leadT1ad

পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু থামছে না, বাস্তবায়ন হয়নি ৩০৪ কোটি টাকার প্রকল্প

শিশুমৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ পানিতে ডোবা, নেই কার্যকর প্রতিকার

ফারুক হোসাইনঢাকা
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৩৭
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৫, ২১: ৩১
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম ৬ দিনে দেশে পানিতে ডুবে ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মৃত্যুর এ সংখ্যাটা বের করেছে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। সংখ্যাটা আদতে আরও বেশি। দেশে প্রায় প্রতিদিনই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তবে এই নিয়ে সরকারের উদ্যোগ থাকলেও আছে গাছাড়া ভাব।

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে ২০২২ সালে একটি প্রকল্প নিয়েছিল মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। নির্ধারিত সময় শেষে কাজ হয়েছে অর্ধেক। তাই বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ।

২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে ১ থেকে ৯ বছরের শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু। আর মৃত্যুর ঘটনাগুলো সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত জলাধারে ঘটে। সাধারণত দিনের প্রথম ভাগে ঘটনাগুলো ঘটে। শহরের তুলনায় গ্রামে পানিতে ডুবে ‍মৃত্যুর ঘটনা বেশি। এসব মৃত্যু প্রতিরোধেই মূলত ওই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।

শিশু মৃত্যুর চতুর্থ বড় কারণটি পানিতে ডুবে যাওয়া। দেশের পল্লী অঞ্চলে ৭.৪৫ শতাংশ শিশু মৃত্যুর কারণ এটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর। সেগুলো হলো ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশু-যত্নের সুযোগ সৃষ্টি, ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বাড়ানো ও শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো। সরকারের গৃহীত প্রকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৌশল বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল। প্রকল্পের ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যানে (ডিপিপি) এমনটিই বলা হয়।

ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিজ, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি চালু হয়েছিল। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির ৫২ শতাংশ কাজ শেষ হয়। পরে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

পানিতে ডুবে মৃত্যু একটি নীরব মহামারি, যা প্রতিদিনই অগণিত প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের জীবন রক্ষায় সাশ্রয়ী প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন এখনই জরুরি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুকে রুখে দিতে পারি। আমিনুর রহমান, পরিচালক, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাওনিং প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ডিভিশন, সিআইপিআরবি

এ প্রকল্পের আওতায় ১৬টি জেলায় ৮ হাজার ২০টি শিশুযত্নকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। জেলাগুলো হলো বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, নরসিংদী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ।

এসব জেলার ৪৫টি উপজেলায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ৮ হাজার সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্নকেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা করার কথা। যার আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়া হবে। প্রকল্প কার্যালয় বলছে, ৮ হাজার ২০টি শিশুযত্নকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ২ লাখ ৫০০ শিশুকে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

একই প্রকল্পে ৬-১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। তবে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৫ হাজার ২০৪ শিশু সাঁতার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছরে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৬ শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৬০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

প্রকল্পের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে গত বুধবার (২৩ জুলাই) বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে গিয়ে মহাপরিচালক দিলারা বেগমকে পাওয়া যায়নি। আর প্রকল্প পরিচালক আব্দুল কাদির বলেছেন, ‘কাজ বেশ এগিয়েছে। এ বছরের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে আশা করছি।’

বাংলাদেশে বছরে ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃতদের ৮০ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশেরই বয়স ৪ বছরের নিচে।

সরকারি প্রচেষ্টা কম

বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে (২০২৩)’ দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩৫ শতাংশই নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এছাড়া শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতায় ১৩.৮৪ শতাংশ ও অন্যান্য জ্বরে ৮.২৮ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। শিশু মৃত্যুর চতুর্থ বড় কারণটি পানিতে ডুবে যাওয়া। দেশের পল্লী অঞ্চলে ৭.৪৫ শতাংশ শিশু মৃত্যুর কারণ এটি।

এর বাইরে অপুষ্টি, জন্ডিস ও ডায়রিয়ার মতো রোগেও শিশুদের মৃত্যু হয়। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ ও তৎপরতা দেখা যায়। তবে পানিতে ডোবার বিষয়টি অবহেলিত বলেই মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রচেষ্টা এবং সফলতা আছে। কিন্তু পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে সে প্রচেষ্টা খুব কম।’

এমন পরিস্থিতিতেই শুক্রবার (২৫ জুলাই) পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস। ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়।

পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু বাড়ে মূলত বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)। শিশুদের ডুবে যাওয়ার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে।

এসডিজির লক্ষ্য পূরণেও সংশয়

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) তৃতীয় অভিষ্টে ২০৩০ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার ২৫–এর নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা আছে। তবে এই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ এখনো বেশ দূরে আছে।

২০২৩ সালের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে দেখা গেছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৩২.৭০ জন। ২০২২ সালের তুলনায় এ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ওই বছরের জরিপে শিশু মৃত্যুর হার পাওয়া গিয়েছিল হাজারে ৩০.৬৮ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করতে হবে। তা ছাড়া এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণও কঠিন হয়ে পড়বে।

মৃত্যু থামাতে সম্মিলিত উদ্যোগের তাগিদ

পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ২০১৬ সালে বড় আকারে জরিপ চালিয়েছিল সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। সেই জরিপের ফলাফল এখনো প্রাসঙ্গিক বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

ওই জরিপে উঠে এসেছিল, বাংলাদেশে বছরে ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃতদের ৮০ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশেরই বয়স ৪ বছরের নিচে।

সিআইপিআরবির গবেষকরা বলছেন, পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু বাড়ে মূলত বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)। শিশুদের ডুবে যাওয়ার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বজনরা যখন শিশুদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ঠিক তখনই অধিকাংশ শিশু আশপাশের জলাশয়ের কাছাকাছি যায় এবং পানিতে ডুবে মারা যায়। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি শিশুদের সাঁতার শেখানোর দিকে জোর দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা।

সিআইপিআরবির ইন্টারন্যাশনাল ড্রয়নিং প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ডিভিশনের পরিচালক ড. আমিনুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু একটি নীরব মহামারি, যা প্রতিদিনই অগণিত প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের জীবন রক্ষায় সাশ্রয়ী প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন এখনই জরুরি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা এই প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুকে রুখে দিতে পারি।’

Ad 300x250

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কি বলছেন রাশেদ খান

ইজারা মূল্যের কয়েক গুণ উৎকোচ দিতে হতো জেলা-উপজেলা প্রশাসনকে

ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ ৬ দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ

অনেকে বলেছে তুমি নারী হয়ে ভিপি পদে ভোট পাবে না: উমামা

রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশে বড় পরিবর্তন, নেতৃত্বে আসবেন অভিজ্ঞ কর্মকর্তার

সম্পর্কিত