leadT1ad

আহত যোদ্ধার বয়ানে জনতার জুলাই

‘মনে হচ্ছিল কিছু না করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পতন ঘটেছিল শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের। এ আন্দোলনে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অজস্র মানুষ। শহীদ হয়েছেন অনেকে। আর যাঁরা আহত হয়ে অঙ্গ হারিয়েছেন, বদলে গেছে তাঁদের জীবনও। এখন কেমন আছেন তাঁরা? গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে স্ট্রিম আজ কথা বলেছে আহত কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে। এই প্রতিবেদনে থাকল আহত যোদ্ধা মবিনের গল্প।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৩৬
মবিন। সংগৃহীত ছবি

জুলাই অভ্যুত্থানে দুই চোখ হারিয়েছিলেন এক তরুণ। বয়স আঠারো, কিন্তু মনে ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। দারিদ্র্য, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কিংবা প্রাণের মায়া—কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। আজ তিনি দেখতে পান না, কিন্তু দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এখনো।

তরুণের নাম মবিন। শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বড় শিধলকুড়া গ্রামের মৃত মোফাজ্জল হোসেন ও নাজমা বেগমের ছোট ছেলে তিনি। সংসারে বড় ভাই বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, মেঝো ভাই মো. পলাশ পেশায় ড্রাইভার। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে দুই বছর আগে ঢাকার উত্তরা রাজলক্ষ্মী এলাকার একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি শুরু করেন মবিন।

গত বছরের ১৮ জুলাই সকালে দোকানে ঝাঁপ খুলেন মবিন। তখন উত্তরার রাজপথ উত্তপ্ত। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকেন। স্ট্রিমকে মবিন বলেন, ‘মন টিকছিল না। দোকান বন্ধ করে আমি মিছিলে যাই। মনে হচ্ছিল কিছু না করলে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবো না।’

মিছিলটি উত্তরা থানার দিকে এগোলে আচমকা শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছররা গুলি। মবিনের মুখে গুলি লাগে। চারপাশে তখন আতঙ্ক, ধোঁয়া আর চিৎকার।

মুহূর্তে চোখে নেমে আসে অন্ধকার। শেষবার তিনি দেখলেন, হাতে শিক্ষার্থীদের জাতীয় পতাকা এবং হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলা একটি মিছিল।

সড়কে লুটিয়ে পড়া রক্তাক্ত মবিনকে সহযোদ্ধারা কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে শেষে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে ১০ দিন ভর্তি থাকার পর টাকার অভাবে বাড়ি ফিরে যান তিনি। চিকিৎসার জন্য তার পরিবার প্রায় দুই লাখ টাকা ঋণ করে। এর কিছুদিন পর সহযোদ্ধাদের সহায়তায় সরকারিভাবে তাকে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি করানো হয়।

মবিনের দুই চোখে এখন পর্যন্ত ছয়টি অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আরও দুইটি জটিল অস্ত্রোপচারের পর আংশিক দৃষ্টিশক্তি ফিরতে পারে তার। সিএমএইচে চিকিৎসার পর থেকে বাম চোখে সাদা-কালো কিছু আলো অনুভব করতে পারেন তিনি, তবে স্পষ্ট দেখতে পান না।

স্ট্রিমকে মবিন বলেন, ‘চোখ ফেরত পেলে আমি দেখতে চাই—এই দেশের মানুষ আর বৈষম্যের শিকার না হোক। আমি চাই, কেউ যেন চাকরি, চিকিৎসা, শিক্ষা বা রাষ্ট্রের সেবায় শুধু ক্ষমতার ভিত্তিতে সুবিধা না পায়। আমি দেখতে চাই নতুন এক বাংলাদেশ যেখানে কেউ খুন করে ক্ষমতায় থাকে না, কেউ স্বৈরাচার হয়ে ফিরে আসে না।’

মবিনের বড় ভাই মো. পলাশ বলেন, ‘আমার ভাই চোখ হারিয়েছে, কিন্তু প্রাণে বেঁচে আছে। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। অনেকে তো গুম হয়েছেন, পরিবার খুঁজেও পায়নি। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, আহত-নিহতদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া হোক। চোখ গেলে জীবন থেমে যায় না, কিন্তু তা চালিয়ে নিতে সহায়তা দরকার।’

তার মা নাজমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসার চলতো এই দুই ছেলের ভরসায়। এখন এক ছেলে চোখ হারিয়েছে, আরেকজনের আয়ে কোনো রকমে দিন কাটে। সরকার সিএমএইচে চিকিৎসা দিচ্ছে বটে, কিন্তু ঢাকায় যাওয়া-আসার খরচ জোগাতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সরকারের কাছে একটা ঘরের দাবিও করছি।’

এই চিকিৎসায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন শরীয়তপুরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সংগঠক ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মাহবুব আলম জয়। তিনি বলেন, ‘মবিন ছাত্র নয়, চাকরির দাবিতে নয়, শুধু নতুন দেশের স্বপ্নে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তিনি চোখ হারিয়েছেন একটি সিস্টেমবিহীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সরকার বদলেছে, কিন্তু সিস্টেম বদলেছে কি?’

মবিন আজও জানেন না তার চোখে আর আলো ফিরবে কি না। কিন্তু তার কণ্ঠে এখনো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। তিনি বলেন, ‘আমার চোখ না থাকলেও আমি চাই—যারা চোখে দেখেন, তাঁরা দেখুক বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত