leadT1ad

ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম ৬ মাসের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়েছে

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দুই হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
ডেঙ্গু। প্রতীকী ছবি

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়েছে। প্রতি মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, আর মৃত্যু হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত ৬ মাসের তুলনায় চলতি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাইরাল জ্বর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এ পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব নয়। তাঁদের পরামর্শ, আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, মৃতদের বেশিরভাগই শেষ সময়ে হাসপাতালে যান, যখন রোগ জটিল আকার ধারণ করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মৃত্যুও বেড়েছে

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গত কয়েক মাসে এটি দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৪ সালের মাসভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে ৬৪৪, জুন ৭৯৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ এবং ডিসেম্বরে ৯ হাজার ৭৪৫ জন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী স্ট্রিমকে বলেন, ‘এডিস মশা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক। মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার। বছরের শুরু থেকেই সতর্কবার্তা দেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত মশকনিধন কার্যক্রম হয়নি। ফলে শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।’

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ এবং চলতি সেপ্টেম্বরে ইতিমধ্যে ২৮ দিনেই ১৪ হাজার ৫৭৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর প্রথম ৬ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার ২৯৬ জন। আর চলতি মাসে প্রথম ২৮ দিনেই এই সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শতকরা হিসাবে এই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম ৬ মাসের তুলনায় প্রায় ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি বছর প্রথম ৮ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে ১২২ জন। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে মারা গিয়েছে ৭০ জন। মোট মারা গিয়েছে ১৯২ জন। মোট মৃত্যুর ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ চলতি মাসেই।

চিকুনগুনিয়া ও ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত রোগীর 'প্রকৃত সংখ্যা' জানা নেই। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়ার স্থান নেই, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই জ্বরে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। রোগীদের মধ্যে গিঁটে ব্যথা ও অস্বাভাবিক শারীরিক দুর্বলতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ১৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর জুনে মারা গিয়েছিলেন ৮ জন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ৩০ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৮৭ জন। সেই সময়ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা সেপ্টেম্বরে সর্বাধিক ছিল।

চলতি বছর প্রথম ৮ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে ১২২ জন। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে মারা গিয়েছে ৭০ জন। মোট মারা গিয়েছে ১৯২ জন। মোট মৃত্যুর ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ চলতি মাসেই।

চলতি মাসে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর কারণ বাড়া সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ডিএনসিসি হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সোহেল আসকার। তিনি বলেন, ‘প্রচুর রোগী আসছে। এই মুহূর্তে আমাদের হাসপাতালে গত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। গরম আবহাওয়ার কারণে বাসার আশপাশে পানি জমছে। আগামী এক মাসও যদি গরম থাকে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।’

এ ছাড়াও ডা. সোহেল আসকার বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী যদি জটিল অবস্থায় থাকে, তবে প্রথম দুই থেকে তিন ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিকটস্থ হাসপাতালে আগে যেতে হবে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে অন্যত্র স্থানান্তর করা উচিত। কিন্তু রোগীরা নিজের সিদ্ধান্তে মুভ করছেন এবং অনেকেই দূরবর্তী স্থান থেকে ঢাকায় চলে আসছেন, এটি একটি বড় সমস্যা।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশার ঘনত্ব বর্তমানে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, মশার ঘনত্ব এবং অনুকূল পরিবেশ একত্রে কাজ করছে। এ তিনটির মিলিত প্রভাবে আমাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

কার্যকর মশকনিধন না হলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি ভয়াবহ হতে পারে

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের শত্রু সবাই চিনি— মশা। একসময় শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টি এবং জমে থাকা পানিই মশার বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। তাই জমে থাকা পানি দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে— ফ্রিজের নিচে হোক, এসির পাশে, ফুলের টব, ছাদ বা রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত টায়ার। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মশকনিধন ছাড়া ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা জিকার মতো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘ডেঙ্গুর বড় সমস্যা হলো রোগীরা অনেক সময় হাসপাতালে দেরিতে আসে। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত ভর্তি হতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।’

শ্যামলী ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় এডিস মশার প্রজনন হয়। সেখান থেকেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার মতো মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রতিটি বাড়ি, অফিস ও আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, জমে থাকা পানি সরানো এবং নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম চালানো ছাড়া বিকল্প নেই। মশার বংশবিস্তার রোধই আমাদের জীবন বাঁচানোর প্রধান উপায়।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশার ঘনত্ব বর্তমানে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, মশার ঘনত্ব এবং অনুকূল পরিবেশ একত্রে কাজ করছে। এ তিনটির মিলিত প্রভাবে আমাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন স্ট্রিমকে বলেন, ‘মশকনিধনই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। যেহেতু ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত রোগ, তাই কার্যকর মশক-নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও পরিবারকেও সচেতন হতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ায় অবহেলা করা যাবে না।’

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ সব সময় বেশি থাকে। প্রতি বছরই প্রশ্ন ওঠে মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর মশক নিয়ন্ত্রণই এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিলে ডেঙ্গুর মৃত্যুহার কমানো সম্ভব

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘ডেঙ্গুর বড় সমস্যা হলো—রোগীরা অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় এবং চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। জনগণকে সচেতন করা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই এই সংক্রামক রোগ মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্ট্রিমকে বলেন, ‘ডেঙ্গু কোনো জটিল রোগ নয়। সমস্যা হলো রোগীরা জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিচ্ছেন না। দেরিতে হাসপাতালে আসায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে যাচ্ছে। বড় হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ রয়েছে, কোথাও ঘাটতির খবর পাওয়া যায়নি।’

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ সব সময় বেশি থাকে। প্রতি বছরই প্রশ্ন ওঠে মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর মশক নিয়ন্ত্রণই এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী স্ট্রিমকে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছি—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি জমতে না দেওয়া, মশার ওষুধ প্রয়োগ। জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে। তরুণদের মাঠে নামিয়েছি, ম্যাজিস্ট্রেটও মাঠে রয়েছেন। আমাদের উদ্যোগের সুফলও দেখা যাচ্ছে; শহরে রোগীর সংখ্যা কমেছে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত