মো. ইসতিয়াক
এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু আর এখন কেবল মৌসুমি বা শহুরে কোনো রোগ নয়। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রায় সব মৌসুমেই মানুষের জীবনে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। ডেঙ্গু ডাইনামিক ড্যাশবোর্ড (২০২৫) অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪১ হাজার ৯১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে দেশের সব হাসপাতাল এখনও রিপোর্টিং সিস্টেমে যুক্ত না হওয়ায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে ধারণা।
ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে—১৬ হাজার ৬৪৯ জন, যা মোট আক্রান্তের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এই বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৫ জন, যা মোট আক্রান্তের ২৯ দশমিক ২২ শতাংশ।
এছাড়া চট্টগ্রামে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৩৩৫, রাজশাহীতে ২ হাজার ৭৮৮, খুলনায় ২ হাজার ৭৯, ময়মনসিংহে ৮৪৩, রংপুরে ২৭৮ এবং সিলেটে ১১৪ জন।
মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মারা গেছেন ২৩ জন, জুনে ১৯, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ২০ দিনে মারা গেছেন ৪৫ জন। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১৬৭ জনের, যার মধ্যে ১৫৩ জনই শিশু, কিশোর ও তরুণ। যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৯১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা মাত্র ১৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশেরও কম।
স্পষ্টতই, ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষদের। এই বয়সী মানুষের মৃত্যু কেবল পারিবারিক শোকই নয়, দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায়ও সরাসরি প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, ডেঙ্গুর প্রকোপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নিয়ে হতাশ কেউ কেউ। যেমন মিরপুরের বাসিন্দা আসাদ রহমান বলেন, ‘আমরা মশারি, স্প্রে, কয়েল, রেপেলেন্ট কিনে এবং নিয়মিত বাড়ি পরিষ্কার রেখেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। সামর্থ্যের বাইরে খরচ করেছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা দেখিনি। মাঝে মাঝে ফগিং হয়, তবে কার্যকর কিছু চোখে পড়ে না। মনে হয় আমরা একাই লড়ছি।’
২০০০ সালে দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ডেঙ্গুকে একসময় শুধু মৌসুমি সমস্যা মনে করা হতো। তবে বর্তমানে এটি সারা বছরের জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ৬ হাজার ৬০ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখের বেশি হয় এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৯ ছাড়িয়ে যায়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রকোপ দেখা যায় ২০২৩ সালে। ওই বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১,৭০৫ জন প্রাণ হারায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক ডেঙ্গু বুলেটিনে ঢাকার ৫৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ৮০টি জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালের তথ্য থাকে। অথচ দেশে প্রায় ১৬ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ, ডেঙ্গু প্রকোপের প্রকৃত চিত্র এখনও পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান স্ট্রিমকে জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহারের বৃদ্ধি মূলত কয়েকটি কারণে ঘটছে।
তিনি বলেন, ‘রোগীরা অনেক সময় বেশি দেরিতে হাসপাতালে আসে, ডেঙ্গু নিয়ে আগের মতো সতর্কতা বা গুরুত্ব আর দেওয়া হয় না। এছাড়া, অন্যান্য সংক্রামক রোগের সঙ্গে আক্রান্ত হওয়া এবং রোগীদের ঢাকায় রেফার করার প্রক্রিয়াও মৃত্যুহার বাড়াচ্ছে।’
ডা. নাজমুল আরও উল্লেখ করেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম, তবে মৃত্যুহার বেড়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, মানুষ ডেঙ্গুকে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না, বিশেষ করে যখন একই সময়ে অন্যান্য ভাইরাসও ছড়িয়ে পড়ে।’
পরিসংখ্যান দেখায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, যার মধ্যে ৯১.৫৬ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মারা গেছেন ২৩ জন, জুনে ১৯, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ২০ দিনে ৪৫ জন।
ডা. নাজমুলের ভাষ্য অনুযায়ী, দেরিতে চিকিৎসা শুরু করা এবং রোগীদের ঢাকায় রেফার করার বিলম্ব এই সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেন, মৌসুমের বাইরে বা সারা বছর ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনসচেতনতা কম থাকায় মৃত্যু ও জটিলতার ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, বয়সে ছোট ও একাধিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শুধু গুরুতর অবস্থার রোগীদের ঢাকায় রেফার করা উচিত।
অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান জানান, শুরুতেই অনেক রোগী গুরুতর লক্ষণগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না, যার ফলে হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় তাদের অবস্থার মাত্রা অনেকাংশে সংকটজনক হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘গুরুতর পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, তীব্র অবসাদ, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়া—এসব লক্ষণ যে প্রাণঘাতী হতে পারে, তা রোগীরা অনেক সময় নাজরদারি করেন দেরিতেই।’
ডা. নাজমুল ঝুঁকি কমানোর জন্য বয়স্ক রোগী, একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সন্তানসম্ভবা নারীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। তিনি সতর্ক করেন, ডেঙ্গুর ভিন্ন সেরোটাইপে পুনঃসংক্রমণ হলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে শুরুতেই চিকিৎসা বিলম্ব হলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় মৃত্যুর হার সর্বাধিক হওয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডা. নাজমুল বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে ঢাকায় রেফার করা হয়। অনেকে ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হলেও ঢাকার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। রেফার বিলম্বও বড় একটি কারণ।’
ডা. নাজমুল আরও বলেন, ‘বরিশাল বা অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় আসতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে রোগী যদি ইতিমধ্যেই শকে থাকে, তাহলে এই দেরি প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়।’
ডা. নাজমুল জেলার হাসপাতালগুলোকে জাতীয় ডেঙ্গু চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্থানীয়ভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘শুধুমাত্র গুরুতর অবস্থার রোগীদের ঢাকায় পাঠানো উচিত। কিন্তু অনেক সময় ভয়ের কারণে রোগীকে আগেই রেফার করা হয়। শকে থাকা রোগীকে স্থিতিশীল করার পরই ঢাকায় পাঠানো উচিত। দুর্ভাগ্যবশত অনেক হাসপাতাল এটি করছে না, ফলে রোগীরা মারাত্মক শক নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান, যা মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগেভাগে চিকিৎসা শুরু করা এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষভাবে বয়স্ক রোগী, শিশু এবং একাধিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।’
মুশতাক হোসেন আরও বলেন, ‘মানুষকে সিটি করপোরেশন প্রদত্ত বিনামূল্যের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা গ্রহণে উৎসাহিত করতে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।’
পাশাপাশি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে রক্ত সংগ্রহকেন্দ্র সম্প্রসারণ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী সুপারিশ করেন তিনি।
মুশতাক হোসেন জোর দেন, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সারা বছরব্যাপী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো, যাতে মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘পুরনো কৌশল এবং দুর্বল পরিকল্পনার কারণে ঢাকা শহরে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসছে না।’
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খরচ করেছে প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা, আর ডিএসসিসি খরচ করেছে ২৪৩ কোটি টাকা। তবে, এই ব্যয় সত্ত্বেও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রাজধানীতে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে।
মুশতাক হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ ছাড়া এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই ব্যর্থ হবে।’
তিনি কার্যকর জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষায়িত সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই বিভাগ ভেক্টর নিয়ন্ত্রণে গবেষণা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সমন্বয় করবে।
প্রতি বছর ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অভিযান চালায়। এই কার্যক্রমে সাধারণত অন্তর্ভুক্ত থাকে আবাসিক এলাকা, বাজার ও জনসমাগমস্থলে ফগিং করে পূর্ণবয়স্ক মশা ধ্বংস, জলাশয়, নালা-নর্দমা ও নির্মাণস্থলে লার্ভিসাইড স্প্রে এবং সচেতনতা কার্যক্রম ও বিশেষ অভিযান। তবে সিটি করপোরেশনগুলোর বাজেটের বড় অংশই কীটনাশক কেনায় ব্যয় হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ডিএনসিসি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ১৩৫ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা কীটনাশক কেনার জন্য রাখা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একই সময়ে ৪৬ দশমিক ৫০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা কীটনাশক কেনার জন্য বরাদ্দ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই পুরোনো কৌশল মশার উপদ্রব কমাতে যথেষ্ট নয়।
এই প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনগুলোকে বছরের শুরু থেকেই প্রজননস্থল চিহ্নিত করে মহল্লাগুলো ভাগ করতে হবে এবং সেখানে জোরালো মশকনিধন অভিযান চালাতে হবে।’
একই সঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের কাজ নিয়মিত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, অন্তত প্রতি দুই মাসে মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি সতর্ক করেন যে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহারে মশার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তাই গবেষকদের সম্পৃক্ত করা এবং ল্যাবরেটরির ফলাফল ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য।
মশক নিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তা কতটা কার্যকর—এই প্রশ্ন করা হয় ডিএসসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীনকে। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘কীটনাশক ব্যবহারের আগে তিনটি স্বতন্ত্র পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া জরুরি—আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখা এবং ডিএসসিসি নিজস্ব ফিল্ড টেস্ট। তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে যদি কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশের উপরে হয়, তখনই কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।’
এ পর্যন্ত মশার মধ্যে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ডা. নিশাত ফগিং অনিয়মিত হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগীর তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।’
তবে, ডিজি হেলথের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঢাকার হাসপাতালের ভর্তি রোগীর সংখ্যা সবসময় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার টারশিয়ারি লেভেলের মেডিকেল কলেজগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী আসে। ফলে ঢাকা শহরে প্রকাশিত রোগীর সংখ্যা সরাসরি ডিএসসিসি এলাকায় আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে মেলানো যায় না।
ফগিং কার্যক্রম নিয়মিত না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু মশা মূলত ঘরের ভেতরে জন্মায়। আমাদের ফোকাস প্রধানত বাইরের এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে। ঘরের ভেতরের ডেঙ্গু লার্ভা ধ্বংসে জনসচেতনতা অপরিহার্য। সিটি করপোরেশন সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।’
ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ ঘরের ভেতরে পানি জমা না হওয়া নিশ্চিত করার পাশাপাশি, মানুষকে লম্বা কাপড় পরা, মশারি ব্যবহার এবং জ্বর দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেয়। জনসচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা— এই দ্বিমুখী উদ্যোগ ডিএসসিসির কার্যক্রমের মূল ভিত্তি।
কীটনাশকের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী স্ট্রিমকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক শতভাগ কার্যকর। প্রতিবার ওষুধ কেনার আগে ও পরে তিন ধাপে পরীক্ষা করা হয়—আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখা এবং ডিএনসিসির নিজস্ব ফিল্ড টেস্ট। শুধু তাই নয়, সেন্ট্রাল স্টোর থেকে ওষুধ আসার পর থেকে মাঠপর্যায়ে মশককর্মীদের হাতে স্প্রে মেশিনে ভরার সময় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে র্যান্ডম স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এমনকি মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটিও ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করে।’
তিনি দাবি করেন, আন্তর্জাতিক গবেষণা কিংবা বৈজ্ঞানিক কোনো জার্নালেও এ পর্যন্ত মশার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার প্রমাণ মেলেনি।
তবে ইমরুল কায়েস স্বীকার করেন, ‘মাঠপর্যায়ের কর্মীদের দক্ষতার অভাব এবং বিশেষ করে বসতবাড়ির ভেতরে অভিযান চালাতে না পারা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এডিস মশার প্রজননস্থল অনেকাংশেই বাড়ির ভেতরে থেকে যায়, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়।’
ডিএনসিসির প্রধান এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও জানান, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন আর জুন-জুলাইয়ে নয়; বরং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বেশি দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এ প্রবণতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা ২০২৪ ও ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক কম।’
ইমরুল কায়েস চৌধুরী সতর্ক করে বলেন, ‘শুধু কীটনাশক দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ঢাকার অতিরিক্ত জনঘনত্ব, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং নাগরিকদের সচেতনতার ঘাটতি মিলিয়ে প্রতিবার এক পশলা বৃষ্টিতেই হাজারো প্রজননস্থল তৈরি হয়। বাড়ির ফুলের টব, ছাদ, বারান্দা বা বেজমেন্টে জমে থাকা পানি ডেঙ্গুর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।’
তার মতে, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় ওষুধ কার্যকর হলেও নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া সমন্বিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়।’
এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু আর এখন কেবল মৌসুমি বা শহুরে কোনো রোগ নয়। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রায় সব মৌসুমেই মানুষের জীবনে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। ডেঙ্গু ডাইনামিক ড্যাশবোর্ড (২০২৫) অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪১ হাজার ৯১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে দেশের সব হাসপাতাল এখনও রিপোর্টিং সিস্টেমে যুক্ত না হওয়ায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে ধারণা।
ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে—১৬ হাজার ৬৪৯ জন, যা মোট আক্রান্তের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এই বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৫ জন, যা মোট আক্রান্তের ২৯ দশমিক ২২ শতাংশ।
এছাড়া চট্টগ্রামে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৩৩৫, রাজশাহীতে ২ হাজার ৭৮৮, খুলনায় ২ হাজার ৭৯, ময়মনসিংহে ৮৪৩, রংপুরে ২৭৮ এবং সিলেটে ১১৪ জন।
মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মারা গেছেন ২৩ জন, জুনে ১৯, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ২০ দিনে মারা গেছেন ৪৫ জন। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১৬৭ জনের, যার মধ্যে ১৫৩ জনই শিশু, কিশোর ও তরুণ। যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৯১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংখ্যা মাত্র ১৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশেরও কম।
স্পষ্টতই, ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষদের। এই বয়সী মানুষের মৃত্যু কেবল পারিবারিক শোকই নয়, দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতায়ও সরাসরি প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, ডেঙ্গুর প্রকোপ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নিয়ে হতাশ কেউ কেউ। যেমন মিরপুরের বাসিন্দা আসাদ রহমান বলেন, ‘আমরা মশারি, স্প্রে, কয়েল, রেপেলেন্ট কিনে এবং নিয়মিত বাড়ি পরিষ্কার রেখেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি। সামর্থ্যের বাইরে খরচ করেছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা দেখিনি। মাঝে মাঝে ফগিং হয়, তবে কার্যকর কিছু চোখে পড়ে না। মনে হয় আমরা একাই লড়ছি।’
২০০০ সালে দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ডেঙ্গুকে একসময় শুধু মৌসুমি সমস্যা মনে করা হতো। তবে বর্তমানে এটি সারা বছরের জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ৬ হাজার ৬০ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখের বেশি হয় এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৯ ছাড়িয়ে যায়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রকোপ দেখা যায় ২০২৩ সালে। ওই বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১,৭০৫ জন প্রাণ হারায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক ডেঙ্গু বুলেটিনে ঢাকার ৫৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং ৮০টি জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালের তথ্য থাকে। অথচ দেশে প্রায় ১৬ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ, ডেঙ্গু প্রকোপের প্রকৃত চিত্র এখনও পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান স্ট্রিমকে জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহারের বৃদ্ধি মূলত কয়েকটি কারণে ঘটছে।
তিনি বলেন, ‘রোগীরা অনেক সময় বেশি দেরিতে হাসপাতালে আসে, ডেঙ্গু নিয়ে আগের মতো সতর্কতা বা গুরুত্ব আর দেওয়া হয় না। এছাড়া, অন্যান্য সংক্রামক রোগের সঙ্গে আক্রান্ত হওয়া এবং রোগীদের ঢাকায় রেফার করার প্রক্রিয়াও মৃত্যুহার বাড়াচ্ছে।’
ডা. নাজমুল আরও উল্লেখ করেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম, তবে মৃত্যুহার বেড়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, মানুষ ডেঙ্গুকে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না, বিশেষ করে যখন একই সময়ে অন্যান্য ভাইরাসও ছড়িয়ে পড়ে।’
পরিসংখ্যান দেখায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, যার মধ্যে ৯১.৫৬ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মারা গেছেন ২৩ জন, জুনে ১৯, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম ২০ দিনে ৪৫ জন।
ডা. নাজমুলের ভাষ্য অনুযায়ী, দেরিতে চিকিৎসা শুরু করা এবং রোগীদের ঢাকায় রেফার করার বিলম্ব এই সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেন, মৌসুমের বাইরে বা সারা বছর ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনসচেতনতা কম থাকায় মৃত্যু ও জটিলতার ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, বয়সে ছোট ও একাধিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শুধু গুরুতর অবস্থার রোগীদের ঢাকায় রেফার করা উচিত।
অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান জানান, শুরুতেই অনেক রোগী গুরুতর লক্ষণগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না, যার ফলে হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় তাদের অবস্থার মাত্রা অনেকাংশে সংকটজনক হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘গুরুতর পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, তীব্র অবসাদ, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়া—এসব লক্ষণ যে প্রাণঘাতী হতে পারে, তা রোগীরা অনেক সময় নাজরদারি করেন দেরিতেই।’
ডা. নাজমুল ঝুঁকি কমানোর জন্য বয়স্ক রোগী, একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সন্তানসম্ভবা নারীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। তিনি সতর্ক করেন, ডেঙ্গুর ভিন্ন সেরোটাইপে পুনঃসংক্রমণ হলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে শুরুতেই চিকিৎসা বিলম্ব হলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় মৃত্যুর হার সর্বাধিক হওয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডা. নাজমুল বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে ঢাকায় রেফার করা হয়। অনেকে ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হলেও ঢাকার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। রেফার বিলম্বও বড় একটি কারণ।’
ডা. নাজমুল আরও বলেন, ‘বরিশাল বা অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় আসতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে রোগী যদি ইতিমধ্যেই শকে থাকে, তাহলে এই দেরি প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়।’
ডা. নাজমুল জেলার হাসপাতালগুলোকে জাতীয় ডেঙ্গু চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্থানীয়ভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘শুধুমাত্র গুরুতর অবস্থার রোগীদের ঢাকায় পাঠানো উচিত। কিন্তু অনেক সময় ভয়ের কারণে রোগীকে আগেই রেফার করা হয়। শকে থাকা রোগীকে স্থিতিশীল করার পরই ঢাকায় পাঠানো উচিত। দুর্ভাগ্যবশত অনেক হাসপাতাল এটি করছে না, ফলে রোগীরা মারাত্মক শক নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান, যা মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগেভাগে চিকিৎসা শুরু করা এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষভাবে বয়স্ক রোগী, শিশু এবং একাধিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।’
মুশতাক হোসেন আরও বলেন, ‘মানুষকে সিটি করপোরেশন প্রদত্ত বিনামূল্যের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা গ্রহণে উৎসাহিত করতে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।’
পাশাপাশি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে রক্ত সংগ্রহকেন্দ্র সম্প্রসারণ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী সুপারিশ করেন তিনি।
মুশতাক হোসেন জোর দেন, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সারা বছরব্যাপী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো, যাতে মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘পুরনো কৌশল এবং দুর্বল পরিকল্পনার কারণে ঢাকা শহরে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসছে না।’
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খরচ করেছে প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা, আর ডিএসসিসি খরচ করেছে ২৪৩ কোটি টাকা। তবে, এই ব্যয় সত্ত্বেও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রাজধানীতে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে।
মুশতাক হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ ছাড়া এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই ব্যর্থ হবে।’
তিনি কার্যকর জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষায়িত সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই বিভাগ ভেক্টর নিয়ন্ত্রণে গবেষণা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সমন্বয় করবে।
প্রতি বছর ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অভিযান চালায়। এই কার্যক্রমে সাধারণত অন্তর্ভুক্ত থাকে আবাসিক এলাকা, বাজার ও জনসমাগমস্থলে ফগিং করে পূর্ণবয়স্ক মশা ধ্বংস, জলাশয়, নালা-নর্দমা ও নির্মাণস্থলে লার্ভিসাইড স্প্রে এবং সচেতনতা কার্যক্রম ও বিশেষ অভিযান। তবে সিটি করপোরেশনগুলোর বাজেটের বড় অংশই কীটনাশক কেনায় ব্যয় হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ডিএনসিসি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ১৩৫ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা কীটনাশক কেনার জন্য রাখা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একই সময়ে ৪৬ দশমিক ৫০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা কীটনাশক কেনার জন্য বরাদ্দ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই পুরোনো কৌশল মশার উপদ্রব কমাতে যথেষ্ট নয়।
এই প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনগুলোকে বছরের শুরু থেকেই প্রজননস্থল চিহ্নিত করে মহল্লাগুলো ভাগ করতে হবে এবং সেখানে জোরালো মশকনিধন অভিযান চালাতে হবে।’
একই সঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের কাজ নিয়মিত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, অন্তত প্রতি দুই মাসে মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি সতর্ক করেন যে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহারে মশার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তাই গবেষকদের সম্পৃক্ত করা এবং ল্যাবরেটরির ফলাফল ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য।
