leadT1ad

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ শুল্ক দ্বন্দ্বে চার মাসে যা যা ঘটল

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৫, ২০: ৩৫
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক বসানোর ঘোষণা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগে বাংলাদেশি পণ্য গড়ে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো।

চলতি বছরের ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন এ ঘোষণা দেয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের ‘বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতি’ ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সমস্ত পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশসহ প্রায় ৬০টি দেশের ওপর নির্দিষ্ট হারে আরও বেশি পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ করা হয়।

বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে আগের ১৫ দশমিক ৬ শতাংশের সঙ্গে যোগ হয় আরও ৩৭ শতাংশ।

এই ঘোষণার পরপরই বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। বাংলাদেশকেও নতুন পড়তে হয় অর্থনৈতিক চাপের মুখে ।

ওয়াশিংটন ডিসির ইউএসটিআর অফিসে বাণিজ্য উপদেষ্টা ‍শেখ বশিরউদ্দিন ইউএসটিআর রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। ছবি: সিএ প্রেস উইং
ওয়াশিংটন ডিসির ইউএসটিআর অফিসে বাণিজ্য উপদেষ্টা ‍শেখ বশিরউদ্দিন ইউএসটিআর রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। ছবি: সিএ প্রেস উইং

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া

৩ দিন পর শনিবার (৫ এপ্রিল) আরোপিত নতুন ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণায় করণীয় নির্ধারণে জরুরি বৈঠকে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কাছে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা হবে।

শেখ বশিরউদ্দীন আরও বলেন, বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ক এবং আমাদের বাণিজ্যের যে ধরন, তার ওপর ভিত্তি করে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় আমাদের করণীয় নির্ধারণ করা হচ্ছে। শুল্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের কিছু অশুল্ক বাণিজ্য বাধা রয়েছে, সেগুলোকে আমরা আলোচনার মাধ্যমে দূর করতে চাই।

এই বৈঠকের দুই দিন পর ৭ এপ্রিল, বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লেখেন ড. ইউনূস।

চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা আগামী প্রান্তিকের মধ্যে আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শেষ করব। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ সভার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেবেন। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করতে চাই যে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করুন। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আপনি আমাদের অনুরোধ রাখবেন।’

৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত

বাজারের অস্থিরতা ও আলোচনার পথ খুলে দিতে ৯ এপ্রিল বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সব দেশের সঙ্গেই আলোচনায় একটা ন্যায্য সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। তবে এই তিন মাস ১০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে সব দেশকেই। কানাডা, মেক্সিকো ও চীনকে এই তালিকার বাইরে রাখে ট্রাম্প প্রশাসন।

ওই দিনই, ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিতের অনুরোধে সাড়া দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেন অধ্যাপক ইউনূস।

সংলাপের প্রস্তুতি

পরবর্তীকালে ১৯ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সরকারের শীর্ষ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কহার হ্রাস করা হবে।

২ জুন বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

এরপর ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে অংশ নেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ন্যায্য বাণিজ্য চুক্তির আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ পাল্টা শুল্ক সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে সীমিত রাখার প্রস্তাব তুলে ধরে। বৈঠকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ২৯ জুন আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

এরপর গত সোমবার (৭ জুলাই) ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠিও পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা পর ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশের সব ধরনের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই শুল্ক সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে।

স্ট্রিম গ্রাফিক
স্ট্রিম গ্রাফিক

দ্বিতীয় দফায় আলোচনা

এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে দ্বিতীয় দফায় আলোচনার জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায় ইউএসটিআর। গত ৯ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী এই আলোচনায় অংশ নেন বাণিজ্য উপদেষ্টা, বাণিজ্য সচিব ও অতিরিক্ত সচিব।

এরপর গত ১১ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ওয়াশিংটনে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। উভয়পক্ষ পারস্পরিক সুবিধার্থে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। দুই পক্ষের আলোচনায় শুল্ক বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

শনিবার (১২ জুলাই) ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো বাংলাদেশ দূতাবাসের এক বার্তায় জানানো হয়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনে আরও কিছু বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। তবে কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত। তবে দুই পক্ষই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে শুল্কছাড়ের বিষয়ে দুই দেশ আবার আলোচনায় বসবে।

তবে এই আলোচনায় কোন কোন বিষয় মীমাংসিত এবং কোন কোন বিষয় অমীমাংসিত, সে ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।

রবিবার (১৩ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে পণ্যের ‘বিশাল’ তালিকা ই-মেইল মারফত বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

এই তালিকায় কোন কোন পণ্যের উল্লেখ আছে—এ প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, তালিকাটি বিশাল। এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু বলা সম্ভব নয়।

আজ সোমবার (১৪ জুলাই) বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফায় আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় দফায় সমঝতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হবে। আমরা আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক নির্ধারণ করবে। আশা করি, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে।’

আলোচনার ফলাফল কী, এমন প্রশ্নের জবাব শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া কেউ জানে না। শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্য করে আসছে। বৈষম্য না হলে আগামীতেও আমরা বাণিজ্য করব।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত