক্স না এলে আমাদের সেকেন্ড ইয়ার ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের পোলাপান ও বামপন্থী বন্ধুরা খুবই রাগ করবে। কার্ল মার্ক্স জীবনে এক সময় সিরিয়াসলি এপিকিউরাসকে পড়েছিলেন। তার প্রথম দিকের লেখাগুলোর মধ্যে একটার নামই হলো ‘ডিফারেন্স বিটুইন দ্য ডেমোক্রিটিয়ান অ্যান্ড এপিকিউরিয়ান ফিলোসফি অব নেচার’। শুনলেই বোঝা যায়—ভদ্রলোক তরুণ বয়সেও একেবারে জ্ঞানপাপী মুডে ছিলেন!

এপিকিউরাসের কাছ থেকে মার্ক্স নিলেন একটা জিনিস—জীবনে চাহিদা বেড়ে গেলে প্রকৃত শান্তি উড়ে যায়!
এপিকিউরাস বলেছিলেন, সীমিত খাও, সীমিত আশা করো, তাহলেই আর প্যারা নাই।
মার্ক্স বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে অল্পে সুখে থাকতে দেবে না। ওরা জোর করে তোমাকে বড় বাসা, বড় গাড়ি, বড় লোন এর মধ্যে ঠেলে দেবে। তারপর তুমি ফেসবুকে লিখবে—জীবন মানেই যন্ত্রণা।’

এপিকিউরাস শিখিয়েছিলেন ভয় দূর করতে। মার্ক্স বললেন, ভয় দূর করতে হলে সিস্টেমটাই বদলাতে হবে।

বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে এই দার্শনিক এলে হয়তো এমন এক দৃশ্য তৈরি হতো: এপিকিউরাস বসে আছেন ধানমন্ডি লেকে। সামনে চা আর মুড়ি। পাশে দুইজন বন্ধু হাসাহাসি করছে। তিনি বলছেন—'এই দেখো, এটাই সুখ। এক কাপ চা। একমুঠো মুড়ি। আর ফ্রেন্ডশিপ।’
পাশেই হঠাৎ এক লোক এসে বলল—'স্যার, একটা সিগারেট খাবেন?’ এপিকিউরাস শান্তভাবে উত্তর দিলেন— ‘ভাই, ওটা অতিরিক্ত আনন্দ। ওটার পরে কাশি আসবে। সুখ থাকবে না।’

ধরুন, আপনি ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছেন, তখন পাশের সিটে বসা এপিকিউরাস আপনাকে বলবে: ‘ভাই, তুমি তো মরছো না। বেঁচে আছো। চারপাশে এত হর্ন, এটাও একরকম সংগীত। চিল করো।’

এপিকিউরাস বন্ধুত্বকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। আজকের দিনে হলে তিনি হয়তো বলতেন,‘তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে পাঁচ হাজার ফ্রেন্ড রাখার দরকার নাই। অনেক কম থাকলেও চলে। খেয়াল রেখো, ওরা যেন শুধু রিঅ্যাক্ট না দিয়ে, তোমার বিপদে পাশে থাকে।’

এভাবে, প্যারা নাই চিল দর্শনের সূচনা যেখানে, সেখানে দাঁড়িয়ে এপিকিউরাস মূলত আমাদেরকে বলেন, ‘ভাই, বেশি ভাবিস না, ফুচকা খা, ঘুমা, বন্ধুদের সঙ্গে বাজে গল্প মার। এপিকিউরাসের কাছে সরলতা মানে হলো—গরুর মাংসের দাম দেখে কান্না না করে ডাল-ভাত খেয়ে খুশি থাকা। ভয়হীনতার মানে হলো- বিদ্যুৎ চলে গেলে, প্যানিক না করে প্রাকৃতিক বাতাসের কদর করতে পারা।

এপিকিউরাসের দর্শন আমাদের দেখায়, ইতিহাস কেবল রাজনীতি, হত্যা, আর নাটক না, ইতিহাস হলো বেকার লোকেদের আড্ডা দেওয়ার পুরনো ঐতিহ্য। সেখানে ছোট আনন্দ মানে হলো, বাফার জোনেও ওয়াইফাই সিগনাল পাওয়া।

এ কারণেই এপিকিউরাসের হাজার বছর আগের দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক। তখনও মানুষ টেনশনে মরতো, আর এখনো মানুষ টেনশনে মরে। তখনও শান্তির দরকার ছিল, এখনো শান্তির দরকার আছে। তফাৎ শুধু এখন শান্তির জন্য মানুষ মেডিটেশন অ্যাপে সাবস্ক্রিপশন কেনে, আর এপিকিউরাস কিনতেন সস্তা ওয়াইন।

এভাবে, ‘প্যারা নাই চিল দর্শন’-এর প্রবক্তা এপিকিউরাস মূলত বলেন, ‘ভাই, জীবন ছোট, ফ্রিজে যা আছে খেয়ে ফেলো। বন্ধুরা থাকলে সেলফি তোলো। ভয় পেলে ইনবক্সে মেসেজ করো। প্যারা খাওয়া ইতিহাসে নতুন কিছু না। শুধু এখন ওটা ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই যা পার্থক্য!

Ad 300x250

সম্পর্কিত