মশক নিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তা কতটা কার্যকর—এই প্রশ্ন করা হয় ডিএসসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীনকে। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘কীটনাশক ব্যবহারের আগে তিনটি স্বতন্ত্র পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া জরুরি—আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখা এবং ডিএসসিসি নিজস্ব ফিল্ড টেস্ট। তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে যদি কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশের উপরে হয়, তখনই কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।’
এ পর্যন্ত মশার মধ্যে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ডা. নিশাত ফগিং অনিয়মিত হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগীর তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।’
তবে, ডিজি হেলথের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঢাকার হাসপাতালের ভর্তি রোগীর সংখ্যা সবসময় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার টারশিয়ারি লেভেলের মেডিকেল কলেজগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী আসে। ফলে ঢাকা শহরে প্রকাশিত রোগীর সংখ্যা সরাসরি ডিএসসিসি এলাকায় আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে মেলানো যায় না।
ফগিং কার্যক্রম নিয়মিত না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু মশা মূলত ঘরের ভেতরে জন্মায়। আমাদের ফোকাস প্রধানত বাইরের এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে। ঘরের ভেতরের ডেঙ্গু লার্ভা ধ্বংসে জনসচেতনতা অপরিহার্য। সিটি করপোরেশন সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।’
ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ ঘরের ভেতরে পানি জমা না হওয়া নিশ্চিত করার পাশাপাশি, মানুষকে লম্বা কাপড় পরা, মশারি ব্যবহার এবং জ্বর দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেয়। জনসচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা— এই দ্বিমুখী উদ্যোগ ডিএসসিসির কার্যক্রমের মূল ভিত্তি।
কীটনাশকের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী স্ট্রিমকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক শতভাগ কার্যকর। প্রতিবার ওষুধ কেনার আগে ও পরে তিন ধাপে পরীক্ষা করা হয়—আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সুরক্ষা শাখা এবং ডিএনসিসির নিজস্ব ফিল্ড টেস্ট। শুধু তাই নয়, সেন্ট্রাল স্টোর থেকে ওষুধ আসার পর থেকে মাঠপর্যায়ে মশককর্মীদের হাতে স্প্রে মেশিনে ভরার সময় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে র্যান্ডম স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এমনকি মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটিও ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করে।’
তিনি দাবি করেন, আন্তর্জাতিক গবেষণা কিংবা বৈজ্ঞানিক কোনো জার্নালেও এ পর্যন্ত মশার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার প্রমাণ মেলেনি।
তবে ইমরুল কায়েস স্বীকার করেন, ‘মাঠপর্যায়ের কর্মীদের দক্ষতার অভাব এবং বিশেষ করে বসতবাড়ির ভেতরে অভিযান চালাতে না পারা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এডিস মশার প্রজননস্থল অনেকাংশেই বাড়ির ভেতরে থেকে যায়, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়।’
ডিএনসিসির প্রধান এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরও জানান, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন আর জুন-জুলাইয়ে নয়; বরং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বেশি দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এ প্রবণতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা ২০২৪ ও ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক কম।’
ইমরুল কায়েস চৌধুরী সতর্ক করে বলেন, ‘শুধু কীটনাশক দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ঢাকার অতিরিক্ত জনঘনত্ব, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং নাগরিকদের সচেতনতার ঘাটতি মিলিয়ে প্রতিবার এক পশলা বৃষ্টিতেই হাজারো প্রজননস্থল তৈরি হয়। বাড়ির ফুলের টব, ছাদ, বারান্দা বা বেজমেন্টে জমে থাকা পানি ডেঙ্গুর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।’
তার মতে, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় ওষুধ কার্যকর হলেও নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া সমন্বিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।’
৪১ মিনিট আগেবিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মনোযোগ যখন কমে আসছে, তখন এই বিষয়টিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন সাংবাদিক, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আজ শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদের এলডি হলে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
৪ ঘণ্টা আগেরাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ২৯টি মামলার আসামি মো. বশির ওরফে কামরুল হাসান ওরফে জুয়েল (৫৩) গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
৪ ঘণ্টা আগে