leadT1ad

মেহেদী হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা: মোদি বলেছেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ভারতে রাখতে চান

গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত ব্রিটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে একটি সাক্ষাৎকার দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এই সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তাঁরা হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত, ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১: ০৫
ছবি: জেটিওর সৌজন্যে

স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকলে দিল্লি সম্ভবত শেখ হাসিনাকে রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৮ সেপ্টেম্বর অনলাইন সংবাদমাধ্যম জেটিও-এর ‘মেহেদি আনফিল্টার্ড’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আল জাজিরার সাবেক সাংবাদিক মেহেদি হাসানের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

হাসিনা-প্রশ্নে ইউনূস জানান, আন্তর্জাতিক আইনে যদি দিল্লির স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে, তারা হয়তো শেখ হাসিনাকে রাখবে। তবে যদি এমন কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে যা এড়ানো সম্ভব নয়, তখন পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।

ইউনূস বলেন, ‘আমি হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মোদির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি দুটি বিষয় বলেছেন। প্রথমত, তাঁরা হাসিনাকে রাখতে চান। আমি বলেছি, আমরা আপনাদের বলব না তাঁকে নিয়ে কী করতে হবে। তবে নিশ্চিত করুন যে তিনি আমাদের বা বাংলাদেশের জনগণ নিয়ে যেন কিছু না বলেন।’

মোদির বক্তব্য উদ্ধৃত করে ইউনূস বলেন, ‘তিনি বলেছেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না”।’

শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের আগ্রহ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইউনূস বলেন, ‘ভারত সব সময় শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছে। এখনো যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেন, তাঁরা আশা করছেন, তিনি বিজয়ী নেত্রী হয়ে বাংলাদেশে ফিরবেন।’

এ সময় মেহেদী হাসান জানতে চান, শেখ হাসিনা যে ভার্চুয়ালভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন এবং ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন—এ বিষয়ে আপনি উদ্বিগ্ন কি না।

জবাবে ইউনূস বলেন, ‘আমি সেভাবে বলব না। তবে বিদেশি শক্তি তাঁকে সমর্থন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে—এই আশঙ্কা আমরা সবসময়ই করি।’

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হবে, অমর্ত্য সেনসহ অন্যান্য সমালোচকদের এমন মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করা হলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, তাদের কার্যক্রম কেবল স্থগিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এটি ভুল সমালোচনা। আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। তারা শুধু রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। এখন তারা নির্বাচন করতে পারছে না, কিন্তু দল হিসেবে তারা বৈধ রয়েছে। আপাতত কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। যে কোনো সময় তা তুলে নেওয়া হতে পারে।’

নির্বাচনে কোনো দলকে অংশ নিতে না দেওয়া কতটা গণতান্ত্রিক—এই প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন দলটির কর্মকাণ্ড ও আচরণ বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই দল আসলে রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে না। তারা মানুষ হত্যার দায় স্বীকার করেনি। কোনো অনুশোচনাও প্রকাশ করেনি। বরং তারা সবসময় অন্যদের দোষারোপ করছে।’

ভারত সব সময় শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছে। এখনো যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেন, তাঁরা আশা করছেন, তিনি বিজয়ী নেত্রী হয়ে বাংলাদেশে ফিরবেন।’

আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে ‘কোটি কোটি সমর্থক’ আছে, মেহেদী হাসানের এই মন্তব্যও অস্বীকার করেন ইউনূস। তিনি বলেন, ‘তাদের সমর্থক আছে। তবে কতজন আছে জানি না। অনেক সময় ক্ষমতার কারণে মানুষ শক্তিশালী পক্ষকে মান্য করে। সেটি প্রকৃত সমর্থন নয়।’

যদি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া হয় তবে তাদের সমর্থকেরা কী করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, ‘তারা বৈধ ভোটার। অনেক প্রার্থী আছে। তাঁরা নিজেদের মতো করে ভোট দেবে।’

‘ভুয়া খবরের’ কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেশি মনে হচ্ছে

সাক্ষাৎকারে মেহেদী হাসান মুহাম্মদ ইউনূসকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার খবর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার খবর নিয়ে প্রশ্ন করলে মুহাম্মদ ইউনূস তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘এসব ভুয়া খবর। এসবের ওপর নির্ভর করা যায় না। ভারত এখন ভুয়া খবরের বন্যায় ভাসছে।’

তাঁর মতে, বেশির ভাগ ঘটনাই ছিল সাধারণ বিরোধ, যা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। ইউনূস বলেন, ‘প্রতিবেশীদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ হতে পারে। তাঁদের একজন হিন্দু, আরেকজন মুসলমান। তখন বলা হয় হিন্দু-মুসলমান সংঘাত। আসলে এটি কেবল জমি নিয়ে বা অন্য কোন স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিয়ে বিরোধ।’

তিনি সংখ্যালঘুদের আহ্বান জানান, নিজেদের আলাদা করে উপস্থাপন না করতে। তাঁর ভাষায়, ‘নিজেদেরকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু না বলে সবসময় বলুন আমি এই দেশের নাগরিক। রাষ্ট্র আমাকে সুরক্ষা দেবে— এটাই দাবি করুন। এতে করে সব বঞ্চিত মানুষ আপনাদের পাশে থাকবে। আমরা একই দেশের নাগরিক।’

অর্থনীতি ও শুল্ক ইস্যু

মেহেদী হাসান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে ধরলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘হাসিনা আমলের সব তথ্য ভুয়া ছিল। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবেই তথ্য সাজানো হতো। আমরা এখন অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করছি।’

শুল্ক ইস্যুতে সন্তোষ প্রকাশ করে ইউনূস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা নিয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। শুল্ক ২০ শতাংশ রাখা হয়েছে। এটি এখনও বেশি, কিন্তু আশঙ্কার মতো বেশি হয়নি। ভারতের তুলনায় আমাদের অবস্থান ভালো। ফলে ভারতও তাদের শিল্পকারখানাও বাংলাদেশে স্থাপনের কথা ভাবতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে এবং রপ্তানিও বাড়বে।’

কীভাবে তিনি শুল্ক কমাতে পারলেন এ প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে পেরেছি যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমেরিকানরা এটা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন।’

‘শেষ কাজ নির্বাচন আয়োজন’

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে নেপালের উদাহরণ টেনে মেহেদী হাসান জানতে চান, নেপালের অন্তবর্তী সরকার তো মাত্র ছয় মাস সময় চেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজন করতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

‘অনেক কাজ আছে’ জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সরকার কত দিন থাকবে, তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে তিনটি কাজ অবশ্যই সম্পন্ন করা জরুরি— সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন।’

ইউনূস বলেন, এর মধ্যে সংস্কার একটি বড় দাবি। কারণ, সংস্কার ছাড়া শুধু নির্বাচন করলেই আবার পুরোনো পরিস্থিতি ফিরে আসবে।

ভারতের তুলনায় আমাদের অবস্থান ভালো। ফলে ভারতও তাদের শিল্পকারখানাও বাংলাদেশে স্থাপনের কথা ভাবতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে এবং রপ্তানিও বাড়বে।’

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জনগণের অন্যতম দাবি ছিল সংস্কার ও ফ্যাসিবাদকে উপড়ে ফেলা। এ কথা উল্লেখ করে ইউনূস বলেন, ‘যে সব পথে ফ্যাসিবাদ ফিরতে পারে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এটিই বড় কাজ।’

তিনি আরও বলেন, অপরাধীদের বিচার দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এজন্য বিশেষ আদালত গঠন করতে হবে।

ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ‘পুরো বিশ্বের জন্য লজ্জাজনক’

হাসিনার সময় পাসপোর্টে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘হাসিনা সরকার যখন এটি করেছিল, পুরো বাংলাদেশ বিরোধিতা করেছিল। আমরা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিইনি এবং পাসপোর্টেও স্বীকৃতি আর ফিরিয়ে আনতে চাই না। তাই প্রথমেই আমরা ইসরায়েলের স্বীকৃতি বাতিল করে পুরোনো নীতি পুনঃস্থাপন করেছি।’

গাজায় হামলার নিন্দা জানিয়ে ইউনূস বলেন, ‘সবার চোখের সামনে এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। শিশুরা মারা যাচ্ছে, মানুষ খাদ্যের জন্য ছুটছে। তবুও আমরা কিছুই করতে পারছি না। এটি পুরো বিশ্বের জন্য লজ্জাজনক।’

মানবিক করিডোর প্রসঙ্গে

মানবিক করিডোর নিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করলে ইউনূস বলেন, ‘করিডোরের কোনো প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে কেউ কিছু বলেনি।’ তিনি আরও বলেন, নির্বাচন সরকারের উদ্বেগের বিষয়, সেনাপ্রধানের নয়।

নিজের পদত্যাগের গুঞ্জন প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, ‘আমি কিছুটা হতাশ ছিলাম। কাজগুলো যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছিল না। সবসময় বিলম্ব ঘটছিল। তখন মনে হয়েছে, যদি আমাকে কাজ করতেই না দেওয়া হয়, তবে থাকার প্রয়োজন কী? সেজন্য আমি পদত্যাগের কথা বলেছিলাম।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত